গত কদিনে দেশে নারী চিকিৎসকদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু অনভিপ্রেত ইডেন্ট আমাকে ভাবিয়েছে।
কিছু বিষয় সাধারণ ভাবে আলোচনা করবার মতো না। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করতে হচ্ছে।
আমি সদ্য ৩৯ তম বিসিএস পাস করা নবীন সরকারি চিকিৎসকদের কথা বলছি।
আমি এই সকল চিকিৎসক যে সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত, সময়ের পরিক্রমাতে সেইসব পোষ্টে জয়েন করা নতুন ডাক্তার দের কথা বলছি।
আমি যে কেবল নারী ডাক্তারদের কথা বলছি তা না।
কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা এবং বিগত দিনের ঘটনা গুলোর নীরিখে নারী চিকিৎসকদের নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত।
একটা ব্যতিক্রমী বিষয় হলো। ইন্টার্নশীপ শেষ করে জুতোর তলা ক্ষয় করে চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত এবং তুলনামূলক বয়স্ক গন আগে সরকারি চাকরি পেয়ে উপজেলাতে পোষ্টিং পেত।
কারন যাই হোক ৩৯ এ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদ্য ইন্টার্নশীপ শেষ করা ডাক্তার গন সিলেক্টেড।
এই কারনে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ভাষা,উপজেলা হাসপাতালে তাদের আচার আচরন অনেকের জানা নাই।
হাসপাতালে ইন্টার্ন থাকাকালীন নিজেকে সবথেকে শক্তিশালী ভাবতাম।আহ করলেই তো সব ইয়ারমেটকে পাবো।সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে মেরী ষ্টপস, ক্লিনিকে ডিউটি করে শিখেছি একা ডাক্তার হাসপাতালে থাকলে কিভাবে রুগী এবং তাদের আত্মীয় দের ম্যানেজ করতে হয়।
আর একটা বিষয়, দেখলাম সিলেক্টেড অনেক নারী ডাক্তার ই অবিবাহিত।
বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট এত জঘন্য,তা এই মর্মে আর বলছি না। নিজের কথা মনে আছে।উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঔষধ চুরি সহ বেশ কিছু অপ্রীতিকর ইভেন্ট এ উপজেলা চেয়ারম্যান এবং লোকাল পুলিশ কেবল এবং কেবলমাত্র ডিফেন্স অফিসার এর বৌ বলেই ম্যাডাম ম্যাডাম করত।
ফোন দেয়ার সাথে সাথে জরুরী কাজ ফেলে চলে আসত।
সময় টা ও এতটা অস্থির ছিল না।
তাই তোমরা যারা অতি সত্তর উপজেলাতে পোষ্টিং পেতে যাচ্ছ তাদের কাছে আমার অনুরোধঃ
# পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে যোগদান করবে।
# প্রথম কয়েকদিন কেবল সবার সাথে পরিচিত হবে। নিজের পরিচয় সকলকে দিবে।
# পরিবারে ডিফেন্স বা এডমিন কেউ থাকলে যার ফোনে থানার ওসি বিচলিত হবে, তার সাথে কষ্ট করে হলেও নিজের নিরাপত্তার খাতিরে যোগাযোগ মেইনটেইন করবে।
# সম্ভব হলে এবং সাপোর্ট থাকলে পোষ্টিং স্থলে থাকার চেষ্টা করবে।
# একেবারে শুরুতেই আলট্রাসনোগ্রাম /স্পেশাল রুগী দেখা বা প্রাকটিস বা নিকটস্থ ক্লিনিকে কাজ শুরু করবে না। কেউ অফার দিলে একটু সময় নিয়ে হাবভাব বুঝে তবে পা বাড়াবে।
# সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, কোনভাবেই অফিস চলাকালীন সময়ে রুগীর থেকে ভিজিট নিয়ে রুগী দেখবে না। কোনভাবেই না। রুগীরাই তোমাকে প্রভোক করবে। তবু করবে না।
# তোমাদের কাছে বিষ ফোড়ার মতো মনে হবে SACMO দের আচরন।ওরা সংঘবদ্ধ ।নিজের এলাকায় পোষ্টিং বলে এলাকার সাংবাদিক ও রুগীদের সাথে হট লিংকে। তাই শুরুতেই ওদের সাথে ঝামেলায় যাওয়া যাবে না। টেকনিক্যালি হ্যান্ডেল করতে হবে।
# পোষ্টিং স্থলে কর্মরত সিনিয়র চিকিৎসক এবং UH & FPO এর সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করবে।
# যেহেতু তোমরা সংখ্যা তে একটু বেশী, হেলথ কমপ্লেক্স এ নিজেরা মোটামুটি জোট করে থাকবে। একে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়বে।উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে পোষ্টিং হলেও হেলথ কমপ্লেক্স এর অন্য ডাক্তার দের সাথে যোগাযোগ রাখবে।
# ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভ দের সাথে দুরত্ব পুর্ন সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। বিশেষ করে নারী ডাক্তার গন কখনোই MR দের বাইকে চড়বে না।সাথে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবে না।এদের দিয়ে ফটোসেশন করানো/বাজার করানো টাইপের কাজ গুলো করাবে না।
# তোমাদের পোষ্টিং হবার সাথে সাথে স্বাস্থ্য প্রশাসন এর উপর চাপ পরবে তোমাদের উপস্থিতি মনিটরিং। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই অফিস সময়ের পরে সচিব /মন্ত্রী ভিজিটে আসে। তাই যেদিন সংশ্লিষ্ট এলাকাতে হাই প্রোফাইল কেউ আসার কথা থাকবে,নিজের উপস্থিতির যথেষ্ট প্রমাণ রাখবে। কষ্ট করে বেশী সময় হাসপাতালে থাকবে। নইলে ক্যাচাং করে শোকজ লেটার ধরিয়ে দেবে।
# অবিবাহিত নারী চিকিৎসক গন।রুগী, রুগীর আত্মীয়,চেয়ারম্যান, মেম্বরদের পুত্র – সবার একটা ডাক্তার মেয়ে বৌ করার স্বপ্ন থাকবে। প্রায় প্রতিদিনই রাস্তাঘাটে প্রচুর বিয়ের প্রস্তাব পাবে।প্রচন্ড রাগ লাগলেও উত্তেজিত হবে না। বিনাইন গুলোকে হেসে উড়িয়ে দেবে আর টক্সিক গুলোর ব্যাপারে UH & FPO কে জানিয়ে রাখবে।পরিবার কে জানাবে।
# জাতীয় দিবস গুলো পালন করা যেহেতু বাধ্যতামূলক।তাই উপজেলার অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে।
# ছেলে মেয়ে উভয় ডাক্তারদের জন্য বলব, চাকুরীর স্থলে যারা পরিবার নিয়ে যাচ্ছ না তারা অবশ্যই ওভার ফোন পরিবারের সঙ্গে চমৎকার কানেকটিভিটি মেইনটেইন করবে ।
# নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু ডরমেটরী/ হাসপাতাল/ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের আয়া, বুয়া, মাসী, সিস্টারদের সাথে শেয়ার করবে না।
# গ্রামে অকারণে কিছু মানুষ পিছু লাগে, হেরাজ করে। এদের থেকে সাবধান।গায়ের রং নিয়ে, চেহারা নিয়ে এমন সব মন্তব্য করবে যা তোমরা জীবনে শোননি। সবথেকে বড় কথা, কথা ফেরী করে সম্পর্ক নষ্ট করে বড় বিপদে ফেলবে।
# প্রচুর চাপ আসবে রুগীকে অকারন টেষ্ট দিতে এবং ফালতু ভিটামিন কৌটা প্রেসক্রাইব করতে।এলাকায় গুন্ডা পান্ডা ইনভলভ থাকে বলে প্রেসার আসে।টেকনিক্যালি হ্যান্ডেল করবে।টেষ্ট না দিলে কাপড় খুলে নেওয়ার হুমকির একটা কেসে আমি হেল্প করেছিলাম।
# সময়ের প্রয়োজনে একটা অত্যন্ত জরুরি বিষয় হলো যাতায়াত। কখনো কোন ভাবেই সন্ধ্যার পর সুনশান এলাকায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠবে না।আমি দু বছর প্রাকটিস করেছি।কখনও রুগীর এত চাপ থাকতো, রাত এগারো টার পর ও বাসায় ফিরেছি। প্রতিটা বাসের দুর্ঘটনা প্রচার হবার পর ঐ সময় টাকে মনে করে আমি পেনিক হই।
# প্রতেকে নিজের নাম সম্বলিত নেইম প্লেট তৈরি করো। অবশ্যই এপ্রন পরবে এবং আই ডি কার্ড তৈরি করবে। আগে প্রচলন না থাকলেও তোমরা আইডি কার্ড এর উদ্যোগ নেবে এবং জনসাধারণের মাঝে প্রচার করবে। এটা ডাক্তারের আইডেন্টিটি।
# ডক্টর রুমে মোবাইল, পার্স রেখে ডিউটি করেছো।ঐ সরল বিশ্বাস এখানে না।দরকারে এপ্রনের ভেতরের দিকে চেইন সম্বলিত পকেট বানাও। নিজের দামী মোবাইল, টাকার পার্স সাবধানে রাখবে। নইলে চুরি হবার পর, বুঝতে পারলেও সিন্ডিকেট বা নিজে টার্গেট হবার ভয়ে চোরকে কিছু বলতে পারবে না।
# ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সবাই কথা বলবে।ঐসব অযাচিত অযৌক্তিক সব কথার কোন উত্তর দেবে না। সুযোগ পেলে বুঝিয়ে বলবে। ওরা অশিক্ষিত। ঝগড়া তে ওদের লেভেলে নামতে পারবে না। তাই ইগনোর। নিজেদের ভালো কাজগুলোর বেশি বেশি প্রচার করবে।
ডাঃ শিরীন সাবিহা তন্বী
৩২ তম শেবাচিম, ২০০০-২০০১সেশন
বরিশাল ।