১…..
বাঘা বাঘা প্রোফেসরদের আন্ডারে সিরিয়াস টাইপের ট্রেনিং শেষ করে সরকারী চাকুরীতে ঢুকলাম। রক্ত তখন বেশ গরম, সরকারী হাসপাতালের আউটডোরে একটার পর একটা রোগী দেখবো আর টপাটপ রোগ ডায়াগনোসিস করে চিকিৎসা দিবো-এইসব হাবিজাবি বিপ্লবী চিন্তায় তখন আমার দিনকাল কাটে….
প্রথম দিন আউটডোরে রোগী দেখা শুরু করলাম। ডায়াবেটিসের রোগী, প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসা লিখছি এমন সময় রোগী বলে উঠলো তার দুই হাঁটুতেও নাকি ব্যথা। লোকের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখি চেহারাটাও কেমন যেন কালচে কালচে….
ডায়াবেটিস+আর্থ্রাইটিস+পিগমেন্টেড চেহারা! মাথায় ঝট করে খেলে গেলোঃ আরেহ! এইটা আবার Haemochromatosis নয়তো! শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অতিরিক্ত আয়রন জমে এ রোগের সৃষ্টি হয়। লিভারটাতো বড় থাকার কথা! পেটে হাত দিয়ে একটু দেখা দরকার….’
৬ নাম্বার রুমটা একটু নিরিবিলি, সেখানে রোগীকে নিয়ে দু’জন ডাক্তার মিলে এক্সামিন শুরু করলাম।লিভারটা আসলেই বড়।Haemochromatosis হবার সম্ভাবনা প্রবল। রোগীর জন্য খবরটা খারাপ, একটা জটিল রোগ ধরা দিচ্ছে, তাই আমি মনে মনে কিছুটা আনন্দিত। আনন্দে আমি যখন দিশেহারা তখন একজন স্টাফ এসে জানালো আউটডোরে রোগীদের দাঁড় করে রাখানোয় তারা ভাঙচুর করবার উপক্রম….
ঘটনা আসলেই খারাপ।মিনিট দশেকের মাঝেই লম্বা লাইন হয়ে গিয়েছে, এর মাঝেই এক পাজী ব্যাটা অন্যদের কাছে ছড়ালো আমরা নাকি ঐ রোগীটিকে টাকার বিনিময়ে ‘স্পেশালভাবে’ দেখে দিচ্ছি।এক পান্ডা চিকিৎসা নেবার সময় নিতম্ব চুলকাতে চুলকাতে সময় থাকতে আমাকে ভালো হয়ে যাবার ফ্রি উপদেশও দিয়ে গেলো….
আউটডোরের প্রথমদিনই আমি প্রমাদ গুণলাম। সময় নিয়ে রোগ ডায়াগনোসিস করে লাইনে দাঁড়ানো পাবলিকের হাতে মাইর খাবার মত আতলামি এখন আর তেমন করি না।বিপ্লবী চিন্তাভাবনায় ক্ষ্যামা দিলাম। আমার রক্ত এখন অনেকটাই ঠান্ডা….
২….
রক্ত কিভাবে পুরোটা ঠান্ডা হলো সে গল্পটা বলি….
মহিলা এক রোগী আসলেন, ভয়াবহভাবে ওজন কমে যাচ্ছে, সাথে জ্বর-কাশি, বসা থেকে উঠতে গেলে মাথাও নাকি ঘোরে। আমার Suspicion ছিলো ফুসফুসে যক্ষা, সে যক্ষা থেকে Addison নামে আরেক ডিজিজ। এধরণের রোগীকে বেড সাইডে বিশেষভাবে প্রেসার মেপে দেখতে হয়। তখনও ব্যাগে BP মেশিন রাখতাম, প্রেসার মাপতে গেলাম….
এমন সময় রুমের বাইরে লাইনে দাঁড়ানো এক পুরুষ রোগী কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলোঃ “এতক্ষণ ধইরা এক রোগী হাতাইলে হইবো?”
তার পেছনে কোন একজন এরসাথেই বলে উঠলোঃ “মাইয়্যা রোগী পাইছেতো, হেই কারণে এতক্ষণ দেহে….”
এর প্রত্যুত্তরে আমার আর কিছু বলার রুচি হয় নাই। তবে আমি সিস্টেমের সাথে নিজেকে এডপ্ট করলাম, আমি এখন বেশ দ্রুত রোগী দেখি, ইন ফ্যাক্ট, আমাকে এখন দ্রুত রোগী দেখতে হয়….
৩….
তখন হাসপাতালে চিকিৎসকের ভালো ক্রাইসিস যাচ্ছে, একটার পর একটা অর্ডারে একেকজন চিকিৎসক ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চলে যাচ্ছে। আমি আর আমার এক সিনিয়র কলিগ মিলে আউটডোর সামাল দেই….
গরমের সময়টায় এদিকটায় প্রচুর রোগী হয়।কিভাবে এতো রোগী সামাল দিবো সেটা চিন্তা করতে করতে একটু আর্লি রুমে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত কান্ড দেখলাম। সিনিয়র কলিগ একটার পর একটা কাগজে ওষুধ লিখে সাইন দিয়ে রাখছে। বিষয়টা কি জানতে চাইলাম….
উনি বললেনঃ ‘দেখো, আউটডোরে ৫০ ভাগ রোগী আসে খালি ওষুধ নিতে। আসলে এদের কোন অসুখ নাই। যদি বলে মাথা ব্যথা, তাইলে বুঝবা প্যারাসিটামল চায়। যদি বলে ঠান্ডা, তাইলে বুঝবা হিস্টাসিন চায়।বুকে জ্বালাপোড়া মানে গ্যাস্ট্রিক এর ওষুধ দিতে হইবো, জ্বর বললে বুঝবা টেট্রাসাইক্লিন। কাজেই এদের পেছনে সময় নষ্ট করবানা, রুমে ঢুকবো আর ফ্রি ওষুধের কাগজ নিয়া এরা বাইর হইয়া যাইবো….’
আমি কিছুটা ইতঃস্তত করে বললাম, ‘রোগ না থাকলে ওষুধ নিবে কেন?’
উনি বললেনঃ’ এরা এমনই, তুমি একটু নতুন, কয়দিন পর এইটা বুইঝা যাইবা। সরকারী ফ্রি ওষুধরে এরা নিজের সম্পত্তি মনে করে, বাসায় নিয়া জমা করে, মাঝে মাঝে এমনি এমনি খায়। জানো তো-ফ্রি পাইলে বাঙালি আলকাতরাও খায়….’
প্রান্তীয় অঞ্চলে তিন বছরের বেশী কাটিয়ে ফেললাম। কলিগও ট্রান্সফার হয়ে গেছেন, তবে সিনিয়র সেই কলিগের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আউটডোরে একটা বড় অংশ শুধুমাত্র ফ্রি ওষুধের জন্য আসে, এদের জন্য সময় নষ্ট করা বোকামী….
৪….
উপরের তিনটি অংশ তো পড়লেন। সামারাইজ করেন তো দেখি?….
আচ্ছা আমি করে দেইঃ প্রতিদিন সরকারী হাসপাতালে শত শত রোগী, যারা অত্যন্ত অধৈর্য, যাদের অর্ধেকেরই আসলে তেমন কোন রোগ নেই, যারা আসে মূলত শুধু সরকারী ফ্রি ওষুধ নিতে। এ সমস্যাগুলোকে প্রতিনিয়ত সামাল দিয়ে যেতে হয় প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অল্প সংখ্যক চিকিৎসককে….
সমস্যা তো শুনলেন। সমাধানটা কি?
কতগুলো হাইপোথেটিক্যাল সমাধান আছে।যেমন, চিকিৎসক প্রতি ২০ জন রোগী নির্ধারণ করে দেয়া, এর বেশী টিকিট দেয়া হবে না। যে অর্ধেক আসে শুধু ওষুধ নেবার জন্য, তাদের নিরুৎসাহিত করা, এরা যাতে চিকিৎসকের কাছে এসে তার মূল্যবান সময় নষ্ট না করে। উপযুক্ত সিকিউরিটি সিস্টেম গড়ে তোলা, আমি যখন ধীরেসুস্থে ঠান্ডা মাথায় রোগী দেখবো, তখন এরা মাস পিপলকে কন্ট্রোল করবে….
এদেশের সিস্টেম এগুলোর কোনটাই করবে না। কিন্তু এদেশের সিস্টেম চিকিৎসকের মাথায় কাঁঠালটা ঠিকই ভাঙবে….
আপনি যদি বোকা না হয়ে থাকেন তবে উপরের সমস্যাগুলোর লজিক্যাল সমাধান আপাতত একটাইঃ আউটডোরে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে স্বল্প সময়ে রোগী দেখা শেষ করা….
৫….
যে সমস্যা ও তার সমাধান আমি প্লট করলাম সেই একই কথা ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে সংখ্যাবাচক টার্মে উল্লেখ করা হয়েছে–
‘বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা প্রাইমারি কেয়ার সেটিংয়ে রোগীপ্রতি ৪৮ সেকেন্ড সময় ব্যয় করেন… স্বাস্থ্যখাতে নিম্ন বাজেট এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ….’
আমাদের দেশের সাংবাদিকরা British Medical Journal(BMJ) এর তথ্যটা প্রচার করলেন, হেডলাইন করলেন, ‘রোগী প্রতি চিকিৎসকের সময় মাত্র ৪৮ সেকেন্ড’। এক বেসরকারী টিভি চ্যানেল আরো এক ধাপ এগিয়ে এলো, তারা গোপন ভিডিও সহ ৪৮ সেকেন্ড ইস্যুটি প্রমাণ করার চেষ্টা করলো….
BMJ এর দ্বিতীয় অংশটি সাংবাদিকরা উপেক্ষা করলেন, কেন চিকিৎসক ৪৮ সেকেন্ডে রোগী দেখতে বাধ্য হচ্ছেন -সেটা তারা বেমালুম চেপে গেলেন…..
৬….
একটি অপরিচিত লোকের সাথে আমি যখন প্রথমদিকে পরিচিত হই তখন আমি সেই লোকটির সাথে সাইকোলজিক্যাল খুব কমন একটা গেইম খেলি। গেইমটা আপনাদের বলি…
একটা গ্লাসপূর্ণ পানির (কিংবা পানিপূর্ণ বোতল)অর্ধেকটা খেয়ে তার সামনে রেখে সেটাকে বর্ণনা করতে বলি। অধিকাংশ লোকই বলেন যে গ্লাসের অর্ধেকটা পানিপূর্ণ। এরা আশাবাদী লোক, এরা দেশের উন্নতিতে অবদান রাখে। একটা ক্ষুদ্র অংশ বলে যে গ্লাসের অর্ধেকটা খালি। এরা হতাশাবাদী নেগেটিভ অ্যাটিচুড এর লোক, এরা দেশের জন্য অকল্যাণকর….
BMJ এ যে খবরটি বেরিয়েছে সেটাকে রিপোর্টাররা দু’ভাবে প্রকাশ করতে পারেন:
ক) এ কি করলেন বাংলাদেশী ডাক্তাররা! প্রতি রোগীর পেছনে এরা সময় দেন মাত্র ৪৮ সেকেন্ড! (অনলাইন পত্রিকা হলে গোপন ভিডিওর লিঙ্ক সহ)…… (এটি নেগেটিভ অ্যাটিচুড)
খ) চিকিৎসক সংকটে মাত্র ৪৮ সেকেন্ডে একজন রোগী দেখতে বাধ্য হচ্ছেন ডাক্তাররা, প্রয়োজন স্বাস্থ্যখাতে বাজেট ও জনবল বৃদ্ধি….(এটি পজিটিভ অ্যাটিচুড)
আপনাদের কাছেই প্রশ্ন রাখছিঃ কোন সংবাদটি বেশী বস্তুনিষ্ঠ হতো? কোন খবরটি একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে এগিয়ে নিয়ে যেতো?
আফসোস! মিডিয়ায় নেগেটিভ অ্যাটিচুডটি প্রকাশ পেয়েছে। এদেশের স্বাস্থ্যখাতকে সুকৌশলে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।খবরটি যারা প্রকাশ করেছেন তারা ভুলে গেছেন এটা কিউবার স্বাস্থ্যসেবা না যেখানে ১৫০ জনে ১ জন চিকিৎসক থাকেন, এটা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা, যেখানে প্রায় ৪০০০ জনে ১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। রিপোর্টাররা ভুলে গেছেন ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি দেশের GDP এর যে অংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করতে হয়, বাংলাদেশ তার ধারে কাছেও নেই….
যারা নেগেটিভ ওয়েতে খবরটি প্রকাশ করেছেন, তারা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করলে খবরটি অন্যভাবে, পজিটিভ ওয়েতে প্রকাশিত হতো। আমাদের নীতিনির্ধারকরা সচেতন হতেন, চিকিৎসক সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হতো, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি করে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হতো, দেশের মানুষ উপকৃত হতো, একটা সাইলেন্ট রেভ্যুলুশান হতো। সেটা করা হয়নি। খবরটি প্রকাশ করার সময় জলের উপরে ছোটাছুটি করা হয়েছে, জলকে স্পর্শ করা হয়নি, সত্যের অবগুণ্ঠনও তাই উন্মোচিত হয় নি…..
৭…
একটি সত্য কথা বলি। কোন চিকিৎসকই তার রোগীকে তাড়াহুড়ো করে দেখতে চান না।প্রতিটি চিকিৎসক তার রোগীর কথা শুনতে চান, মর্মবেদনা উপলদ্ধি করতে চান। প্রতিটি চিকিৎসক রোগীকে সাহস দিতে চান, রোগীর কাঁধে হাত রেখে বলতে চানঃ কেন এত চিন্তা করছেন? আপনাকে ভালো করার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাবো, বিশ্বাস রাখুন, আস্থা রাখুন, ম্যায় হু না…
অথচ এদেশের সিস্টেম আমাদের মানবিক হতে দেয় না। এদেশের সিস্টেম আমাদের ৪৮ সেকেন্ডে রোগীকে দেখতে বাধ্য করে। সেটাকে পুজি করে আমাদেরই আবার আক্রমণ করা হয়, জনতার কাঠগঁড়ায় দাড় করানো হয়।
‘৪৮ সেকেন্ডে রোগী দেখা হয়’– সেটি প্রচার করে আমাদের ভিলেন বানানো হয়, কেন ৪৮ সেকেন্ডে রোগী দেখতে হয়-সে কথা কখনও প্রকাশ করা হয় না। সত্য নাই বা প্রকাশিত হোক।প্রিয় বাংলা, তবু তুমি ভালো থেকো, কলঙ্ক না হয় তুমি আমার গায়েই মেখো..
……………
লিখেছেনঃ
ডা.জামান অ্যালেক্স ।