৪৮ সেকেন্ডে রোগী দেখা, বিভ্রান্তি ও করনীয়

download (1)

 

 

ভারতে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হয়, কৌন বানেগা ক্রোড়পতি। সে অনুষ্ঠানে সঞ্চালক অমিতাভ বচ্চন অংশগ্রহনকারীকে কিছু প্রশ্ন করেন এবং ৪টি করে অপশন দেন। সঠিক উত্তর দাতা কোটি টাকা পর্যন্ত পেতে পারেন। উত্তর না জানা থাকলে আবার কিছু লাইফ লাইন নেয়া যায় তার একটি হচ্ছে  “phone a friend”।

CaEYg

তো সেই লাইফ লাইনে অংশগ্রহনকারীকে তার পছন্দের একজনকে ফোন করার সুযোগ দেয়া হয়, সংযোগ হবার পর ৩০ সেকেন্ডের মাঝে তাকে প্রশ্ন ও ৪টি অপশন পড়ে শুনিয়ে উত্তর জেনে নেবার সুযোগ দেয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় এই ৩০ সেকেন্ডের মাঝে প্রশ্ন এবং ৪টি অপশন ভালো করে পড়ে শোনানোর সুযোগই পাওয়া যায়না, অন্যপাশ থেকে উত্তর আসতে আসতে সময় শেষ।

 

আজ প্রথম আলো পত্রিকায় একটি খবর এসেছে বাংলাদেশে চিকিৎসকেরা নাকি গড়ে ৪৮ সেকেন্ড সময় দেন রোগী দেখার জন্য। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধের বরাত দিয়ে কথাটি বলা হয়েছে। তো যেহেতু গড়ে ৪৮ সেকেন্ড বলা হয়েছে সুতরাং ধারনা করা যায় ৪৮ সেকেন্ড এর কম সময়ে রোগী দেখার ঘটনাও আছে। আর সেটাই বেশি হতে হবে কেননা আপনারা নিজেরাই চিন্তা করে দেখুন ডাক্তার দেখানোর অভিজ্ঞতা থেকে, ডাক্তার আপনাকে কত মিনিট সময় দিয়েছেন। একেবারে কম হলেও মিনিট খানেক এর কম তো নয়। অধিকাংশের অভিজ্ঞতাই এমন। তাহলে গড়ে ৪৮ সেকেন্ড আসতে হলে ৪৮ সেকেন্ডের অনেক কমে রোগী দেখা হয়েছে এমন অনেক ঘটনাও থাকতে হবে।

48

 

৩০ সেকেন্ড, ২০ সেকন্ড, ১০ সেকেন্ড ইত্যাদি! এবার আপনিই চিন্তা করে দেখুন যেখানে ৩০ সেকেন্ডে ১টি প্রশ্ন করে তারই উত্তর পাওয়া যায়না সেখানে একজন রোগী তার সমস্যা বলে, ডাক্তারকে সামনাসামনি কিছু পরীক্ষা করার সুযোগ দিয়ে, প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ করা পর্যন্ত এত কিছু কি করে ৪৮ সেকেন্ড বা তার কম সময়ে সম্ভব?  ভেবে দেখুন তো !

 

 

যে সাময়িকের বরাত দিয়ে খবরটি তৈরি করা হয়েছে চলুন দেখে আসি সেই মুল লেখায় আসলে কি বলা হয়েছে।

লিংকঃ http://bit.ly/2je4u9E

এই লেখায় দেখা যাচ্ছে মূলত হিসাব করেছে প্রাইমারি কেয়ার কনসালটেশন অর্থাৎ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যারা দেয় যেমন জেনারেল প্র্যাকটিশনার কিংবা প্রাইমারি কেয়ার হাসপাতাল (যেমন উপজেলা বা ইউনিয়ন বা কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান) ইত্যাদি। এসব যায়গায় রেজিস্টার্ড ডাক্তার থেকে শুরু করে মেডিকেল এসিস্টেন্ট, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার অনেকেই আছেন। সবাই ডাক্তার নন।

যারা সাময়িকীটি প্রকাশ করেছেন ধরে নেওয়া হচ্ছে, তারা নতুন কোন তথ্য সংগ্রহ করেনি এবং তারা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত যে ১১১টি আর্টিকেল থেকে ডাটা সংগ্রহ করে সেগুলোর এনালাইসিস করেছে (মেটা এনালাইসিস)। এ ধরনের ডাটা সব সময়েই বায়াসড হতে পারে কেননা ঐ ১১১টি গবেষণায় কোনটায় কিভাবে ডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেটি আমাদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে কিনা এই ব্যাপারগুলোতে প্রশ্ন থেকেই যায়।

গবেষণা প্রবন্ধটির সিমাবদ্ধ আলোচনায় এসব কথা উঠে এসেছে অনেক দেশি বিদেশী বিশেষজ্ঞের কাছ থেকেই। বাংলাদেশের যে ডাটা নিয়েছে সেটা ১৯৯৪ সালের যার মান লেখা আছে “ফেয়ার”। অবশ্য ২০১২ আর ২০১৫ এর ডাটাও আছে টেবিলে। কিন্তু স্যাম্পল সাইজ কম। সেখানে কমপক্ষে সময় দেওয়া আছে ২ মিনিট আর ৩ দশমিক ৮ মিনিট। বাকিগুলো ১৯৯৪ এর আগের। এখন মেটা আনালাইসিসে পুল করার ফলে বেশি স্যাম্পলের দিকেই রেজাল্ট গেছে।

 

অস্বীকার করছিনা এদেশে চিকিৎসকগণ রোগীদের আদর্শ সময় (বিভিন্ন আলোচনা ও প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে আদর্শ সময় মোটামুটি ১৫ মিনিট এর আশে পাশে ধরা হয়) এর চেয়ে কম সময় দেন। কেন কম সময় দেন বা দিতে বাধ্য হন সেই দিকটা আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
আলোচিত পাবলিকেশনেই উঠে এসেছে যে এই কনসালটেশন টাইম প্রতি ১০০০ রোগীতে ডাক্তারের অনুপাত, স্বাস্থ্য খাতে দেশের বিনিয়োগ, ডাক্তারের “বার্ন আউট” ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। অনুপাতের ব্যাপারে যদি আসি তাহলে বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি হাজার রোগীতে ডাক্তারের সংখ্যা দশমিক ৩৮৯, অর্থাৎ এক জনের ও কম, আর সহজভাবে বললে প্রতি ৩৮৯০ জন রোগীতে একজন মাত্র ডাক্তার বাংলাদেশে যেখানে Sustainable Development Goal অর্জনের জন্য আদর্শ ধরা হয়েছে প্রতি হাজার লোকে ৫.৯ জন কে।  এদেশে গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট তথা জিডিপির মাত্র ২.৮% ইনভেস্ট করা হয় স্বাস্থ্যখাতে যেখানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নূন্যতম পরামর্শ ৫%। আর বার্নআউট এর কথাটি নতুন লাগবে অনেকের কাছে। এর অর্থ হচ্ছে কাজের চাপে পিস্ট হয়ে দক্ষতা কমে যাওয়া।

 

সত্যিকার অর্থেই, এত কম রিসোর্স নিয়ে, এত বেশি রোগী নিয়ে, এত বেশি সময় ও চাপ নিয়ে দ্বায়িত্ব পালন করে এদেশে ডাক্তারগণ “বার্ন আউট” হয়ে যাচ্ছেন, শারিরীক ও মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন ফলে ডাক্তার, রোগী, দেশ সবাই ভুক্তভোগী হচ্ছে। আমাদের সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে একজন ডাক্তারকে গড়ে আনুমানিক প্রায় ১০০ রোগী দেখতে হয় ২-৩ ঘণ্টার মাঝে। তাহলে হিসাব করুন আসলে সময় কতটা দিতে পারে।

 
iStock_000024029755Small-760x505-1

 

 

একই ডাক্তারকে বহির্বিভাগ, অন্তঃবিভাগ, জরুরিবিভাগ সবই একই সাথে সামলাতে হয় জেলা উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ হাসপাতালে।

সুতরাং করনীয় কি? করনীয় একটাই, সরকারকে আরো বেশি ডাক্তার ও সহকারী (যেমন একজন ডাক্তারের সাথে সাড়ে ৩জন নার্স এবং অন্যান্য অতিরিক্ত সহকারি থাকার কথা যেখানে বাংলাদেশে প্রতি ২.৫ জন ডাক্তারে একজন নার্স আছে। আর সহকারি হিসেবে  যেমন ওয়ার্ড বয়, আয়া, সুইপার, চিকিৎসা সহকারী এদের কথা তো বাদই দিলাম, এদের সংখ্যা এতই কম যে হাসপাতালে  এরাও যে কর্মরত আছেন থাকে সেটা বোঝা দায় ) নিয়োগ দিতে হবে তবে কোনভাবেই মান কমিয়ে নয় বরং মান সম্পন্ন উপায়ে।

 

নাম সর্বস্ব অলি গলির মেডিকেলের কলেজ ও নার্সিং ইন্সটিটিউট দিয়ে নয় বরং কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমে। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে আরো অনেক বেশি, এটাকে খরুচে খাত না ভেবে বরং আয় খাত ভাবতে হবে কেননা সুস্থ মানুষই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চাবিকাঠি।

হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা দানকারি ডাক্তার, নার্সসহ সকলের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে যেন অতিরিক্ত কাজের চাপে তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনমন এবং সে কারনে কাজের দক্ষতা কমে না যায়। সপ্তাহে ৪০ ঘন্টার বেশি কর্মঘন্টা নিষিদ্ধ করতে হবে। তবেই এইসব নেতিবাচকতা কাঠিয়ে ওঠা সম্ভব।

 

 

লেখক ঃ ডাঃ মারুফুর রহমান আপু, Medical Officer- Center for Medical Biotechnology, DGHS

Ishrat Jahan Mouri

Institution : University dental college Working as feature writer bdnews24.com Memeber at DOridro charity foundation

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে প্রচারাভিজান অনুষ্ঠিত

Sun Nov 12 , 2017
“বাংলাদেশ মেডিকেল স্টুডেন্টস সোসাইটি” ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখার উদ্যোগে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হলো বিশেষ প্রচারাভিযান । এই প্রচারাভিযানটি সকাল ৬টা থেকে ৭.৩০ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। প্রচারাভিযানে প্রায় ১০০ জন লোক রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করেছেন ও এলসি টিম তাদের রক্তচাপ পরীক্ষা করেছে ও ওজন নির্ণয় করেছেন । পরে তারা […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo