রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটে ৮ টি ইউনিয়ন নিয়ে গড়া আদিতমারী উপজেলা। উপজেলায় ২৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও ৮ ইউনিয়নের মানুষের প্রধান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু জনবল সংকটে আদিতমারী উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবার মান লেখচিত্রে নিম্নমুখী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আজ রবিবার আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে এমন দৃশ্য।
উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মানুষের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে ২০২২ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। সেই অনুপাতে ভবনও নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ৩১ শয্যারও কম জনবল দিয়ে চালিয়ে নিতে হচ্ছে সকল কার্যক্রম। এজন্য রোগীদের সঠিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের। ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে উন্নীতকরণ করা হলেও সেবার মান এখনো সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদেরও। নানান সংকটের মধ্যে দিয়ে চলছে এ হাসপাতালের কার্যক্রম।
দেখা গেছে, চিকিৎসকসহ নিম্ন জনবল সংকটে চালানো হচ্ছে হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম। এখানে উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার সামান্য কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ওষুধ থাকলেও সেসবের সুবিধা তেমন পান না রোগীরা। এ উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন গড়ে ৪০০-৫৫০ জন অসুস্থ মানুষ। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেই নিত্য দিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার ল্যাব টেকনিশিয়ান
নথি অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালে সব মিলিয়ে ৩১ জন চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু আদিতমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন মাত্র ১০ জন চিকিৎসক। ২১ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য! তবে মঞ্জুরীকৃত রাজস্বের নথি অনুযায়ী হাসপাতালে চিকিৎসকের সৃজনকৃত পদসংখ্যা ২৮ টি! একই দৃশ্য দেখা গেছে অন্যান্য জনবলের ক্ষেত্রেও। ৩১ জন নার্সের স্থলে ৩০ জন পদায়িত থাকলেও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারিদের মধ্যে আছে সংকট। মোট ৩৭ টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ২১ জন, শূণ্য পদ ১৬ টি।
জনবলের মতো ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের অবস্থাও বেহাল! স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বরাদ্দকৃত ইসিজি মেশিনের ২টির মধ্যে ১ টি অচল, বায়োকেমিস্ট্রি এনালাইজারের মধ্যে ১টি সচল ও একটি অচল, ২টি মাইক্রোস্কোপের মধ্যে ১টি অচল, ৪টি অটোক্লেভ মেশিনের মধ্যে ১টি অচল! তবে বরাদ্দকৃত ১টি এক্স-রে মেশিন, ১টি ভেন্টিলেটর ও ২টি আল্ট্রাসনোগ্রাম সচল আছে। হাসপাতালের ২টি এ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি অচল অবস্থায় আছে। তবে জনবলের অভাবে বেশিরভাগ যন্ত্রই ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, হাসপাতালে পুরুষ রোগী থেকে নারী রোগীর সংখ্যা তুলনামূলভাবে বেশি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন অনেক মুমূর্ষু রোগী। অপরদিকে জনবল সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। রোগী অনুপাতে চিকিৎসক স্বল্পতা, ওষুধ সংকট ও খাবার সরবরাহে তেমন সন্তোষজনক সেবা পাচ্ছেন না চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা। এছাড়াও সুইপার সংকট উল্লেখযোগ্য অসুবিধা গুলোর মধ্যে অন্যতম । এ কারনেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা আবর্জনা। রোগীদের অভিযোগ, রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি তেমন না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের ক্লিনিকে তাদেরকে যেতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় রোগীদের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
সেবা নিতে আসা রোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধের বরাদ্দ কম, বেশিরভাগ ইনভেস্টিগেশন করতে হয় বাইরের কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে, খাবারের মানও খুব একটা ভালো না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন কর্মচারী জানান, ভর্তি রোগীদের সবাইকে খাবার দিতে হয়। রোগী বেশি ভর্তি থাকায় খাবারের মান কমে যায়। সব ওষুধের সাপ্লাই থাকে না, তা রোগীরা বুঝতে চায় না!
আদিতমারীর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোঃ সানাউল বলেন, ‘চিকিৎসকসহ নিম্ন জনবল সংকটে চলছে হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন শত শত মানুষ। রোগী অনুপাতে চিকিৎসক স্বল্পতা ও ওষুধ সংকট রয়েছে এখানে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাব। বর্তমানে এখানকার খাবারের মান যথেষ্ট ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমানে অন্যতম সমস্যা হলো সুইপার সংকট। যার কারণে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের একটু সমস্যা হচ্ছে। এ সমস্যাগুলো সমাধান হলে, স্বাস্থ্য সেবার মান আরো ভালো হবে।’
আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মোঃ আজমল হক বলেন, ‘বর্তমানে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা সেবা চিকিৎসক ও জনবল সংকটের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। ভালো সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকেরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। জনবলের চাহিদাসহ আরো বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি সাময়িক সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে।’
উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালে হাসপাতালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে ডা. তৌফিক আহমেদ যোগদানের পর চিকিৎসাসেবা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ফিরে এসেছিল। সেসময়ে হাসপাতালটি সারাদেশের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে ৩৬তম ও রংপুর বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে জায়গা করে নিয়েছিল। ১৮ বছর ধরে অকেজো পড়ে থাকা এক্সরে মেশিন সংস্কার, জেনারেটর সার্ভিস, হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রোগীদের উন্নতমানের খাবার সরবরাহসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রম বেশ চমৎকারভাবে চালানো হয়েছিল। কিন্তু তার বদলি পরবর্তী সময়ে আবারও সংকট আরম্ভ হয়।
প্ল্যাটফর্ম প্রতিবেদকঃ মঈন উদ্দীন আহমদ শিবলী।