লেখকঃ ডাঃ মোঃ মারুফুর রহমান, ৩৩তম বিসিএস(স্বাস্থ্য ক্যাডার)
বাংলাদেশে এর আগে কখনো এত ডাক্তার একসাথে চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। এই বিপুল সংখ্যক ডাক্তার পুরো বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়বেন এক মাসের মধ্যেই। দূর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভিত হয়ে দাড়াবেন এরাই। কিন্তু……
৩৩তম বিসিএস এর শুরু থেকেই ফেসবুকে এই সংক্রান্ত অনেক গ্রুপ তৈরী হয়েছে দেখেছি। একে অন্যকে সবাই খুব দারুনভাবে সাহায্য করেছেন। তবে এর মধ্যে একটি ভয়াবহ ব্যাপার ঘটেছে যেটা অনেকেরই হয়ত চোখে পড়েনি। পুলিশ ভেরিফিকেশন, এনএসআই ভেরিফিকেশন শুরু হবার পর সবাই খবর দিয়েছেন কি কি কাগজ লেগেছে, কি জিজ্ঞেস করেছে এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ন কোন ঘুষ দিতে হয়েছে কিনা! দেখা গেছে অনেকেই আগে থেকে প্যাকেট রেডি রেখেছেন, না চাইতেও দিয়ে দিয়েছেন, দিয়ে আবার ফেসবুক স্ট্যাটাসে কিংবা গ্রুপে শেয়ার দিয়েছেন অমুককে খুশি করার জন্য এত টাকা দিলাম, দিয়ে আবার গালি দিয়েছেন ঘুষ নেয়া ব্যাক্তিকে। এভাবে টাকাপয়সা লেনদেন এর কথাগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলে যে এটাই ট্রেন্ড হয়ে যায় এবং সবাই নিজ দায়িত্বে ভেরিফিকেশন এর কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তার ফোন নাম্বার খুজে বের করে তার হাতে টাকা দিয়ে আসা শুরু করে এবং দিনে দিনে সেই পরিমানটা বাড়তে থাকে। যারা এই কাজটি করেছেন তাদের কাছে প্রশ্ন ঘুষ দাতা এবং গ্রহীতা যে সমান অপরাধী সেটা কি আপনারা জানতেন না? এই ক্ষেত্রে ঘুষ দাতার অপরাধ আরো অনেক বেশি, কারন তারা সুযোগ দিচ্ছেন এবং সেটাকে অলিখিত নিয়মে পরিনত করছেন। কি হত যদি আমরা এই ৬হাজার ক্যাডার যদি একটা পয়সাও ঘুষ না দিতাম, সব আটকে থাকত? আমাদের নিয়োগ হত না? চিন্তা করে দেখুন এটা বাস্তবে সম্ভব কিনা। একজন দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যে কাজের জন্য দ্বায়িত্ব পেয়েছেন সেটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে শেষ করতেই হবে, আপনি ঘুষ দেন আর না দেন। কিন্তু আমরা যে ট্রেন্ড শুরু করে দিলাম এর ফলাফল কি ভবিষ্যতেও চলতেই থাকবে না? একবার চিন্তা করে দেখুন, ধরি গড়ে ২ হাজার টাকা করে বিভিন্ন যায়গায় ঘুষ দিয়েছেন তাহলে ৬ হাজার ডাক্তার ঘুষের পিছনে খরচ করেছে প্রায় ১কোটি ২০ লক্ষ টাকা!
গেজেট হবার পর এখন সবার চিন্তা কোথায় পোস্টিং হবে এটা নিয়ে। এরজন্যেও দেন দরবার শুরু করে দিয়েছেন অনেকে। কার কাছে তেল ঢালতে হবে, কার কাছে টাকা ঢালতে হবে, ঘুষের চলতি রেট কত ইত্যাদি খোজ নিয়ে ফেলেছেন অনেকেই। হয়ত এবারো সবাই কাজগুলো করে এসে নাম ধাম ফোন নাম্বার সহ টাকার পরিমান জানিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ফেসবুক গ্রুপে শেয়ার করে মনে করবেন মানুষের বিরাট বড় উপকার করে ফেললাম! নিসন্দেহে অংকটা এবার ২ হাজারের চেয়েও অনেক বেশি হবে। একটু চিন্তা করুন, আমরা যদি এই কাজটা না করি, দেন দরবার না করি তাহলে কি হবে, আমার কাংখিত জায়গায় হত পোস্টিং মিলবে না, হবে অন্য কোন জেলায়, অন্য কোন গ্রামে। যাওয়ার পথটা হয়ত ভিন্ন হবে কিন্তু মানুষগুলো কি আলাদা হবে? রোগ বালাই কি আলাদা হবে? আপনার দ্বায়িত্ব কি আলাদা হবে? ২ বছর তো গ্রামে থাকতেই হবে, একটু কস্ট করে এই দরিদ্র মানুষগুলোকে কি সেবা দিলে খুব বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে আমাদের? আমরা যদি এই ঘুষের, দেন দরবারের ট্রেডিশনটা ধ্বংস করে দিতে পারি তাতে কি আমদেরই লাভ হবে না? ৬ হাজারী একশন পটেনশিয়ালের কথা বলছি। আমরা যদি একত্র থাকি নিজেরদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে সিদ্ধান্তে অটল থাকি, পুরো বাংলাদেশ এর স্বাস্থ্যব্যস্থার সব দূর্নীতি কি আমরাদের একটি হুংকারেই উঠে আসবে না? অনেকে ভাববেন নিজে বাচলে বাপের নাম, আগে নিজের “ভালো যায়গায়” পোস্টিং নিয়ে নেই “সিস্টেম” করে, পরেরটা পরে দেখা যাবে। এভাবে যদি শুধু নিজের জন্যেই ভাবেন, আল্লাহ না করুন ভবিষ্যতে যদি মুরাদ ভাই কিংবা সাজিয়া আপার মত কোন ঘটনা আপনার ক্ষেত্রে হয় আপনার বিচারের জন্য কেউ দাঁড়াবে কিনা চিন্তা করে দেখুন তো?
এগুলো গেল পোস্টিং এর পূর্ববর্তী অবস্থা, পরের অবস্থা চিন্তা করুন। সারা বাংলাদেশে পেরিফেরিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্রটি কেমন তার ধারনা হয়ত পেয়ে গেছেন। অনেক ক্ষত আছে, অনেক সমস্যা আছে কিন্তু এগুলো চাইলেই সমাধান করা সম্ভব। ঐ যে বললাম ছয় হাজারী একশন পটেনশিয়াল। আমরা ৬হাজার যদি চিৎকার করে বলে উঠি আমরা গাড়ি চাইনা আমার বসার যায়গাটা ঠিক করে দিন, আমার থাকার একটা যায়গা দিন, আমাকে সাহায্য করার জন্য উপযুক্ত লোকবল দিন তাতে কি মন্ত্রনালয় প্রকম্পিত হবে না? নিয়োগের পর যদি অমুক জেলার তমুক উপজেলার তমুক সাব সেন্টারে আমাদেরই কোন কলিগ বিপদে পড়ে, লাঞ্চিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমরা যোগাযোগ অক্ষুন্ন রেখে যদি পরদিনই সারা দেশে একযোগে প্রতিবাদ করি তাতে কি সব অন্যায় খড় কুটোর মত উড়ে যাবে না? এরপর কেউ কি আমাদের অপমানিত করার, ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ পাবে?
একটু চিন্তা করে দেখুন, ঠিক কতটা শক্তি আমাদের আছে, যদি আমরা একত্রিত থাকতে পারি, যদি নিজের বিবেক একসাথে জাগ্রত রাখতে পারি, যদি ছোট ছোট অন্যায় গুলোকে প্রশ্রয় না দিতে পারি।
প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিসিএস ডাক্তারদের একটি তালিকা তৈরি করা হবে খুব শীঘ্রই, আশা করি তাতে নিজে থেকে রেজিস্ট্রেশন করে সমৃদ্ধ করবেন, সবাই একতাবদ্ধ হবেন। পরিবর্তনের শুরুটা হোক আমাদের হাত ধরেই।
33rd bcs health cadre
খুবই ভালো পদক্ষেপ।সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে,যদিও এটা অনেক কঠিন কাজ।