ঘটনাস্থল নোমেক ইমার্জেন্সী এবং শিশু ওয়ার্ড।
সময় রাত পৌনে আটটা ।
ইমার্জেন্সীতে আট বছরের এক শিশু ভর্তি হল ।অবস্থা মূমুর্ষু ।অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক (OPC) খেয়ে এসেছে ।একঘন্টা পার হয়ে গেছে আনতে ।সাথে শুধু বাচ্চার মা আর মামা ।ইমার্জেন্সীতে ডিউটি ডাক্তার যত দ্রুত সম্ভব রোগীর Resuscitation এর ব্যবস্থা করলেন । প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট দিয়ে নিচতলা দেখে দোতলায় শিশু ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিলেন অক্সিজেন দেয়ার জন্য । লাভ হলোনা ।বাচ্চাটা এরমধ্যেই মারা গেলো ।শিশু ওয়ার্ডে তখন ছিলেন আমাদের নোমেক প্রথম ব্যাচের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ভাইয়াদের একজন ।ভাইয়া অক্সিজেন দিতে গিয়ে দেখলেন রোগী ততক্ষণে এক্সপায়ার্ড (এই শব্দটা আমরা roughly অন্যভাবে ব্যবহার করলেও সব ডাক্তাররা রোগীর মৃত্যুকে সমবেদনার সাথে প্রকাশ করতে এটা ব্যবহার করেন ।) ভাইয়া অক্সিজেন দিতে গিয়ে তাই না দিয়ে চলে এলেন রোগীর ডেথ ডিক্লেয়ারেশন সার্টিফিকেট লিখতে ।বিধি বাম ।হঠাৎ এক সাংবাদিক কোত্থেকে আসলো আল্লাহ মালুম ,সে দেখলো ভাইয়া অক্সিজেন না দিয়ে চলে গেছে ,রোগী মৃত ।শুরু হয়ে গেলো তাদের বেলেল্লাপনা ।রোগীর এটেন্ডেন্টকে লেলিয়ে দেয়া শুরু করলো যে ইন্টার্ন ডাক্তার অক্সিজেন দিতে পারে না ।তাই অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে ।এরমধ্যে পেডিয়াট্রিক্স ডিপার্টমেন্ট হেড ম্যাডাম রাত আটটায় ইন্টার্ন ডক্টরদের ফলো আপ করতে আসলেন ।ম্যাডাম নিজেই ডেথ সার্টিফিকেট লিখছিলেন ।হঠাৎ করেই আকাশ থেকে টুপ করে পড়ার মতো দৈবভাবে ৪০-৫০জন হাজির ।এসেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি ।লেখার অযোগ্য মা বাবা তুলে যে সমস্ত গালি আপনারা জানেন সেগুলোই দেয়া শুরু করলো ।হতভম্ব ইন্টার্ন ভাইয়ার ১২ঘন্টার ডে শিফট শেষ হওয়ার কথা রাত ১০টায় ।আটটার সময়ই নাইট শিফটের আরেক ভাইয়াকে ফোন করে আসতে বললো ।রাতে না খেয়ে ভাইয়া এসেই পড়লো লাঞ্ছনার সামনে ।দুইজন ইন্টার্নকে পেয়ে তো রোগির বাহিনী হাতে যেন চাঁদ পেয়ে গেলো ।বাইরে থেকে দরজা আটকে মারতে গেলো আমাদের প্রথম ব্যাচের দুইজন অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট ইন্টার্নদের ।চিৎকার করে ম্যাডাম থামাতে গেলে ঐ সমস্ত নোংরা অমানুষগুলো তাকেও গালি দিতে লাগলো ।একজন বয়স্ক মহিলা ডাক্তারকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করার এই ঘটনা কি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিযানের কানে যায় না ? এর মধ্যে হাসপাতালের RMO আর পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসে । কয়েকটা প্রশ্ন- ১ .মৃত রোগীকে অক্সিজেন না দেয়া কি চিকিৎসায় অবহেলা ? ২ .আজ ডিপার্টমেন্ট হেড ম্যাডাম না থাকলে ওই পশুগুলা ভাইয়াদের কি অবস্থা করতো একবার ভেবে দেখেছেন ?যারা বলতে চান যে ডাক্তার কেন থাকবে না তাদের জন্য বলি ,হাসপাতালের ওয়ার্কিং আওয়ার গার্মেন্টসের মতো রাত আটটা পর্যন্ত না ।ম্যাডাম এমনিতেই তার ডিউটি আওয়ারের বাইরে শুধুমাত্র রোগীদের অবস্থা জানতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন । ৩ .আজ যদি এই দুই ভাইয়ার কিছু হতো এর দায় কে নিতো ? ৪ .আজ এই ভাইয়াদের জায়গায় যদি কোন ইন্টার্ন আপু থাকতো ? নাহ ।ভাবতে পারছিনা ঐ ভয়াবহতা ।আপনারা পারেন ? ৫ .নির্মম এই পরিবেশ থেকে বাঁচতে নিরাপত্তার দাবীতে একটা শিফট কর্মবিরতি দিলে সেটা কি এতটাই অমানবিক(যদিও মানবিকতার আওতায় ডাক্তাররা পড়েনা ) হয়ে যাবে যতটা আজ হয়েছে ?কিংবা যা হচ্ছে সারাদেশে ? একটা ঘটনা বলি ।জরায়ু অপারেশন হয়েছে এক রোগীর ।নয় ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ।স্টোরেজে রক্ত নেই ।ইন্টার্নী করা এই ভাই আপুরা পাঁচ ব্যাগ রক্ত নিজেরা দিয়েছেন ।গতকার আমি নিজে মেডিসিন ক্লাব থেকে প্রিক করে দুই জুনিয়র এর কাছ থেকে রক্ত নিয়ে দিছি যাদের আর একমাস পরেই প্রফ ।আজকে আরও দুই ব্যাগ দিছি ।তার মধ্যে আমার রক্তও আছে এক ব্যাগ ।এতটা অমানবিক আমরা যে কেনো হই ? রোগিটা survive করেছে ।এই আনন্দটা কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা ।যদি ভাবেন যে এটাই প্রথম তাহলে বলে রাখি আমি সহ অসংখ্য অগুনিত মেডিকেল স্টুডেন্ট আর ইন্টার্নীরা প্রতি চারমাসে একবার করে রুটিনমাফিক রক্ত দিয়ে যাচ্ছে সারা দেশে ।বড্ড অবহেলা করি আমরা রোগীদের । আর তাই আজকেই এই অমানবিক ইন্টার্ন ডাক্তারদের এমন লাঞ্ছনার শিকার হতে হলো । আরেকটা কথা বলে রাখি ,একজন ইন্টার্নী ডাক্তারকে ছাত্র ভেবে ভুল করবেন না ।সে একজন পূর্ণাঙ্গ ডাক্তার এবং সবকিছুর ট্রিটমেন্ট ম্যানেজমেন্ট জেনেই সে ডাক্তার হয়েছে ।ফাইনাল পরীক্ষার্থী কোন মেডিকেল স্টুডেন্টের মাঝে চুল পরিমান কোন lackings থাকলে তাকে পাশ করানো হয়না ।পাশের হার কতো শুনবেন ? roughly 30% এটা সারা বাংলাদেশের সব মেডিকেলে ।প্রশ্ন করতে পারেন কেন এত কম ।দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদেরকেও ছাকনী দিয়ে ছেচে আর নিংড়ে বের করা হয় ইন্টার্নীতে যাতে বিন্দুমাত্র কোন ভুল নাহয় ।কারন একজন চাকরীজীবি ভুল করলে হয়তো কারো অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক ক্ষতি হয় ।কিন্তু ডাক্তার ভুল করলে একজনের জীবন চলে যায় ।ডাক্তাররাও মানুষরে ভাই ।দূর থেকে একজন মানুষের মৃত্যু সংবাদ শুনে আপনাদের যতটা খারাপ লাগে তার থেকে কয়েকশত গুণ বেশি কষ্টের ,যখন চোখের সামনে একজন মূমুর্ষু রোগিকে মারা যেতে দেখি সম্ভাব্য সব চেষ্টার পড়েও ।আর এরপর যখন ঐ ডাক্তারের গায়েই হাত ওঠে মিথ্যা অভিযোগ আর লম্পট স্বার্থবাদী একশ্রেণীর পেশাজীবির কারনে ,তখন ঐ ডাক্তারের মনের অবস্থা আপনারা বুঝবেন না।
স্রষ্টা আপনাদের তা বোঝার অনুভূতি দিক। আমীন ।
লেখকঃ
আকিব আদনান লিখন
নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ (৫ম বর্ষ)
আকিব আদনান লিখন
নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ (৫ম বর্ষ)