“…জলোচ্ছাস ছাড়াও ফি বছর গ্রামে কলেরা বসন্ত দেখা দেয় মহামারি আকারে। গ্রামের মানুষ এ মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দল বেঁধে নেমে পড়ে পাড়া ‘বন্ধ’ করতে। বাঁশের কঞ্চিতে বাঁধা কিছু সাদা কাপড়ের কোণাকৃতির পতাকা, যাতে আবার আরবীতে বিভিন্ন দোয়া লেখা, সাথে একটি কাল রঙের পাঁঠা ছাগল, ঝুঁড়ি ভর্তি মাসকলাই নিয়ে দল বেঁধে গ্রামের যুবকেরা যার যার পাড়া বন্ধ করতে লেগে যায়। বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়ার সাথে সাথে ছাগলটাকে পিঠানো হয়, যাতে এটা ম্যা ম্যা করে ডাক দেয়, অত:পর কিছু দূর গিয়ে হুজুর একটি আজান দেওয়ার পর একটি পতাকা মাটিতে পূতাঁ হয়। এভাবে সমগ্র পাড়া সাদা পতাকায় ঘিরে ফেলা হয় যাতে ‘ওলা বিবি’ গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে। সহজ সরল গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, যত নষ্টের মূল এ অদৃশ্য ‘ওলাবিবি’। সবশেষে মাঠের মাঝখানে নিয়ে সোল্লাসে ছাগলটাকে জবাই করে সানন্দে উদরপূর্তি করে গ্রাম্য যুবকেরা। এভাবে গ্রাম বন্ধ করার পরও যখন কারো কারো কলেরা, ডাইরিয়া হয়,তখন ধারণা করা হয়, অন্যগ্রামের কোন মহিলার অন্তরালে ‘ওলা বিবি’ গ্রামে ঢুকে পড়েছে…”
(স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা, মোঃ জানে আলম)
আজ থেকেও ৪০ বছর আগে কলেরা এবং ডায়রিয়া ছিল এই জনপদের মানুষের কাছে আতংকের নাম। যা রহবে রক্ষা নেই। আইভি স্যালাইন আবিষ্কার হলেও তা ছিল এক ঝামেলার নাম। কারণ বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ ছাড়া শিরার ভিতর স্যালাইন দেওয়া সম্ভব না।
এমতাবস্থায় ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ, সংক্ষেপে আই সি ডি ডি আর, বি ওরস্যালাইন (ORS- Oral Rehydration Solution) উদ্ভাবন করে। কিন্তু এই স্যালাইন উদ্ভাবনের পরেও বাংলাদেশে এই খাবার স্যালাইনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত কম। মাত্র ১০%। এই স্যালাইনের ব্যবহার বাড়ানোর বার্তা গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। তার সাথে নানা গবেষণার মাধ্যমে এই স্যালাইনকে আরও সহজ করে গড়ে তোলা যাতে গ্রামের মায়েরা এই স্যালাইন সহজে তৈরি করতে পারে। এভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যপরিচর্যার মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্র্যাকের উদ্ভাবনী ও কার্যকর পদক্ষেপগুলো পৃথিবীতে আজ গবেষণার বিষয়। আশির দশকে ওরস্যালাইনের প্রচলনের মাধ্যমে ব্র্যাক ডায়রিয়া রোধে যুগান্তকারী অবদান রাখে।
‘A Simple Solution: Teaching Millions to Treat Diarrhoea at Home’ নামক বইতে সেই আখ্যান বর্ণনা করেছেন ব্র্যাকের ভাইস চেয়ার ড. আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী এবং হার্ভার্ডের প্রফেসর রিচার্ড ক্যাশ। উল্লেখ্য ১৯৬৮ সালে আই সি ডি ডি আর, বির ওরস্যালাইনের প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সাথে ছিলেন রিচার্ড ক্যাশ। বাংলাদেশের অসামান্য এই বন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের দ্বারা পুরস্কৃত হন।
বইটি প্রকাশ করেছে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। জনস্বাস্থ্যে আগ্রহী সবাইকে এই বইটি পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। মানুষের জন্য আবিষ্কার বাস্তবায়ন করতে হলে গণমানুষকে সম্পৃক্ত করতে হয় এটাই এই বইয়ের মূল কথা।