কানাডায় অভিবাসন নিয়ে এসেছেন অনেক চিকিৎসক। গত কয়েকবছরে এই সুযোগ কিছুটা সঙ্কুচিত হলেও হালে আবার অভিবাসনের সুযোগ খুলেছে। আমি সংক্ষেপে প্রক্রিয়াটা লেখার চেষ্টা করব। এই বর্ণনাটা আমার অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট।
কানাডায় অভিবাসন প্রক্রিয়ার সাথে মেডিকেল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়া। দুটোই সময়সাপেক্ষ। ডাক্তারদের কানাডার রেজিস্ট্রেশান পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় তা এরকমঃ
www.physicianapply.ca এই ওয়েবসাইটে যেয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এই একাউন্টে দেওয়া আপনার তথ্য PCRC ( physician credential registry, Canada) এবং MCC( Medical Council Canada) দুটো প্রতিষ্ঠানেই গ্রহণযোগ্য।
PCRC একটি তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান। আপনার প্রাথমিক তথ্য এদের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। PCRC তে প্রথমে আবেদন করুন। আপনার তথ্য সংরক্ষণের শেষে একটি প্রিন্ট আউট নিতে হয়, যেটা একজন নোটারি পাবলিক দিয়ে সত্যায়িত করে ছবি সহ পাঠাতে হয়। PCRC এই আবেদনটি প্রাপ্তি স্বীকার করে আপনাকে পরবর্তী পদক্ষেপের অনুমতি দেবে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ হতে প্রায় ৪-৮ সপ্তাহ লেগে যায়। এই পদক্ষেপ ছাড়া মেডিকেল কাউন্সিলের আবেদন শুরু করা যাবে না।
PCRC আবেদন পত্র হাতে পেলেই পরবর্তী পদক্ষেপের অনুমতি দিয়ে দেয়, সেই সাথে সংলিস্ট মেডিকেল কলেজে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য চিঠি পাঠায়। আমাদের দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী মেডিকেল কলেজে আপনার যোগাযোগ থাকা প্রয়োজন। চিঠি পেলে মেডিকেল কলেজ থেকে উত্তর পাঠানর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যক্তিগত ভাবে পাঠানর সুযোগ নেই। সেজন্য যদি সম্ভব হয় দেশে থাকতেই কাজটি করুন।
PCRC থেকে অনুমতি পেলে আপনি MCCতে আবেদন করতে পারবেন। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে প্রথম পরীক্ষা যা MCCEE ( evaluating exam) নামে পরিচিত, তা দেওয়া যাবে নেপালে বা ইন্ডিয়াতে। আমি গত সপ্তাহে নেটে দেখেছি বাংলাদেশে সেন্টারটি বন্ধ দেখিয়েছে। কেউ আবদনের আগে আবার দেখে নিতে পারেন সেন্টারটি বাংলাদেশে আছে কিনা। এই পরীক্ষাটি কানাডার বাইরে বিভিন্ন দেশে দেওয়া সম্ভব। Qbank নামে একটি ওয়েবসাইট আছে যেখানে এই পরীক্ষার মকশো করা যায়, উত্তর দেখে সংলিস্ট বিষয় সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। শর্টকাট প্রস্তুতির জন্য আদর্শ। অনেক বিশেষজ্ঞ প্রথম দিকে এটা নিয়ে নাক সিটকাতেন একটা সময়, কিন্তু এখন ধারনা পাল্টেছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে (কানাডার পশ্চিমের প্রদেশ) CPSBC( College of Physician and Surgeons of BC) তাদের লাইব্রেরিতে এই ওয়েবসাইটটি রেখেছে।
MCCQ1 এবং MCCQ2 পরীক্ষা দুটো কানাডাতেই দিতে হয় এবং MCCEE পাশের পরে। এই দুটো পরীক্ষার জন্য প্রচলিত সাহায্যকারী বইটির নাম Toronto Notes। এটি বই হিসেবে অথবা নেটে সিডি হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। এই পরীক্ষার জন্যও qbank ব্যবহার করা যায়। তবে যতটা নিজের প্রস্তুতি পরীক্ষার জন্য, ঠিক ততটা পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য নয়। বাংলাদেশি একজন চিকিৎসক যিনি এই দুটো পরীক্ষাতেই ভাল নম্বর নিয়ে পাস করেছেন, উপদেশ দিয়েছিলেন যে একসাথে দুটো পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলে আসলে বেশি ভাল হয়, কারণ দুটো পরীক্ষার ধরন আলাদা হলেও একটা আরেকটার পরিপূরক।
এই তিনটি পরীক্ষা একসাথে LMCC নামে পরিচিত। এই পরীক্ষা পাশ করলে তবে রেসিডেন্সিতে আবেদন করা যায়। LMCC Q1 দিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে আবেদন করা যায়। কানাডিয়ান মেডিকেল ছাত্ররা Q1 দিয়েই আবেদন করে রেসিডেন্সির। বিশেষজ্ঞ (specialization) অথবা জিপি ( Family Practice) দুটোর জন্যই রেসিডেন্সি করা বাধ্যতামূলক। এই রেসিডেন্সিতে চান্স না পেলে চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করার কোন সুযোগ নেই (সাধারন ভাবে), কিছু অসাধারণ ঘটনায় LMCC পাশ করে কেউ কেউ hospitalist হিসেবে চাকরী পেয়েছেন।
রেসিডেন্সিতে এখনকার মেডিকেলের ছাত্র ছাত্রী আবেদন করে তাদের চতুর্থ বরষের শুরুতেই। এটাকে সম্ভবত ম্যাচিং বলে। এদের আগের পরীক্ষার ফলাফল, বিষয় নির্বাচন, এবং ইন্টার্ভিউ এর উপর ভিত্তি করে এরা রেসিডেন্সির জন্য নির্বাচিত হন। রেসিডেন্সির জন্য প্রথম সুযোগ পান এরা। এর পরের খালি পদ পূরণ হয় কানাডিয়ান কিন্তু বাইরে মেডিকেল শিক্ষা গ্রহণ করা ছাত্রছাত্রী, তারপরে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি ধারি আবেদনকারী দিয়ে। এজন্য অভিবাসীদের জন্য খুব কম সংখ্যক পদ পড়ে থাকে, তাই প্রতিযোগিতা হয় খুব তীব্র।
কানাডার স্বাস্থ্য সঙ্ক্রান্ত সংস্থা গুলো ঠিক বাংলাদেশের মত নয়। বাংলদেশের BMDC এর সমতুল্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কলেজ। প্রত্যেক প্রদেশে একটা করে কলেজ আছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে এর নাম CPSBC (College of Physician and Surgeons of BC)। প্রদেশের নাম বদলে দিলেই সেই প্রদেশের কলেজের নাম হয়ে যাবে। এরা সেই প্রদেশের সমস্ত চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশান নিয়ন্ত্রণ করে। জিপি কিম্বা স্পেশালিষ্ট। রয়েল কলেজ যা RCPSC (Royal College of Physician and Surgeons, Canada) নামে পরিচিত তা আসলে স্পেশালিষ্ট দের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, আমাদের BCPS এর মত। জিপিদের কলেজের নাম The College of Family Physicians Canada.
যারা কানাডার বাইরে থেকে MBBS বা সমমানের পরীক্ষা পাশ করেছেন তাদের এখানে International Medical Graduate বা সংক্ষেপে IMG বলা হয়। MCC এর ওয়েবসাইটে IMG সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। IMG রা সাধারণত স্পেশালাইজেশানে সুযোগ খুব কম পায়। কারণ হিসেবে নিয়ম টা উপরে উল্লেখ করেছি। যা পাওয়া যায় তার সিংহভাগ হচ্ছে ফ্যামিলি মেডিসিন রেসিডেন্সি বা জিপি রেসিডেন্সি ।
জনশ্রুতি আছে বাংলাদেশিরা এখানে রেসিডেন্সি পায় না। এই কথাটা কতটা সত্য বলা মুশকিল। কেউ কেউ পেয়েছেন, এবং দ্রুত পেয়েছেন। কেউ পেয়েছেন এদেশে আসার ১০-১৫ বছর পরে। অনেকে আছেন LMCC পাশ করেও কোন রেসিডেন্সি পাননি।
ঠিক কিভাবে রেসিডেন্সি পাওয়া যায়?
নিয়ম এখানে সবার জন্য সমান, তোয়াজ বা “মামা খালার” চিঠি কোন কাজে আসে না।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটা পরামর্শ দিতে পারি। LMCC পরীক্ষার উঁচু নম্বর জরুরি। রেফারেন্স এদশে খুব প্রয়োজন, কানাডিয়ান রেফারেন্স ছাড়া বাংলাদেশি রেফারেন্স এর তেমন কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এর আগে যারা কোন রেফারেন্স লিখে এনেছেন, দেখা গেছে দুজন প্রার্থীর রেফারেন্স হবহু এক। বাইরে থেকে এসে কানাডিয়ান রেফারেন্স জোগাড়ের একটা ভাল উপায় হচ্ছে মাস্টার্সে ভরতি হওয়া। একবছরের একটা মাস্টার্স করলে দুটো লাভ। এক ডিগ্রি হওয়া, দ্বিতীয়ত ভাল রেফারেন্স তৈরি করা। কানাডার সব প্রদেশে নিয়ম এক নয়। ঠাণ্ডার জায়গা গুলোতে নিয়ম কিছুটা শিথিল। সেখানে রেসিডেন্সি পাওয়াও যায়। তার জন্য সেখানে অন্তত ৫ বছর সার্ভিস দিতে হয়।
রেসিডেন্সির বাইরে যে চাকরী পাওয়া যায় তার একটা হচ্ছে Physician অ্যাসিস্ট্যান্ট। একজন family physician এর সহকারী হিসেবে। এটা অন্টারিও , আলবার্টা প্রদেশে আছে শুনেছি। অন্য প্রদেশেও অল্প বিস্তর থাকতে পারে। নিউ ব্রান্স উইক প্রদেশে LMCC কমপ্লিট করে Hospitalist হিসেবে কাজ করছেন কেউ কেউ। Hospitalist এর পদ টা আমাদের দেশের RMO পদের মত। হাসপাতালে ভরতি হওয়া কোন রোগীর মেডিসিন সঙ্ক্রান্ত অসুবিধা হলে এঁরা প্রথম চিকিৎসা দেন।
কানাডিয়ান রেফারেন্স পাওয়া বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
আয়ারল্যান্ডে এবং কানাডায় কাজ করছি প্রায় ১৩ বছর। আমাদের এবং ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকান মানসিকতার পার্থক্য অনেক। এখানে মানুষ নিজের প্রচার নিজেই করে। নিজে কি করল সেই বর্ণনাটা বেশ ঘটা করেই দেয়, এমনকি নিজের ছেলের নাক মোছানো হলেও। নিজেদের মধ্যে রসিকতা করে, তা যেমন চটুল হতে পারে, তেমনি হতে পারে নির্দোষ। এদের জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা জানলে বন্ধত্ব তৈরি করা সহজ। যেমন স্পোর্টস এদেশে খুব জনপ্রিয়। আইস হকি সম্পর্কে একটুও না জানলে সামারে আলাপের প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়াই মুস্কিল। প্রত্যেক প্রদেশের নিজস্ব হকি দল আছে, তাদের খেলা কবে, কার সাথে জিতল , এসব আলোচনা আমাদের দেশের ক্রিকেট আলোচনার মতই। যারা মিতভাষী তাদের জন্য এখানে নিজেকে প্রকাশ করা খুব শক্ত। এদেশে একজনের শুধু কাজ দেখে মূল্যায়ন করে না কেউ। দেখতে চায় সহকর্মী হিসেবে “এই ব্যক্তিকে আমি চাই কিনা “ এভাবে।
এটা মনে রাখা দরকার যে USMLE পরীক্ষা MCC গ্রাহ্য করে। কেউ USMLE সম্পূর্ণ করে এলে LMCC দিতে হয় না। যারা এখন কানাডায় অভিবাসনের জন্য আবেদন করছেন , তারা USMLE পরীক্ষা দিলে কানাডা এবং আমেরিকা দুই জায়গাতেই রেসিডেন্সির জন্য আবেদন করতে পারবেন। ডাক্তার হিসেবে কেরিয়ার টা টিকে জাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আমেরিকার তুলনায় কানাডা জনসংখ্যায় কম, সুযোগের ক্ষেত্রেও স্বল্প। এভাবে দেখা যেতে পারে যে আমেরিকা ৫০ টি দেশের সমষ্টি আর কানাডা ১০টি। সুতরাং চিকিৎসক হিসেবে আমেরিকাতে সুযোগ পাওয়া কানাডার চাইতে “সহজ”।
কানাডায় চিকিৎসকদের গড়পড়তা বার্ষিক আয় প্রায় 3 লাখ ডলারের কাছাকাছি।(ব্যতিক্রমঃ প্লাস্টিক সার্জন, আই সার্জনদের উপার্জন অনেক অনেক বেশি) । বর্তমানে এই উপার্জনে ট্যাক্স প্রায় ৪০ % সব মিলিয়ে। তারমানে মাসে ১৫ হাজার ডলারের মত আয়। এই থেকে বাদ যাবে আরও ৫ হাজার ডলার অফিসের খরচের জন্য। সব মিলিয়ে হয়ত ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার মাসে নিজের খরচের জন্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সাথে হিসাব করলে ৫ থেকে সারে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত। জিনিসপত্রের দাম, বাড়ির দাম মিলিয়ে দেখলে এদেশে তেমন কোন উপার্জন নয়। উপরন্তু এদেশে ডাক্তারদের কোন পেনশন নেই, তাই চাকরী শেষের দিনগুলির জন্য টাকা জমিয়ে রাখতে হয়। বাংলাদেশে যিনি মাসে ট্যাক্স বাদে তিনলাখ টাকা উপার্জন করেন , তিনি কানাডার চিকিৎসকের চাইতে অনেক বেশি খরচ করার সামর্থ্য রাখেন তুল্য মূল্য বিচারে।
তাহলে শুধু শুধু এদেশে আসা কেন?
বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যে সময় দিতে হয় তা অনেক। তারপরও যারা পাশের পরে দ্রুততম সময়ে এখানে এসে চেষ্টা করবেন তাদের চিকিৎসক হওয়ার সম্ভাবনা কম নয়। তবে এখানে দলাদলি নেই, বর্ণবাদি আচরণ অন্তরলিন। যারা মিশতে পারে কানাডিয়ানদের মত করে তারা দ্রুত খাপ খাইয়ে নেন। নির্দিষ্ট সময়ের পরে প্রাকটিসের ঝামেলা নেই। পরিবারের জন্য সময় দেওয়া যায়। অন্য সমস্ত অপরাধ মূলক কার্যক্রম বাংলাদেশের চাইতে অনেক কম। নিজের পোস্টিং রাখার জন্য ঘুষ দিতে হয়না। ধাক্কা খাবার ভয় নেই। এই স্বস্তির দাম হচ্ছে সেই পরিশ্রমটুকু যা করলে এখানে চিকিৎসক হিসেবে টিকে থাকা যাবে।
কানাডাতে এখনো অনেক Family Physician প্রয়োজন। যারা এটাকে গ্রহণ করতে চান, তাদের বেশ কিছু সুযোগ আছে। কিন্তু যারা এখানে এসে স্পেসালাইজেশান করতে চান তাদের জন্য কাজটা অসম্ভব না হলেও দুরুহ।
যারা এসে পড়েছেন তাদের জন্য অভিনন্দন, যারা আসতে চান তাদের জন্য শুভেচ্ছা!
লেখক ঃ ডা. অসিত বর্ধন
Consultant Anesthesiologist in prince george regional hospital,Canada
Ashit Bardhan
পোস্টটা খুব উপকারী ছিল। বাট বাংলাদেশের এম বি বি এস ডিগ্রির পর কি সরাসরি ফেলোশিপের আবেদন করা যাবে? নাকি মাস্টার্স?
ফেলোশিপ করা হয় পোস্টগ্রাজুয়েশান এর শেষে। এমবিবিএস করে পাওয়া যাবে না।
Sifat Sharmin
বাংলাদেশ থেকে MRCP করে কানাডায় যাওয়া সম্ভব? শুধু MRCP’র পরে ওখানে মাস্টার্স করলে ফেলোশিপ করা যাবে?