আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক কিংবদন্তীতুল্য চিকিৎসক, গবেষক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা এ এস এম মিজানুর রহমান। ডা এ এস এম মিজানুর রহমান গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এমবিবিএস পাশ করেন। এরপর তিনি তৎকালীন পাক-সিয়াটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা শহরের আভিজাত্যের জীবন ছেড়ে চাঁদপুরের মতলবে সপরিবারে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তখন কলেরা রিসার্চ ল্যাবের মতলব ব্রাঞ্চে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই মতলবেই ১৯৬৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উন্নয়নশীল দেশে অন্যতম বৃহৎ এবং দীর্ঘ স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্প বা Health and Demographic Surveillance System (HDSS) চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি ছিলেন মতলব কলেরা হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক।
১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্বের প্রথম ওরস্যালাইনের ট্রায়ালে অংশ নেন। এতে আরও অংশ নেন আমেরিকান গবেষক ডেভিড নালিন এবং রিচারড ক্যাশ। তারা ছিলেন তখন তরুণ গবেষক। সেই সময় মতলবে ছিল না ইলেক্ট্রিসিটি। ছিল না যথেষ্ট উন্নত যন্ত্রপাতি।
সেখানে তিনি মার্কিন গবেষক দলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেন। মতলবের অন্যান্য চিকিৎসক, কর্মচারী, এবং রোগীদের মাঝে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর সহকর্মী ডা এস কে রায়ের কাছ থেকে জানা যায় একবার মতলব হাসপাতালে একজন রোগী কলেরা সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন নিয়ে ভর্তি হয়। রোগীর এক স্বজন হাসপাতালের কোয়ার্টারে ডা রহমানকে খুঁজতে যান। ডা রহমান তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে লুঙ্গি পড়েই হাসপাতালে চলে আসেন। সেখানে সিপিয়ার দিয়ে রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
আশির দশকের শুরুতে তিনি লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে কমিউনিটি হেলথ ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিস বিষয়ে এমএসসি করেন। তিনি আশির দশকের মধ্যভাগে আইসিডিডিআরবির দল নিয়ে সৌদি আরবে যান সেখানে তাদের কলেরা মহামারী মোকাবেলার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে। সেখানে তারা সৌদি সরকারকে কলেরা ট্রিটমেন্ট ওয়ার্ড এবং গবেষণাগার তৈরি করতে সহায়তা করেন।
দেশে ফিরে এসে তিনি ঢাকায় আইসিডিডিআরবি ট্রেনিং ব্রাঞ্চে যোগ দেন এবং কলেরার উপর নানা আন্তর্জাতিক কোর্স পরিচালনা করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে ট্রেনিং কোঅরডিনেটর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে চিকিৎসক, গবেষক, চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং শিক্ষক। তিনি সাধাসিধে জীবনযাপন করতেন।
১৯৯৪ সালে ডা এ এস এম মিজানুর রহমান আইসিডিডিআরবি থেকে অবসর নেন। এরপর তিনি সামামজিক কাজের সাথে জড়িত হন। তিনি তাঁর নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি দাতব্য হাসপাতাল গড়ে তুলেন। তিনি একবার বলেছিলেন “মানুষ আমার কাছে আসে, আমার সাহায্য নেয় এবং তাদের উপকার করে আমি বেঁচে থাকি”। ২০০৫ সালে বোস্টনের নোভা টেলিভিশন তাদের “RX for Survival: A Global Health Challenge” এ কলেরা মহামারী প্রতিকারের জন্য ডা রহমানের সাক্ষাৎকার নেয়।
২০০৪ সালে ডা রহমান ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। তাঁকে বাইপাস সার্জারি করতে হয়। ২০০৬ সালের ২৭ মার্চ তাঁর জীবনাবসান ঘটে। আইসিডিডিআরবির সহকর্মীদের ধারনা তিনি তাঁর জীবনে বিশ্বের যেকোনো চিকিৎসকের তুলনায় বহুগুণ বেশী কলেরা রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকবেন।