ডা এম মুজিবুর রহমান ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। এমবিবিএস পাশ করার পর ডা মুজিবুর রহমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টিবিজ্ঞানের উপর এমএস করেন। এরপর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির ফিজিওলজি ডিপার্টমেন্টে পিএইচডি করেন।
সাইটেসন ক্লাসিকঃ
গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার সময় তিনি জে ভি জি এ দারনিনের সাথে একটি গবেষণাপত্র লিখেন। এই গবেষণাপত্রে তারা দেখান skinfold thickness কিভাবে শরীরে চর্বির পরিমাণ মাপতে ব্যবহার করা যেতে পারে। “The assessment of the amount of fat in the human body from measurements of skinfold thickness” শিরোনামে এই গবেষণাপত্র ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ জার্নাল অফ নিউট্রিসনে। এই গবেশনাপত্রটিকে বলা হয় সাইটেসন ক্লাসিক। এই লেখাখানা লেখা পর্যন্ত (৬ জুলাই, ২০১৬) সেই গবেষণাপত্রের সাইটেসন ছিল ১৭১৭। এই পরীক্ষা Durin-Rahaman skinfold test নামে পরিচিত।
ঢাকা সলিউসনঃ
মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে ১৯৬৬ সালে তৎকালীন কলেরা রিসার্চ ল্যাবে (বর্তমানে আইসিডিডিআরবি) যোগ দেন। এখানে তিনি সেই বিখ্যাত ঢাকা সলিউসন (Dacca solution) তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে যান। বর্তমানে এই সলিউসন আইভি কলেরা স্যালাইন নামে পরিচিত, এবং সেই কলেরা স্যালাইন কলেরা রোগীকে চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
প্যাকেটজাত ওর্যাল রিহাইড্রেসন স্যালাইনঃ
মুজিবুর রহমান টেকনাফের শ্যামলাপুর গ্রামে আউট স্টেশন তৈরি করে সেই দুর্গম এলাকার মানুষের সেবা পৌঁছে দেন।
সেখানে তিনি রাইস বেইসড ওর্যাল রিহাইড্রেসন স্যালাইন নিয়ে কাজ করেন। তিনি দেখান যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতাল থেকে যারা দূরে থাকেন, তাদের ভিতর ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার বেশি। তাই তিনি প্যাকেটে ওর্যাল রিহাইড্রেসন স্যালাইন বাজারজাতকরণের দিকে গুরুত্ব দেন।
এই উপলক্ষে ওর্যাল রিহাইড্রেসন স্যালাইন প্যাকেটে বিতরণের গবেষণা করে তিনি দেখান এতে ডায়রিয়ায় মৃত্যুর হার ২০% কমে যায়।
ডা রহমান তখন বাংলাদেশ সরকার এবং ব্র্যাকের কাছে আবেদন করেন এই ওর্যাল রিহাইড্রেসন স্যালাইনের ব্যবহার দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে।
এই গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য শিক্ষা দিলে তারা সেটা যথার্থ প্রয়োগ করতে পারে। এই গবেষণার ফলে অন্যান্য মৌলিক স্বাস্থ্য সেবাসমূহ যেমন পরিবার পরিকল্পনা, মা এবং শিশুর স্বাস্থ্য সেবা গ্রামে সরাসরি প্রয়োগ (কমিউনিটি বেইসড এপ্রোচ) এর ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে। বাংলাদেশ সরকারের স্যাটেলাইট ক্লিনিক বা কমিউনিটি বেইসড ক্লিনিকের ধারণা তার এই গবেষণা থেকেই আসে। বাংলাদেশ সরকার ইপিআই আউটরিচের মাধ্যমে টিকা কর্মসূচীকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধঃ
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে তিনি ড. উইলিয়াম বি গ্রিনউগ থ্রি (বর্তমানে Clinical Chief, Ventilator Rehabilitation Unit, Johns Hopkins Bayview Medical Center) যোগাযোগ করেন। উইলিয়াম বি গ্রিনউগ তখন ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি উইলিয়াম বি গ্রিনউগের কাছে জানতে চান স্বাধীনতার পর কলেরা রিসার্চ ল্যাবের ফাণ্ডিং এর হবে। কারণ সেসময় মার্কিনীরা পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল। উইলিয়াম বি গ্রিনউগ তাঁকে নিশ্চয়তা দেন কলেরা রিসার্চ ল্যাব আগের মত ফাণ্ডিং পাবে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সালে কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি সুন্দরভাবে তার ফাণ্ডিং যোগাড় করে। ১৯৭৮ সালে ‘আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ অধ্যাদেশ ১৯৭৮’ এর মাধ্যমে কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি আইসিডিডিআরবি নামে পরিবর্তিত হয় এবং এর কোর ডোনার/ মূল দাতা সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ সরকার আবির্ভূত হয়। এই সময় আইসিডিডিআরবিকে একটি আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি প্রভূত ভূমিকা পালন করেন।
ডা মুজিবুর রহমান যুদ্ধের সময় কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির নিরবিচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করেন। সেই সময় International Rescue Committee এর তত্ত্বাবধানে আমেরিকার National Institutes of Health এই ফাণ্ডিং প্রদান করে থাকে।
১৯৭৪ সিগেলা মহামারীঃ
১৯৭৪ সালে সেইন্ট মার্টিন দ্বীপে রক্ত আমাশয়ের মহামারী দেখা যায়। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ডা মুজিবুর রহমান সেখানে তাঁর দল নিয়ে ছুটে যান। সেখানে তাঁরা আবিষ্কার করেন Shigella dysenteriae ব্যাকটেরিয়ার টাইপ ১ স্ত্রেইন দিয়ে এই রক্ত আমাশয় হচ্ছে যা সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সহায়তায় তিনি প্রথম দেখালেন সিগেলা কিভাবে সেখানে হেমোলাইটিক ইউরেমিক সিন্ড্রোম করে মানুষের মৃত্যু ঘটাচ্ছে।
প্রতিকারমূলক বা প্রিভেনটিভ সার্ভিস প্রণয়নঃ
ডা মুজিবুর রহমান নানা প্রতিকারমূলক বা প্রিভেনটিভ সার্ভিস প্রণয়নে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তার গবেষণায় দেখা যায় স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, টিউব ওয়েল স্থাপন, কিভাবে পরিষ্কার পরিছন্নতার মাধ্যমে পানিবাহিত রোগ প্রতিকার করা যায় এই শিক্ষার পাশাপাশি পরিবারে সদস্য সংখ্যা ডায়রিয়া এবং শিশু মৃত্যুর উপর ভূমিকা পালন করেন।
এই বিষয়ে বলে রাখা ভালো স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করা গ্রামের সংস্কৃতির ভিতর ছিল না। মানুষ অনেকেই খোলা কাশের নিচে পায়খানা করত। দজেন এবং সেন তাদের বইতে দেখিয়েছেন ভারতে এখন অনেক মানুষ খোলা আকাশের নিচে পায়খানা করে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই আচরণ পরিবর্তিত হয়েছে। একই সাথে টিউব ওয়েলের পানি ব্যবহার করা। ডা রহমান এবং তার দলের গবেষণার ফলেই এইসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার, আইসিডিডিআরবি এবং ব্র্যাকসহ এনজিওগুলোর এইসব কারণেই বাংলাদেশে ডায়রিয়ায় মৃত্যুহার কমে যায়। বাংলাদেশে এখন ওর্যাল রিহাইড্রেসন স্যালাইনের ব্যবহার যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি। ১৯৭০ এর দশকে এইসব নিয়ে মুজিবুর রহমান যখন কাজ শুরু করেন বাংলাদেশে গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৫০ বছর, ১ বছরের নিচে শিশুর মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজার জন্মে ২০০ এবং এই শিশুদের এক তৃতীয়াংশ মারা যেত ডায়রিয়ায়। এখন বাংলাদেশে বাংলাদেশে গড় আয়ুষ্কাল ৭০ বছর, ১ বছরের নিচে শিশুর মৃত্যুহার ছিল প্রতি হাজার জন্মে ৩২ এবং এই শিশুদের মাত্র ৫% মারা যায় ডায়রিয়ায়।
অন্যান্য কাজঃ
তিনি কলেরা ছাড়াও পুষ্টি এবং জনমিতি নিয়ে কাজ করেন। তিনি আইসিডিডিআরবির গবেষণার ক্ষেত্র বহুমুখী করার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অপুষ্টি এবং ডায়রিয়ার দুষ্ট চক্র ( malnutrition and diarrhoea vicious cycle) তাঁরই গবেষণায় বের হয়ে আসে। তিনি ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আইসিডিডিআরবির সাথে ছিলেন। এর ভিতর তিনি সিনিয়র সায়েন্টিস্ট এবং পুষ্টিবিজ্ঞান এবং ক্লিনিক্যাল সায়েন্স ডিভিশনের ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আইসিডিডিআরবির সহযোগী পরিচালক ছিলেন।
২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর তাঁর জীবনাবসান ঘটে। এর আগে আইসিডিডিআরবি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০১৪ সালের ২২ মে the Dr M Mujibur Rahaman Annual Lecture প্রবর্তন করে। গবেষক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা মুজিবুর রহমান তাঁর কাজের মাধ্যমে অমর হয়ে থাকবেন। গত ২৮ মার্চ , ২০১৫ ইং তারিখে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শোকবার্তা প্রকাশ করে।