ডা মোহাম্মদ ইউনুস ১৯৬২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান – সাউথ এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন (পাক-সিয়াটো) কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (বর্তমান আইসিডিডিআরবি) যোগদান করেন। তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত ছিল কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির মতলব হাসপাতালে সেকেন্ড মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করা। তার বস ছিলেন ডা এএসএম মিজানুর রহমান। সেই সময়ে মতলবের আইসিডিডিআরবির হাসপাতাল ছিল ছোট একটি ভবনে যেটা সরকারের হেলথ কমপ্লেক্সের জন্য বরাদ্দ ছিল। মতলবে মূলত ডেমোগ্রাফিক সারভেইল্যান্স এবং ইঞ্জেকট্যাবল কলেরা ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালের কাজ হত। এর সাথে চলত তার হাসপাতাল।
ডা মিজান এবং ডা ইউনুস সপ্তাহের সাতদিন সেখানে কাজ করতেন। একদিন পর পর অনকলে নাইট ডিউটি করতেন। তখন সেখানে মাত্র দুইজন চিকিৎসক ছিলেনঃ তারা দুইজন। সেই সময় মতলব হাসপাতালে ছিল না বিদ্যুৎ সংযোগ। রাতের বেলা রোগীদের চিকিৎসা হত লণ্ঠনের আলোয়। ছিল না উন্নত যন্ত্রপাতি। যেমন অক্সিজেনের সাপ্লাই। কলেরা রোগীদের শেষ পর্যায়ে মাউথ টু মাউথ ব্রেদিং ছাড়া আর উপায় ছিল না।
তাঁর ক্যারিয়ারের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাঃ
১৯৬৯> ওর্যাল রিহাইড্রেসন সলিউসনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেন। এই ওর্যাল রিহাইড্রেসন সলিউসনে প্রথম গ্লাইসিন এবং গ্লুকোজ ব্যবহার করা হয়। এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয় মতলব হাসপাতালে।
১৯৭০> কেনেথ বারটের সাথে রংপুরে এল টর কলেরা ভাইরাস মহামারীর রোগতাত্ত্বিক পরীক্ষা পরিচালনা এবং জরুরী সেবাপ্রদানের ক্লিনিক স্থাপনের কাজ করা হয়।
১৯৭০> ইঞ্জেকট্যাবল কলেরা ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালের সফলতা পরীক্ষা। গবেষণায় দেখা যায় সেই ভ্যাক্সিন আসলে অকার্যকর। বর্তমানে আইসিডিডিআরবির ভ্যাক্সিন সায়েন্স বিভাগ আবার ৪৫ বছর পর নতুন করে ইঞ্জেকট্যাবল কলেরা ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল দিচ্ছে।
১৯৭৭> সিগেলা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের ট্রায়াল।
১৯৭৯> এবার বাড়িতে গুঁড় আর লবণ দিয়ে সহজভাবে তৈরি করা ওর্যাল রিহাইড্রেসন সলিউসনের ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল এক বিপ্লব। এর পর ব্র্যাকের সহায়তায় সেই স্যালাইন গ্রামে গারমে পৌঁছে যায়। এই নিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ।
সত্তরের দশকের শেষ দিকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারের হার ছিল অনেক কম। শিশু মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। ১৯৭৭ সালে আইসিডিডিআরবি মা এবং শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি মতলবে প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের সাথে ছিল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বিতরণ এবং কাউন্সেলিং। এই প্রকল্পের টার্গেট গ্রুপ ছিল সন্তান জন্মদানে সক্ষম সকল বিবাহিত মহিলা এবং পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশু। এই প্রকল্পে স্বাস্থ্যশিক্ষা নিয়োগ দেওয়া হয় স্থানীয় মহিলাদের। এই প্রকল্পের ফলে শিশু মৃত্যুহার কমে যায় এবং জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতি ব্যবহারের হার বেড়ে যায়। ডা ইউনুস এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই প্রকল্পের শিক্ষা বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ দেয় সারা দেশে এই প্রকল্প ছড়িয়ে দিয়ে শিশু মৃত্যুহার হ্রাস এবং জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতি ব্যবহারের হার বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
ডা ইউনুস মতলব সেন্টারের উন্নতিতে প্রভূত ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি মতলব হেলথ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান হবার পর তিনি ফ্যাসিলিটির জন্য নিজস্ব জায়গা কেনার উদ্যোগ নেন। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইসিডিডিআরবি মতলবে তাদের নিজস্ব ভবনে মতলব হেলথ রিসার্চ সেন্টারকে স্থানান্তর করে। এই মতলবেই ১৯৬৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) উন্নয়নশীল দেশে অন্যতম বৃহৎ এবং দীর্ঘ স্বাস্থ্য এবং জনমিতি সারভেইলেন্স প্রকল্প বা Health and Demographic Surveillance System (HDSS) চালিয়ে যাচ্ছে। মতলব হেলথ রিসার্চ সেন্টার সম্পর্কে পড়তে এখানে দেখুন।
১৯৮২ সালে লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে কমিউনিটি হেলথে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ডা ইউনুস সর্বদা ক্লিনিক্যাল এবং রোগতাত্ত্বিক গবেষণার সাথে নিজেকে যুক্ত রাখেন। এছাড়া রোটা ভাইরাস ভ্যাক্সিন, আর্সেনিক দূষণ নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তিনি প্রচুর তরুণ গবেষককে তত্ত্বাবধান করেছেন। এদের অনেকেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নামকরা গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন পরবর্তীতে।
ডা ইউনুস প্রায় ৪৭ বছর ধরে আইসিডিডিআরবির সাথে কর্মরত রয়েছেন। তার এই সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ অনেক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশে রোগতত্ত্বের যে পরিবর্তন ঘটছে অর্থাৎ সংক্রামক ব্যাধি থেকে অসংক্রামক ব্যাধির হার বেড়ে গিয়েছে তা জানা যায় মতলব থেকে। রোগতত্ত্বের উপর গবেষণা থেকে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা হেলথ সিস্টেম নির্ভর গবেষণার দিকে ঝোঁক বেড়েছে। আর্সেনিক দূষণ এক নতুন সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ডা ইউনুসের মতে পরিবেশ দূষণ এবং এর সাথে রোগতত্ত্বের পরিবর্তন নিয়ে গবেষণার আশু প্রয়োজন। দীর্ঘ পেশা জীবনে বর্তমানে তিনি আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী পদে কর্মরত। এছাড়াও ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিভাগের স্নিয়র এসোসিয়েট পদে কর্মরত ছিলেন।
সুদীর্ঘ গবেষকজীবনে তিনি ১৫০ এর উপর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।
তাঁর গবেষণাপত্রগুলো এখানে দেখতে পারবেন।
সূত্রঃ
আইসিডিডিআরবি বার্ষিক প্রতিবেদন ২০০৯