১৮ অক্টোবর ২০১৯:
কিংবদন্তি ডাঃ কর্নেল শরফুদ্দিন আহমদ ছিলেন একাধারে একজন প্রকৌশলী, চিকিৎসক এবং উকিল। ভূভারতে এমন রেকর্ড আর কারও আছে বলে জানা যায় না।
গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে মানবজীবন একবার। এই একবারের জীবনে কেউ যদি তিন জীবনের স্বাদ নিতে পারেন, সেটিই তো বুদ্ধিমানের কাজ। কীর্তিমান মানুষদের জীবন পর্যালোচনায় দেখা গেছে তাঁরা জীবনের গতিপথে আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছেন। সিদ্ধার্থ একরাতে চন্দ্রাহত হয়ে সুখের সংসার ত্যাগ করে ধ্যানে গেলেন। আর্জেন্টিনার চেগুয়েভেরা বলিভিয়ায় পড়তে গেলেন ডাক্তারি, পাসও করলেন, কিন্তু বলিভিয়ার বিপ্লবে জড়িয়ে হলেন পৃথিবীখ্যাত বিপ্লবী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পড়তে গেলেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, কিন্তু ফিরে এলেন; নাহলে এত বড়ো গায়ক হয়তো পাওয়া হত না গানপিপাসু শ্রোতাদের।
শরফুদ্দিন আহমদ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। জন্ম ১৯২২ সালে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া গ্রামে। ১৯৪১ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হলেন। কলকাতায় গেলেনও। কিন্তু ভর্তি হলেন উত্তর চব্বিশ পরগণার কাঁচরাপাড়ায় বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। ১৯৪৭ সালে সাফল্যের সঙ্গে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েতে ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি নেন। এই এক চাকরিতেই অনেকের মতে সফল জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু শরফুদ্দিন আহমদের মাথায় রয়ে গিয়েছিল মেডিকেল কলেজে পড়ার হিসেব। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ যাত্রা শুরু করে। ১৯৪৬ সালে প্রথম বর্ষ থেকে পঞ্চম বর্ষ পর্যন্ত ছাত্র ভর্তি করা হয়। প্রথম বর্ষে নতুন ছাত্র ভর্তি করা হলেও ২য় থেকে ৫ম বর্ষের ছাত্ররা ছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে মাইগ্রেশন করে আসা। প্রথম বর্ষের নামকরণ করা হয় K-5, এভাবে K-4, K-3 হয়ে পঞ্চম বর্ষ হল K-1।
শরফুদ্দিন আহমদ প্রথম বর্ষে ভর্তি হলেন ১৯৪৮ সালে। জীবনকে বহুভাবে দেখেছেন তিনি। মানুষের জীবন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ছিল নেতৃত্বগুণ। ১৯৫১-৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। কলেজ ছাত্র ইউনিয়নেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫২ সালে বাঙালির মহান ভাষা আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। প্রথম শহিদ মিনারের একজন স্থপতি তিনি। এমবিবিএস পাস করেন ১৯৫৪ সালে। শরফুদ্দিনের সামনে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চাকরি করার পথটিও কিন্তু খোলা রয়েছে তখন। তিনি তখন একাধারে একজন প্রকৌশলী এবং চিকিৎসক। শরফুদ্দিন জয়েন করেন আর্মি মেডিকেল কোরে। ১৯৫৯ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিতে এক বছর ট্রেনিং করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে বিএ করেন। ১৯৭০ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করেন।
পথ তখনও শেষ হয়নি শরফুদ্দিন আহমদের। পঞ্চাশ দশকের হিট বাংলা সিনেমা দেখলে দেখা যাবে সমাজে রাজত্ব করেছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং উকিলরা। সুতরাং ওকালতিই বা বাদ যাবে কেন? শরফুদ্দিন আহমদ ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। জীবনের লক্ষ্য তাঁর সুদূরপ্রসারী। ১৯৮০ সালে কর্নেল থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে চলে গেলেন লিবিয়া। ত্রিপলিতে মিলিটারি হাসপাতালে ছয় বছর চাকরি করে ‘৮৬ সালে ফিরে এলেন দেশে। পেট্রোডলারের সান্নিধ্যে জীবনের অর্থনৈতিক অবস্থা গুছিয়ে ফেলেছেন। ছুটে গেলেন এবার শখের পেশা ওকালতিতে। ঢাকা বার এবং হাইকোর্ট বারে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আইনপেশায় নিয়োজিত ছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে সিপিবির নেতা ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
জীবন তাঁর কাছে ছিল আকর্ষণীয় এক পেয়ালা। আকণ্ঠ চুমুক দিয়ে তিনি এর রূপ-রস-সুধা পান করেছেন। দেশ ভ্রমণ করেছেন, বই লিখেছেন। জীবনের ভাণ্ডার তাঁর পরিপূর্ণ। দীর্ঘজীবন সুস্থ, কর্মক্ষম ছিলেন। ৯৩ বছর বয়সের এক বর্ণাঢ্য ইনিংস শেষে ২০১৫ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন দেশমাতৃকার কৃতী সন্তান ভাষাসৈনিক ডা. কর্নেল শরফুদ্দিন আহমদ।
তথ্য সূত্রে,
মোরশেদ হাসান
স্টাফ রিপোর্টার/জান্নাত বিনতে হোসেন