লিখেছেন: ডা. মোহিব নীরব
প্রতিষ্ঠাতা, প্ল্যাটফর্ম
সাজানো গোছানো এসি রুম, রুমের বাইরে অনবরত চেঁচামেচি করতে থাকা এসিস্ট্যান্ট, অপেক্ষমাণরত রোগীদের তাগাদা, ফিটফাট মেডিকেল রিপ্রেসেন্টিটিভদের আনাগোণা, কেউ রিপোর্ট দেখাতে এসেছে, কেউ ২ মাসের পুরাতন রোগী তাই ২০০ টাকা ভিজিট কম, দেখানো শেষে পাঁচশ হাজার ভিজিট দিয়েও আক্ষেপ ডাক্তার সাহেব কথা শোনেননি গুরুত্ব দিয়ে। ডাক্তারের চেম্বার বলতে চোখের সামনে এই চিরচেনা দৃশ্য ভেসে উঠে। এবং সেখানে রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস ফেরত কিশোরী, মজুর কিংবা একে বারেই খেটে খাওয়া মানুষের যাওয়ার সুযোগ নেই, সামর্থ্য ও নেই।
কিন্তু ঠিক এর উল্টোটিই একজন চিকিৎসক গত ২০ বছর ধরে করে আসছেন। ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবার জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা। সরকারি চাকরি আর ব্যক্তিগত চেম্বার করে হাঁপিয়ে উঠা ডাঃ সামির হোসেন মিশু বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় সময় কাঁটান। আড্ডার ফাঁকে বন্ধু বান্ধব থেকে শুরু করে চা দোকানি, রিকশা চালক, নিম্ন আয়ের মানুষ তাঁর কাছে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে আসলে তিনি খুশিমনে হাতের কাছে যা পান টুকরো কাগজে ব্যবস্থাপত্র দেন। বগুড়ার টাউন ক্লাবের সামনের রাস্তা এভাবেই হয়ে উঠে ডাঃ মিশুর মধ্য রাতের চেম্বার। মধ্য রাত কারণ দৈনন্দিন ব্যস্ততার পর রাত ১১টার পরেই সুযোগ মেলে আড্ডা দেবার। সেই আড্ডা উপকারভোগীদের মুখে এত সুনাম পায় যে আগে থেকে দরিদ্র রোগীরা এসে অপেক্ষা করে ডাঃ মিশুর জন্য। শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁদের বসার জন্য কিছু প্ল্যাস্টিকের চেয়ারের ব্যবস্থা করে, চিকিৎসকের টেবিল এবং ছাপানো প্যাডেরও যোগাড় করে স্থানীয়রাই। বিনামূল্যে শুধু চিকিৎসা সেবাই না, প্রয়োজনে ওষুধের ব্যবস্থা, সমাজসেবা বিভাগের সহায়তা পেতে সাহায্য করা, এমনকি অনেক গরীব রোগীকে স্বল্প মূল্যে অস্ত্রপ্রচারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ডাঃ মিশু।
সমসাময়িক চিকিৎসকদের তুলনায় ডাঃ মিশু আর্থিক, পেশাগত দিক থেকে খুব বেশি এগিয়ে না হলেও শুধুমাত্র মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে এ সেবা দিয়ে আসছেন, এতগুলো মানুষের ভালোবাসা বাড়তি পাওয়া বলে তিনি মনে করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্র বর্তমানে বগুড়া সদর উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। চিকিৎসকদের পেশাজীবী সংগঠন বগুড়া বিএমএর জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং স্বাচিপের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। ডাঃ মিশুর বাবা ডাঃ সাফদার হোসেন ১৯৯৬ সালে মারা যাবার পর তিনি বাবার স্মৃতিকে ধরে রাখতে স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম শুরু করেন।
সভ্য সমাজের মানুষ হিসেবে চিরকাল শুধু নিয়েই গেলাম, ডাঃ মিশুর মত কয়েকজন মানুষ আজও নিঃস্বার্থ ভাবে দিয়ে যাচ্ছে বলে, দেনা পাওনার হিসেবে এ সমাজ সংসার টিকে আছে। গরীবের কাছ থেকে ভিজিট নেন না, এটা হয়ত টাকার অংকে খুব বড় কিছু নয়, কিন্তু বগুড়ার শহরের খেঁটে খাওয়া মানুষের কাছে ডাঃ মিশু একটি স্বস্তির নাম, ভরসার নাম যিনি হাসিমুখে এই মানুষগুলোর সুখ দুঃখের কথা শুনবেন, দ্বিতীয়বার দেখা হলে নিজ থেকেই খোঁজখবর নেবেন।
চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সংগঠন “প্ল্যাটফর্ম” এর কাজের অংশ হিসেবে দেশজুড়ে বিভিন্ন চিকিৎসকদের সাথে পরিচয় এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাবার সুযোগ হয়েছে। এর মাধ্যমে এমন কিছু ব্যক্তির সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছে নির্দ্বিধায় যারা মেডিকেল সেক্টরে আইডল বা আদর্শ চিকিৎসক ব্যক্তিত্বের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেন। আমাদের দেশে নামকরা চিকিৎসক, সেরা অধ্যাপক আছেন, কয়েকটি মেডিকেল কলেজের মানুষের কাছে পরিচিতি সীমাবদ্ধ এমন গুণী শিক্ষক আছেন, কিন্তু পুরো মেডিকেল কম্যুনিটির কাছে পরিচিত অনুসরণীয় চিকিৎসকের বড় অভাব, মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষ থেকেই আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এত বড় প্রফেসর হতে হবে চেম্বারে যেন সব সময় রোগীর লাইন ধরে থাকে। বড় প্রফেসর হতে গিয়ে হয়ত মেডিকেল কলেজ আর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের চাপে পিষ্ট হয়ে ভেতরে মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষটাই হয়ত মরে যায়, এই সিস্টেম মেরে ফেলে। ডাঃ সামির হোসেন মিশুর মত চিকিৎসকেরা হয়ত হাজার চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণার পথ প্রদর্শক হবে তাই “আলোর পথযাত্রী” সিরিজের প্রথম কিস্তি “গরীবের ডাক্তার”।
ডাঃ মিশুর সাথে কয়েক ঘন্টাঃ আড্ডা, গান, চা আর একদল প্রাণ খোলা মানুষের সাথে কাটানো কয়েক ঘন্টা সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। আড্ডায় শুধু চিকিৎসক নয় এলাকার বড় ভাই, শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, একটু পর পর চা সার্ভ করা চা দোকানি, কাজ শেষে ঘর ফেরা ফেরিওয়ালা অথবা পুলিশের কর্তাব্যক্তি, মিশু ভাইয়ের গুণমুগ্ধ সাংবাদিক, রোগী সবার জন্য উন্মুক্ত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বড় হওয়া ডাঃ মিশু সেই ধারা এখনো ধরে রেখেছেন। আড্ডায় খালি গলায় একের পর এক গান গাওয়াচ্ছেন, নিজে গাইছেন, বগুড়া শহরে পহেলা বৈশাখ ঈদ পার্বণ যে কোন উৎসবের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা এখানেই হয়। টাউন হলের মোড়ে আসতেনা আসতেই সাত মাথায় গত পহেলা বৈশাখে যে হাজার মানুষের জমায়েত অথবা গেল ঈদেও পূনর্মিলনী যে অনুষ্ঠান নামিয়েছেন খুব তৃপ্তির সাথে বললেন। দেশের নামকরা অনেক গুণী শিল্পী উত্তরবঙ্গে গেলে সাত মাথায় এসে যে চা খেয়ে যান সেটিও জানালেন, এইতো সেদিন ও সুবীর নন্দী ডাঃ মিশুর আড্ডায় এসেছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কথা উঠতেই ডাঃ মিশুর দৃষ্টি উজ্জ্বলতর হলো, গোঁফের আড়ালে বিনয়ী হাসিটা আরেকটু চওড়া হলো। এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন সেই ফুটবল খেলার দিনের কথা, আজকের মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শ্রদ্ধেয় অমি রহমান পিয়াল ভাইয়ের সাথে জুটি বেঁধে গিটার বাজানো-কলেজের প্রতিযোগিতায় গান না শিখেও তখনকার রেডিওতে এনলিস্টেড মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হারানোর গল্প, এরশাদ পতনের সেই আগুন ঝরা দিনগুলোর কথা, তাঁদের সময় ইন্টার্ন হোস্টেলে আতাতায়ীর গুলিতে ডাঃ মিলনের(চট্টগ্রামে) নিহত হবার ঘটনা, এর সাথে জড়িয়ে মিথ্যে মামলা, বর্তমান মেয়র আ জ ম নাসির ভাইয়ের সাথে স্মৃতি। স্মৃতি যেন একটুকরো আয়না কখনো কখনো সেখানে চোখ রাখলে চোখ ফেটে অশ্রু বেড়িয়ে আসে যেন সূর্যে ঝাঁঝাঁ করে চোখ, বুকের ভেতরটা ফাঁকা। কি ফেলে এসেছি, আর কি রেখে যাবো। ভালোবেসে ঘর বাঁধা সহযাত্রী স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ে কে রেখে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
রাত বাড়ছে, স্নেহময় বড় ভাইয়ের মত আড্ডার লোকদের তাড়া দেন এবার বাড়ির ফিরতে হবে। ধীরে ধীরে ঘরে ফেরে তাঁর স্পর্শে আলোকিত কিছু মানুষ। একটা মানুষের জীবনে এর চেয়ে হয়ত বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না, চায়ের দোকানে যে লোকটা ফুটফরমায়েশ খাটছিল, রাস্তার মোড়ে একজোড়া গাঢ় লাল চোখ যার কথা ঘুমে কিংবা অন্য কিছুতে জড়িয়ে যাচ্ছিল তারা কেউ মিশু স্যারকে একা বাড়ি ফিরতে দেবে না। প্রতি রাতে আড্ডা ভাঙ্গলে এরাই রিকশা ডেকে হোক, হেঁটে হোক তাঁদের প্রাণ প্রিয় মিশু স্যারকে নিরাপদে বাড়ি পর্যন্ত এসে দিয়ে যায়।
অভিনন্দন মোহিব নীরব ভাইকে। বিষয়টি তুলে ধরার জন্য।