৪০ ভাগ চিকিৎসক আসলেই কি অনুপস্থিত?
একটা মারাত্নক স্টান্টবাজি শুরু হয়েছে। স্টান্টের ধরণ এবার রাজনৈতিক না হলেও প্রশাসনিক।
দুঃখ হলো এই স্টান্টের খড়গ নেমে এসেছে শুধু ডাক্তারদের উপর। আবার ডাক্তার বিদ্বেষী জনতার কাছে ফেইসবুকে এই স্টান্টবাজির খবর চড়া দামে বিক্রী হচ্ছে, মানে লাইক/শেয়ার হচ্ছে!!
চিকিৎসকরা ফাঁকিবাজ।
চিকিৎসকরা ডিউটি করে না।
চিকিৎসকরা গ্রামে থাকে না।
চিকিৎসকরা অননুমোদিত ভাবে হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকেন।
আপনি উপরের যে কোন একটা লাইন লিখে স্ট্যাটাস দিন। লাইকের বন্যায় ভেসে যাবে টাইমলাইন।
ডাক্তাররা কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন না এই রূপকথা সব বাজারেই খুব উচু দামে বিক্রি হয়।
হাসপাতাল এবং পুলিশ স্টেশন কিন্তু ২৪ ঘন্টার মধ্যে ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। খোলা রাখতেই হয়। একবার ভাবুন তো এই ২৪ ঘন্টা কি করে চিকিৎসকরা কাজ করছেন। মানে অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তাগণ যখন অফিস শেষে বাড়ি ফিরলেন, তখনো একজন চিকিৎসক হাসপাতালে পড়ে আছেন। ব্যাপারটা বাংলাদেশের ডাক্তারদের জন্য কতোখানি অমানবিক জানতে হলে আপনাকে দুটো দিন কষ্ট করে হাসপাতালে থাকতে হবে।
একজন চিকিৎসক সারা রাত নাইট ডিউটি করলেন, কিংবা টানা সকাল, বিকাল এবং রাতের ডিউটি করলেন। এরপর সকাল বেলা অন্য চিকিৎসককে হ্যান্ড ওভার বুঝিয়ে দিয়ে যখনই বিশ্রামে যাবেন, ঠিক তখনই যদি স্টান্টনায়কদের দল হাসপাতালে উপস্থিত হন তবে তো সেই চিকিৎসককে “অনুপস্থিত” ই দেখতে পাবে, তাই না?
তারমানে অনুপস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে চিকিৎসকদের সকাল, বিকাল, রাত এমন করে ২৪ ঘন্টাই হাসপাতালে থাকতে হবে আর এভাবে সপ্তাহে ৬ দিনই।
ও ভালো কথা, শুক্রবারে কিংবা পূজা-ঈদের ছুটিতেও কিন্তু হাসপাতাল বন্ধ থাকে না। শুক্রবারে অবশ্য স্টান্টনায়করা হাসপাতাল পরিদর্শনেও যান না! যদি যেতেন, তবে দেখতে পেতেন, সেই দিনও হাসপাতালে চিকিৎসক তার চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলা পর্যায়ে একজন ইউএনও এর অধীনে ২/৩ জন কর্মকর্তা থাকেন। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অধীনে থাকেন মোটামুটি ২১ জন কর্মকর্তা (বর্তমান অর্গানোগ্রামে) এদের মধ্যে ১০ জন থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মানে তারা প্রত্যেকেই ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন পান এবং ইউএনও এর সমমর্যাদার কর্মকর্তা।
অর্থাৎ রাষ্ট্র মনে করে ৫০ শয্যার হাসপাতাল চালাতে এই ২১ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। কিন্তু এখানে বাস্তবতা ২ টি।
বাস্তবতাঃ ১। কখনোই এই ২১ টি পদে সবগুলোতে চিকিৎসক পদায়ন হয় না। বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগের বেশী উপজেলা হাসপাতালে এই ২১ জন করে চিকিৎসক নেই।
বাস্তবতাঃ ২। ৫০ বেডের হাসপাতাল ৫০ এর চেয়ে অধিক রোগী দিয়েই শতকরা ৯০ ভাগ সময় ভরা থাকে।
আমি যখন রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলা হাসপাতাল থেকে অন্যত্র বদলী হই, তখন হাতে গোণা ৩ জন মেডিকেল অফিসার আর ২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। ২১ জনের কাজ করেছেন ৫ জন ডাক্তার! হাসপাতাল কিন্তু রাষ্ট্র বন্ধ করে নি। তার মানে মাসের ৩০ দিনের মর্নিং ইভিনিং নাইটের ৯০ খানা ডিউটি এই ৫ জন চিকিৎসক করেছেন।
এখন যদি আমার ঐ হাসপাতালে স্টান্ট সাম্রাজ্যের কোন মুকুটহীন সম্রাট গিয়ে উপস্থিত হন এবং সারাদিন সারারাত ডিউটি করা কোন চিকিৎসককে অনুপস্থিত দেখে তাকে শো কজ/শাস্তির ব্যবস্থা করেন – তাহলে বুঝে নিতে হবে একটি অসুস্থ সিস্টেমের বলি হচ্ছেন ডাক্তাররা।
এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। আমি একটা টুকরো গপ্পো শোনালাম।
বলে রাখা ভালো, আমি কারো সাফাই গাইছি না। এদেশের চিকিৎসক এদেশেরই সন্তান। বাংলাদেশের মানুষেরা সবাই তো আর দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নন। আর ফাকিবাজ মানুষ সব পেশাতেই কিছু কিছু থাকেই।
এই যেমন ধরুণ, আমি ইন্টার্নী যখন করি, আমার সার্জারী বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে আমার পুরো ইন্টার্নীর সময়ে দেখেছিলাম মাত্র ৪/৫ দিন। প্রশাসনকে তিনি এমন গুড় খাইয়েছিলেন, যে তিনি ধরা ছোঁয়ার উর্ধ্বেই ছিলেন হয়তো। যদিও আমার বাকি শিক্ষকেরা তার অনুপস্থিতি বুঝতে দেন নি কোনদিন। সুতরাং এমন ডাক্তারও বাংলাদেশে আছে। কাজ না করে অনেক পেশার মানুষই এদেশে বেতন নিয়েছে, নিচ্ছে।
কিন্তু নিউজে যখন পড়ি শতকরা ৪০ ভাগ চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত, তখন লজ্জা হয়।
লজ্জা হয় না এই কারনে যে আমি একজন চিকিৎসক।
লজ্জা হয় এই কারনে কেন আমার ৫ জন সহকর্মী ২১ জনের ওয়ার্কলোড কাঁধে নিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন রেখেছিলো জনগণের স্বাস্থ্যসেবা।
আমি এখন যে হাসপাতালে আছি, শুক্রবারেও আমাদের হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার, আইএমও, সহঃরেজিস্ট্রার, রেজিস্ট্রার, আরএস এবং ক্ষেত্রবিশেষে সিনিয়র চিকিৎসক দেরও হাসপাতালে আসতে হয়।
কাদের জন্য করি এই অতিরিক্ত পরিশ্রম?
কীসের আশায় দেখাই অতিরিক্ত ডেডিকেশন?
একদিন আমিও তো শিরোনাম হবো।
এভাবে শিরোণাম হবার জন্য আমাদের মা-বাবা আমাদের ডাক্তারী পড়িয়েছিলো?
কেউ কিচ্ছু মনে রাখবে না,
আমরা কী করেছিলাম, কতোখানি করেছিলাম!
কেউ মনে রাখবে না, এদেশের হাসপাতালগুলো দুর্যোগে-উৎসবে-মহামারীতে কীভাবে খোলা ছিলো ২৪ ঘন্টা?
#হঠাৎ_হানা
#দিতে_নেই_মানা
#যদি_থাকে_জানা
#পুরো_গপ্পোখানা
কলাম লিখেছেনঃ ডা. রাজীব দে সরকার