(ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজির বিভাগীয় প্রধান ডাঃ সঞ্জয় কুমার সাহার সৃতিচরনে লিখেছেন- আহসান কবির পিয়াস)
‘রোল থার…টি টু’
শীতের সকালটায় থার্ড ইয়ারের প্রথম দিকের ক্লাস। বরাবরের মতই লাস্ট বেঞ্চে বসে গল্পের বই পড়ছিলাম। পাশের জন ধাক্কা দিয়ে বলল ‘ অই তোর রোল চইলা গেল’।
‘ধুর পারসেন্টজ টা মিস করলাম’। সবাই একসাথে কথা বলছে। এভাবে’ সিক্স এইট সেভেন্টিন”… উল্টা পাল্টা ডেকে স্যার মনযোগ তার দিকে নিচ্ছিলেন।অবাক হচ্ছিলাম ,অন্য যে কেও হলে বকতেন। কিন্তু এটা,’ সঞ্জয় স্যার!’। জানতাম না স্মিত হাসির এই মানুষটার স্টাইলটা একটু আলাদা।
ব্যাপার না, জানতাম পারসেন্টেজ দেবেই। যদিও এটাও জানতাম না স্যার হয়তো বলতে পারবেন আমি ক পাতা পড়লাম, পারবেন ক্লাসের কোন ছেলেটা কোন মেয়েটা কোন টপিক পড়ানোর সময় কি করছিল, জানতাম না মানুষটা দু’শজনকেই খেয়াল করেন।
রোল কলের শেষে দাড়ালাম, “স্যার, থারটি টু”
হাসলেন, বললেন ” পরে, আমার রুমে এসে পারসেন্টেজ দিয়ে যাবে।”
গেলাম। আমি আমার মতই গিয়েছিলাম।কাকের বাসার মত চুল, পড়নে কালো হুডি, জিন্স, সকালে স্যান্ডেল না খুজে পাওয়ায় স্পঞ্জ। হু কেয়ারস..
মাইক্রো- প্যাথোর করিডোর টা পার হয়ে কোনার দিকের রুম।
দরজায় গিয়ে বললাম, “স্যার আসতে পারি”
বললেন “হ্যা, এসো।”
ভেতরে বন্ধু নিলয় শুভ আইটেম দিচ্ছিল ‘স্টেরিলাইজেশন’.. স্যার এই আইটেমটা নিজেই নেন (!) এবং হ্যা, উনি একজন ডিপার্টমেন্টাল হেড।
গ্যালারিতে দূর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু এখন নিজের দিকে তাকিয়ে স্যারের দিকে তাকাতে আমারি লজ্জা করতে লাগল। ইন করে পড়া চেক শার্ট ,ব্লেজার আর প্যান্ট এ স্ট্যালিনের মত পাকানো গোফের টকটকে গৌর বর্ণের মানুষটাকে অসম্ভব গোছালো আর সুন্দর লাগছে।
“স্যার রোল বত্রিশ, আমার পারসেন্টেজ টা” বললাম।
স্যার বললেন ” তোমার ক্লাস নোট কোথায়? Show me your lecture notes”
বিপদে ফেললেন।
আমি আমার মতই কাজ করলাম। কি টপিক পড়ানো হয়েছে তাই জানি না,আবার ক্লাস নোট!…. বন্ধু আসলামের খাতার দু পাতা কপি করে নিয়ে চলে গেলাম।
আবার স্যারের রুমে….
” স্যার…” এই বলে ছেড়া কাগজ দুটো এগিয়ে দিলাম।
উনি সে দুটো নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন। আবার হাসলেন, তার সুন্দর উচ্চারনে আবার বললেন ” If I am not wrong, তুমি এটা আরেকজনের খাতা থেকে কপি করে নিয়ে এসেছো”
নিচের দিকে তাকিয়ে বলে ফেললাম ” জি স্যার”
আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে পারসেন্টেজ এর খাতাটা বের করে বললেন
” You were honest, তাই পারসেন্টেজ দিলাম। আর তোমার শুধু পারসেন্টেজ লাগলে রুমে এসে বলো। আমি দেব। কিন্তু ক্লাসে থাকলে মনযোগ দেবে।”
আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। এই মাত্র অতি বাজে ধরনের একটা অপরাধ নিজ মুখে স্বীকার করলাম, কিচ্ছু বলল না। একটা ঝাড়ি না, একটা ধমকও না। আমার সমস্ত অপরাধ একটা কথায় মাফ করে দিলেন।
বের হয়ে আসব পেছন থেকে ডাকলেন, “শোন”
ঘুরে আবার গেলাম, নরম গলাতেই বললেন ” You must were an apron before entering a teachers room, তোমার এপ্রন কোথায়?”
আমি এই মেডিকেলের তিন বছরের জীবনে সেই প্রথম কোন স্যারের কথায় লজ্জা পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আসলে নিজেকে পরিবর্তন করাটা দরকার । হাজার অপমান করেও সমস্ত স্যার মিলেও যা কোনদিন আমাকে অনূভব করাতে পারেন নি, হেসে কয়েকটা কথা বলে মানুষটা সেটা করে ফেললেন।মন থেকে সেদিন মাথা নিচু করেছিলাম, করতে হয়েছিল।
মেডিকেলে প্রায় ঈশ্বর এর সমান ক্ষমতাধর এক একজন ডিপার্টমেন্টাল হেড এর কাছে সামনের সারির অল্প ক জন বাদে আমরা শুধুই এক একটা রোল নাম্বার, Just another brick in the wall.
একজন মানুষ আমাদের ডাকনামগুলো জানতেন। সে নামে ডেকে আমাদের অবাক করতেন। আমরা কে কেমন খেয়াল করতেন। ঝরে যেতে থাকা পড়ালেখা না করা ব্যাক বেঞ্চারদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করতেন। এ মেডিকেলে এখন আর কেউ নেই যে বলবে ” আমি ক্লাসের পরে থাকব, তোমাদের পড়া হয়ে গেলে এসে পরীক্ষা দিয়ে যেও, যে কোনদিন”
গতকাল আমি মাইক্রোবায়োলজি কার্ড নিয়ে স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। বরাবরের মতই আমার কার্ড ক্লিয়ার নাই। পড়ি নাই, পরীক্ষা দেব কি দেব না স্যারকে জিজ্ঞাসা করবো। অন্য যে কেও হলে সাহস করতাম না। কিন্তু ওই যে ” সঞ্জয় স্যার!”
সময়টা সাড়ে বারটা। পরীক্ষা চলায় অনেক পিওনও নিজেদের ছুটি নিজেরা দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু সঞ্জয় স্যার…
টিচার্স লাউঞ্জে গেলাম। এক কর্মচারীকে বললাম “সঞ্জয় স্যার কি আছেন ?”
“স্যার ছিলেন, টিচার্স লাউঞ্জের চেয়ার বের করতেছিলাম তো ভরতি পরীক্ষার জন্য তাই চলে গেলেন, এই দুই মিনিট আগে। কালকে আইসেন। পাবেন।”
জানতাম,কেও না থাকলেও স্যার সবসময় আফিস টাইমে কলেজে থাকবেন। কাজ নেই? ক্লাস নেই? তাতে কি, নিজেই পড়বেন। কিন্তু দুই মিনিট দেরী হয়ে গেল।দেখা হল না ,আর হবে না। It’s now or never……
হ্যা, আমি আপনিও মারা যাব। পথে চলতে, অসুখে দু মাস বিছানায় শুয়ে , অথর্ব বৃদ্ধ হয়ে রোগে শোকে, অনেকভাবেই। এটা নিশ্চিত, আমাদের করা শেষ কাজটা “একটা মাইক্রোবায়োলজি স্লাইড দেখা” হবে না। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে করতে, কাজ করতে করতে হুট করে চলে যেতে পারব না। কারনটা সহজ, আমরা কেও ডা: সঞ্জয় কুমার সাহা নই।
স্ত্রীর , পুত্রের, মায়ের মুখ নয় ….সজ্ঞানে স্যারের শেষ দেখা জিনিসটা হয়ত কোন অনুজীব… ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ,ফাংগাস, প্যারাসাইট।
আমাদের সেই ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হবে না। আমরা কেও তার মত অসাধারন নই।
আমি একবার ফেসবুকেই লিখেছিলাম স্যার এত ক্লাস নেন স্যারের ক্লাসের দাম চার আনা। আমি এখন দুনিয়ার সমস্ত কিছুর দামে স্যারের আর একটা ক্লাস করতে চাই। কথা দিচ্ছি ,এবার আর ইচ্ছা করে দেরিতে ঢুকব না, ফারস্ট বেঞ্চে বসব। গল্পের বই পড়ব না, মনযোগ দেব। ক্লাস নোট নেব। আর হয় না, না? সাড়ে এগারটা বাজলে এখন আমরা কি করব…….
আমাদের স্যারের নামের আগে কোন ডেজিগনেশন দরকার নেই ,শেষে কোন ডিগ্রীর দরকার নেই। কারন সবসময় তার প্রতিটি ছেলে মেয়ের মনে উনার নেম প্লেটটা….
Dr. Sonjoy Kumar Saha
A Father, A Mentor, A Legend
Rest in peace Sir……..