লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ইতালীয় রেনেসাঁসের কালজয়ী চিত্রশিল্পী।তাঁর হাত থাকে যা কিছু বের হয়েছে পৃথিবীর শিল্পকলার ভান্ডার তাতে সমৃদ্ধ না হয়ে উপায় নেই । তাঁর একেকটা কাজ শতাব্দীর এক একটা আরাধ্য শিল্পকর্ম । ভিঞ্চির মত এমন প্রতিভাবান আর রহস্যময় শিল্পী সেই শতাব্দীতে খুব কম মানুষই ছিলেন । তাঁর ছবিগুলোতে উদ্ঘাটিত রহস্যের চেয়ে অনুদ্ঘাটিত রহস্য এখনো শিল্পবোদ্ধাদের গবেষণার বিষয় ।তার বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপার,সালভাতোর মুন্ডি উল্লেখযোগ্য।
যাই হোক,আমাদের এই লিওনার্দোর একটা সমস্যা ছিল তিনি ছোটবেলায় ঠিকমত পড়তে-লিখতে পারতেন না । চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যেটাকে “ডিসলেক্সিয়া” বলা হচ্ছে । ডিজলেক্সিয়া একটি শিখতে না পারাজনিত সমস্যা। ২০০৭ সালে বলিউডে আমির খানের “তারে জামিন পার” নামে একটা মুক্তি পেয়েছিল যেখানে ৮বছরের একটা ছেলের এই সমস্যা থাকে । ছবিতে বাচ্চাটাকে দেখা যায় কিছু কিছু অক্ষর সে উল্টাভাবে লিখছে ।তাঁকে বারবার করে দেখিয়ে দেবার পরও একই ভুল করছে। তাতে তার বাবা-মা ভাবে সে ইচ্ছা করেই বদমাশি করছে । কিন্তু ব্যাপারটা তা নয় । তাঁর মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট কিছু অক্ষর বা বর্ণকে ঠিকভাবে আয়ত্ব করতে পারে না । পড়ে একজন শিক্ষক তার এই অক্ষমতাকে ধরতে পারেন ।সঠিকভাবে গাইড করেন এবং একসময় সে আর আট-দশটা সমবয়সীদের মতই লিখতে-পড়তে শুরু করল ।
১৮৭৮ সালে জার্মান স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এডলফ কাসমাউল প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের স্নায়ুগত বিকলতা ও পড়তে না পাড়াজনিত সমস্যার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন।তিনি দেখতে পান যে তার অধিকাংশ রোগীই ঠিকভাবে পড়তে পাড়ে না এবং প্রতাহ্যিক জীবনে ভুল শব্দ ভুল ক্রমে ব্যবহার করে।তিনি এ সমস্যাকে “শব্দ অন্ধত্ব “নামে অভিহিত করেন।
১৮৮৭ সালে জার্মান চক্ষু বিশেষজ্ঞ বার্লিন সর্বপ্রথম শব্দ অন্ধত্বের পরিবর্তে জার্মান শব্দ ডিজলেক্সিয়া ব্যবহার করেন।
৭ নভেম্বর ১৮৯৬ সালে প্রিংগেল মরগান ব্রিটিশ জার্নালে ডিজলেক্সিয়ার আক্রান্ত রোগের ব্যাপারে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক বিখ্যাত কিছু মানুষ আছেন যারা এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন । বিখ্যাত চিত্রকর এবং ভুবনখ্যাত ভাস্কর্য পাবলো পিকাসো, কার্টুন দুনিয়ার বাদশা ওয়াল্ট ডিজনি,প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন,বিদ্যুতের জনক টমাস আলভা এডিসন,বলিউড অভিনেতা অভিষেক বচ্চন ।
ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিগণ সাধারণত ঠিকমত পড়তে পারেন না, উচ্চারণ করতে পারেন না, পারেন না ঠিকমত লিখতে। তবে, এটি বুদ্ধিমত্তায় কোন ধরণের প্রভাব ফেলে না। সময়ের সাথে নানা ধরণের সাহায্যের মাধ্যমে এই সমস্যা আস্তে আস্তে কমে আসে বলে গবেষণায় দেখা গিয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের জন্য তৈরি বিশেষ ধরণের স্কুলে বা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ ধরণের বই পড়ে ও বিশেষ ধরণের সুবিধায় লিখে এই রোগ ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে যেতে পারে এবং এই ধরণের ব্যক্তিরাও জীবনে সফল হতে পারে। এরা যদিও আস্তে পড়ুয়া হয়, কিন্তু এদের চিন্তা করার ক্ষমতা অনেক সময় সাধারণ অনেক মানুষের থেকেও বেশী হয়ে থাকে। আমেরিকায় শতকরা ২০ জনের মধ্যেই এই ধরণের সমস্যা দেখা যায়। এবং সঠিকভাবে পরিচর্যিত ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত মানুষজন জীবনে সফলও হয়।
ডিজলেক্সিয়ার কারণঃ ডিজলেক্সিয়ার জন্য জিন ও পরিবেশ উভয়ই দায়ী। পারিবারিক ইতিহাসে কেউ ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত আছে এমন কোন পূর্ব রেকর্ড থাকলে, ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গবেষণায় আরও দেখা যায়, ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত ব্রেণের বাঁ অংশ যা কিনা আমাদের কোন কিছু পড়ার কাজে সহায়তা করে থাকে, তাতে কম ইলেক্ট্রিকাল অ্যাক্টিভেশন দেখা যায়। ডিজলেক্সিয়ায় আক্রান্ত অনেকের গলার মাংশপেশীতেও সমস্যা দেখা যায় যার কারণে তারা ঠিকমত উচ্চারণও করতে পারে না।
ডিজলেক্সিয়ার লক্ষণঃ যেহেতু ডিজলেক্সিয়া কোন নির্দিষ্ট বয়সের মানুষ নয়, যেকোন বয়সের মানুষই আক্রান্ত হতে পারে। বয়সভেদে ডিজলেক্সিয়ার লক্ষণ বিভিন্নরকম হয়ে থাকে।
প্রি-স্কুল সময়েঃ
১। সহজ ছড়াগুলো বলতে না পারা(যেমনঃ টুইংকেল টুইংকেল),
২। বর্ণমালা শিখতে, পড়তে ও মনে রাখতে সমস্যা হয়,
৩। নিজের নামের অক্ষরগুলো পড়তে না পারা,
৪। Cat, Rat, Bat – এর মত সহজ শব্দগুলোও উচ্চারণ করতে সমস্যা হয়।
১ম শ্রেণীতে পড়ার সময়েঃ
১। ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসা শব্দ বুঝতে না পারা,
২। পড়ার সময়ে শব্দ হারিয়ে যায়,
৩। শব্দের সাথে বর্ণ মেলাতে পারে না।
মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়েঃ
১। খুব ধীরে পড়া,
২। অপরিচিত শব্দ পড়তে সমস্যা হওয়া,
৩। জোরে না পড়া,
৪। পড়ার আগ্রহ কমে যাওয়া,
৫। কোন কিছুর নাম না বলে, “ঐ জিনিস”, “ঐ বস্তু” বলে চালিয়ে দেয়া,
৬। কথা বলতে গেলেই থেমে থেমে যাওয়া এবং “উমম”, “ইয়ে” উচ্চারণ করা,
৭। শব্দ গুলিয়ে ফেলা,
৮। বড়, অপরিচিত শব্দ ভুলভাবে উচ্চারণ করা,
৯। কোন পড়া পড়তে, লিখতে বা প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশী সময় নেয়া,
১০। তারিখ বা অন্যান্য নাম্বার মনে রাখতে না পারা,
১১। বাজে হাতের লেখা,
১২। বিদেশী ভাষা শিখতে সমস্যা হয়।
পূর্ণবয়সেঃ
১। মানুষের নাম, জায়গার নাম ভুলভাবে উচ্চারণ করা,
২। পুনরাবৃত্তি করতে সমস্যা,
৩। আনন্দের জন্য পড়া এড়িয়ে চলা,
৪। জোরে না পড়া,
৫। সবাইকে এড়িয়ে চলা,
৬। ‘b’ এবং ‘d’ – এর মধ্যে গুলিয়ে ফেলা,
৭। সবকিছুতে অগোছালো হয়ে পড়া।
ডিজলেক্সিয়া চিকিৎসায় প্রযুক্তি ব্যবহারঃ
আমেরিকার কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ সম্প্রতি উদ্ভাবন করেছেন এমন এক কম্পিউটার যা মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি অর্থাৎ শরীরের ভাষা বুঝতে সক্ষম।
বিশেষ এই কম্পিউটার মুখের বিভিন্ন অভিব্যক্তি ও হাতের ইশারা বুঝতে সক্ষম। এছাড়া প্রথম বারের মতো এই কম্পিউটারে এমন এক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যার মাধ্যমে এটি আঙুল নাড়াচাড়ার অর্থও বুঝতে পারে। এই প্রযু্ক্তি উদ্ভাবনের জন্য কাজে লাগানো হয়েছে প্যানোপটিক স্টুডিও, যাতে ব্যবহৃত হয় ৫০০টি ক্যামেরা।
এই প্রযুক্তি অটিজম, ডিজলেক্সিয়া ও ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ফিচার ডেস্ক
নাহিদ নিয়াজ
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল