#হেলথ_এডুকেশন_স্কিম
দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্রমোন্নতির ধারায় বেশ কয়েক বছর যাবত মেডিকেল ইউনিভার্সিটির অধীনে মেডিকেল ইন্সটিটিউট ও মেডিকেল কলেজের সমন্বয়ে পরিচালিত হচ্ছে রেসিডেন্সি কোর্স। মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও পেডিয়াট্রিক্স এর নানান বিশেষায়িত শাখায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতিযোগিতা মূলক এসব কোর্সে ভর্তির জন্য প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন সারা দেশের এমবিবিএস করা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকরা। খুব কম সংখ্যক আসনের বিপরীতে শত শত চিকিৎসক প্রতিযোগিতা করেন। কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি যেমন কষ্টসাধ্য তেমনি কোর্সটি বিশেষায়িত বলে অধ্যয়ন কঠিন। ভর্তির সময় এককালীন মোটা অংকের অর্থ জমা দিতে হয়। মাসিক ভাতা দেয়া হয় কোর্সে অধ্যয়নকালে যা সব মেডিকেল কলেজ ও ইন্সটিটিউট এ নেই। বিএসএমএমইউ তে ( সর্বোচ্চ) ২০০০০ টাকা মাসিক ভাতা। ভার্সিটির নিজস্ব কোয়ার্টার বা ডর্ম না থাকায় পরিবার থেকে দূরে ঢাকা শহরের অন্যতম ব্যয়বহুল এলাকা শাহবাগে বাসা ভাড়া নিয়ে বা মেস করে দীর্ঘ ৫ বছর পড়াশোনা করতে হয়। এসময় একাডেমিক কারিকুলাম অনুযায়ী রেসিডেন্ট বা পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী হিসেবে হাসপাতালে কাজ করেন। অন্য কোথাও চাকরির সুযোগ বা অনুমতি নেই। ঢাকার বুকে পোস্ট গ্রাড শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট প্রাকটিস অসম্ভব এক ব্যাপার। সপ্তাহে একদিন ঢাকার বাইরে গিয়ে কেউ কেউ প্রাইভেট প্রাকটিস করে থাকেন। তা দিয়েই যাবতীয় সাংসারিক ব্যয়, একাডেমিক ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। তাই মেডিকেল পোস্ট গ্রাড পরীক্ষার সিজন এবং ভর্তির সিজনে একটা নিরব হাহাকার চারিদিকে ছড়িয়ে যায়। পরীক্ষা ফি ও কোর্স ফি জোগাড় করা নিয়ে সমস্যা। পরীক্ষা প্রস্তুতি নিবিড় ও নিরবিচ্ছিন্ন করতে টানা ৬মাস কি ১ বছর পড়াশোনার বাইরে চাকুরি, ক্ষ্যাপ, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি এড়িয়ে চলার ইতিহাস অনেকেরই আছে। যারা ইতিমধ্যে পোস্টগ্রাড করেছেন বা করছেন, এমন পরামর্শই দিয়ে থাকেন। কে না জানে, চিকিৎসাবিদ্যা রপ্ত করা সাধনার নামান্তর।
কিন্তু সময়টা এমন যে ৬ মাস – ১ বছর বসে থেকে খেয়ে পরে শুধু পড়াশোনার ভাগ্য সবার হয় না। চাকুরি বা ক্ষ্যাপের অবস্থা এমন যে প্রায় এক মাসের বেতন পরীক্ষার ফি দিতেই চলে যায়। এসব পার করে যিনি ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যান, তাঁর হাতে এককালীন এত টাকা জোগাড় করাও মুশকিল। যেহেতু পরবর্তী ৫ বছর আবারো সাধনায় ডুব দিতে পড়াশোনা ভিন্ন অন্য কিছু করার সুযোগ একাডেমিক কারিকুলামে নেই, তাই নিয়মিত চাকুরি বা ক্ষ্যাপ একটি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
পোস্ট গ্রাড করতে তাই ঋণ নিতে হয়। ব্যাংকগুলো সুদের উচ্চহার সহ লকলকে জিহ্বা নিয়ে বসে আছে লোন দিতে। সেজন্য চেম্বার ও চাকুরির নিয়মিত আয় কত তা দেখাতে হয়। এই দুটো জিনিস সদ্য ভর্তি হওয়া “ভবিষ্যত বিশেষজ্ঞ” দের থাকে না। তাঁরা হ্যান্ডলোন করেন, সেই লোন ফেরত দিতে ব্যাংকলোন করেন। ব্যাংকলোনের শর্ত পূরণে রাত্রিকালীন চাকরি বা নাইট ডিউটি ভিত্তিক জব অথবা ক্ষ্যাপের ব্যবস্থা করেন। ভার্সিটির দেয়া ভাতায় পকেট খরচ টা হলেও সংসার চালানো যে সম্ভব না তা নিশ্চয়ই জ্ঞানী ব্যক্তিরা বোঝেন ।
ওদিকে অর্থকড়ির হিসাব মেলাতে গিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী, আমাদের ভবিষ্যত বিশেষজ্ঞ, পরীক্ষামুখী শিক্ষার পথ ধরেন কিংবা তাঁর পূর্ববর্তী সকল সনদ ভুল প্রমাণ করে অমনোযোগী, ডামিশ শিক্ষার্থীতে পরিণত হন। বারবার অকৃতকার্য হয়ে কোর্স আউটের উদাহরণ তৈরি হচ্ছে।
পকেটের এই অবস্থায় জগতসংসারের অন্য কোনো দায় নেয়া সম্ভব হয় না বলে কিপটা, স্বার্থপর ( শুধু নিজেরটা বুঝে অর্থে), অসামাজিক (দাওয়াত রক্ষা করতে গেলেও তো কিছু খরচ হয়) ইত্যাদি বিশেষণ জোটে।
এটি কি সমস্যা?
যদি অনেকেই এমন সমস্যায় পড়ে থাকেন, তবে এটি জাতীয় সমস্যা। কারণ চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই বিশেষজ্ঞবৃন্দ দেশের ভবিষ্যত। তাঁদের সমস্যার প্রতিকার না করে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ রিটার্ন আশা করা অন্যায়।
যদি সমস্যা অল্প কয়েকজনের হয়, তাহলে তো খুব অল্পেই সমাধান সম্ভব।
কী করণীয়?
১. হেলথ এডুকেশন স্কিমের আওতায়, যারা এককালীন এত অর্থ দিতে পারবেন না, তাঁদের জন্য মাসিক কিস্তিতে অর্থ পরিশোধের স্কিম রাখা যেতে পারে।
২. যারা মাসিক কিস্তিতে অর্থ পরিশোধে অপারগ, কারণ টা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের জন্য বিনাসুদে একাডেমিক একটিভিটির জন্য সমুদয় অর্থ ঋণ হিসেবে দিতে হবে। সব পরীক্ষা পাশের পর মূল সনদ ও রেজিস্ট্রেশন পেতে তাঁকে এই অর্থ পাশ করার পর পরিশোধ করলেই হবে। প্রাকটিস করে বা জব করে অর্থ পরিশোধের সুবিধার জন্য তাঁকে সাময়িক সনদ দেয়া হবে।
৩. কোনো পরীক্ষায় কোনো পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হলেও একাডেমিক যত খরচ, ঋণ হিসেবে প্রদান অব্যাহত থাকবে। ব্যাংক/ভার্সিটি নির্ধারিত অধ্যাপকবৃন্দ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পরীক্ষার্থীদের দিবেন যেন তাঁরা আরো ভালো প্রস্তুতি নিতে পারেন। (এটা অবশ্য একাডেমিক কালচারে পরিণত করা সময়ের দাবি)
৪. এই স্কিম চালু এবং পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে ভার্সিটির অধীনে ফান্ড গ্রহণ করা যেতে পারে। উদীয়মান অর্থনীতির যুগে এই অর্থ কোনো ব্যাপারই না।
৫. ভার্সিটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে সুদবিহীন এই ঋণ ( যা আদতে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত খরচ নয়, একাডেমিক খরচ যা ভার্সিটি পাবে) প্রচলন করে উচ্চশিক্ষায় উদাহরণ তৈরি করা যায়। এই সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে।
৬. একাডেমিক কারিকুলাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে পেশাজীবী হিসেবে শিক্ষার্থী কে ভাবা হয়নি। বরং পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী হিসেবে ভাবা হয়েছে। তাঁর নিয়মিত আয়ের জন্য চাকুরির সুযোগ নেই। ৫ বছর চাকুরি ছাড়া কেবল পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা! ভাবা যায়!
২৫-২৬ বছরের (কোনো গ্যাপ ছাড়াই যিনি ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছেন। যাদের গ্যাপ আছে, তাঁদের কথা বলা বাহুল্য) তরুণ দের স্বাভাবিক আয়ের কোনো রাস্তা না দেখিয়ে এমন জমিদারি কায়দায় উচ্চশিক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেয়ার দায় তাঁদেরও আছে। তাঁরা আপামর শিক্ষার্থীর আর্থিক অবস্থা, দেশের অর্থনীতি ও মেধা তুলে আনার সর্বজনীন পদ্ধতিটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতা তাঁরা দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন আশা করি।
বাংলার তরুণ স্বনির্ভর। যোগ্যতা দিয়েই এগিয়ে যেতে চায়। দয়া দাক্ষিণ্য নয়, দিলে দিলাম না দিলে নাই জাতীয় ভাতা নয়, পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল অফিসারের সমান সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। ভার্সিটির চাকুরি করা কোনো মেডিকেল অফিসারই বিশেষজ্ঞ নন। তাই “পারদর্শী নন” এই অজুহাতে অপর্যাপ্ত ভাতা দিয়ে বসিয়ে রাখা যাবে না। পোস্ট গ্রাড শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট কাজ করেন।
একইসাথে, ভার্সিটি, ইন্সটিটিউট গুলোতে নিয়মিত মেডিকেল অফিসার অন্তত ৭০% যেন থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পোস্ট গ্রাড শিক্ষার্থী নির্ভর সার্ভিস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতিতে মেধার পরিচর্যা আবশ্যক। মেধাকে বন্দী রেখে উন্নয়ন আশা করা অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টা যত দ্রুত আমলে নিবেন, তত মঙ্গল।
ডা. মুরাদ মোল্লা
সিনিয়র মডারেটর, প্ল্যাটফর্ম