২২ জানুয়ারি ২০২০:
একজন মানুষের কি সম্পূর্ণ আলাদা দুই সেট ডিএনএ থাকা সম্ভব?
উত্তরটা হলো – হ্যাঁ! সম্ভব!
চলুন দেখা যাক এটা কিভাবে সম্ভব।
প্রাচীন গ্রীকপুরাণে কাইমেরা হচ্ছে এমন একটি প্রাণী, যার নিঃশ্বাসের সাথে আগুন বের হত। তার শরীর ছিলো সিংহ, ছাগল আর ড্রাগনের মিশ্রণ। মুখ থেকে আগুনের শিখা বের করার মত নাটকীয় না হলেও “মানব কাইমেরা” বাস্তবেই সম্ভব এবং অবশ্যই বিস্ময়কর। মানুষের মধ্যে কাইমেরা হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি যার শরীরে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই সেট ডিএনএ থাকে।
“মানব কাইমেরা” বিষয়টি বিস্ময়কর থেকেও বেশি কিছু, কারণ মানব কাইমেরা ভবিষ্যতের জিন গবেষণার ফলাফল নয়, বরং এটি প্রাকৃতিকভাবেই হয়। অনেক সময় মানুষ হয়তো বুঝতেই পারেন না যে তার ডিএনএ অন্য সবার চেয়ে এতটা আলাদা।
আসুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে একজন মানুষ সাধারণ মানুষ থেকে মানব কাইমেরাতে পরিণত হতে পারে।
বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন
বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা হলো আমাদের হাড়ের ভিতর থাকা এমন একপ্রকার টিস্যু বা কলা যা আমাদের রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা, লোহিত রক্তকণিকা এবং অণুচক্রিকা তৈরি করে থাকে।অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ কেমোথেরাপি অথবা রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত অস্থিমজ্জা ধ্বংস করে সেটি একজন দাতার সুস্থ অস্থিমজ্জা দিয়ে পুনঃস্থাপন করে দেন। দাতার অস্থিমজ্জা ধারাবাহিকভাবে রোগীর শরীরে রক্তকণিকা তৈরী করতে থাকবে যেগুলো দাতার জিন বা ডিএনএ সিকোয়েন্স বহন করবে। এভাবে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর একজন কাইমেরায় পরিণত হতে পারে।
“সম্পূর্ণ কাইমেরিজম” এর ক্ষেত্রে রোগীর শরীরের সমস্ত রক্তকণিকাই দাতার ডিএনএ বহন করে। আবার রক্তে দাতা এবং গ্রহীতা দুজনের ডিএনএ এর মিশ্রণও থাকতে পারে, যাকে বলা হয় “মিক্সড কাইমেরিজম”।
জরায়ুতে “ফ্রেটারনাল যমজ”
“ফ্রেটারনাল যমজ” হলো এমন অবস্থা যখন মায়ের দুটি ডিম্বাণু পিতার দুটি শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়, এবং দুটি নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে পরবর্তীতে দুটি ভ্রূণ গঠিত হয়। আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মতে, যখন একজন মা “ফ্র্যাটারনাল যমজ” ধারন করেন এবং একটি ভ্রুণ গর্ভাবস্থার শুরুতেই মারা যায়, তখন আরেকটি ভ্রুণ মৃত ভ্রূণের কিছু কোষ নিয়ে নেয়। ফলাফল স্বরূপ জীবিত বাচ্চাটি দুটি ভিন্ন ডিএনএ সেট নিয়ে জন্ম নেয়।
এমন কিছু কাইমেরার খবর উঠে এসেছে খবরের কাগজে। ২০১৫ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনে এক ব্যক্তি তার পিতৃত্বের পরীক্ষা করালে দেখা যায় তিনি তার ছেলের বাবা নন, বরং চাচা! পরবর্তীতে আরো পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় ঐ ব্যক্তির লালা এবং শুক্রাণু ভিন্ন ভিন্ন ডিএনএ বহন করে।
জিন বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন তিনি ছিলেন একজন “মানব কাইমেরা” এবং তিনি তার ফ্রেটার্নাল টুইন এর কিছু ডিএনএ ভ্রূণ অবস্থায় গ্রহণ করেন।
ক্যারেন কিগান নামের একজন নারীও একই ঘটনার স্বীকার হন। পরীক্ষায় বলা হয় তিনি জন্মসূত্রে তার সন্তানদের মা নন। কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষা নিরীক্ষায় ক্যারেনের রক্ত ও ডিম্বাশয়ে ভিন্ন ধরনের ডিএনএ এর দেখা মেলে। চিকিৎসকদের মতে এ অতিরিক্ত ডিএনএ তিনি তার ফ্রেটার্নাল যমজের কাছ থেকে পেয়েছেন। এ ঘটনা ২০০২ সালে “নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন “এ প্রকাশিত হয়।
সাধারন গর্ভধারণ
সাধারন গর্ভধারণেও কাইমেরিজম সম্ভব। ১৯৯০ সালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, যদি ভ্রূণের কিছু কোষ মায়ের জরায়ুর বাইরে চলে আসে তবে গর্ভবতী মায়েরা তার সন্তানের কাছ থেকে কিছু ডিএনএ লাভ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস এর নাম দেয় “pregnancy souvenir” বা “গর্ভাবস্থার স্মারক”। বৈজ্ঞানিক ভাবে এটির নাম “মাইক্রো কাইমেরিজম”।
ছেলে সন্তানের মায়েদের ক্ষেত্রে মাইক্রোকাইমেরিজম পরীক্ষা করার একটি সহজ উপায় হল মায়ের শরীরে কোনো Y ক্রোমোজম আছে কিনা তা পরীক্ষা করা, যা স্বাভাবিক অবস্থায় শুধু পুরুষের শরীরে পাওয়া যায়। এক গবেষণায় গবেষকগণ ২৬ জন নারীর নমুনা সংগ্রহ করেন যারা গর্ভাবস্থায় অথবা জন্মদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন এবং সকলেই ছেলে সন্তানের মা ছিলেন। প্রতিটি নমুনাতেই অল্প মাত্রার Y ক্রোমোজম পাওয়া যায়।
ছেলে সন্তানের মায়েদের মস্তিষ্ক নিয়ে আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ৬৩ শতাংশ মায়েদের মস্তিষ্ক অতি সামান্য পরিমাণ পুরুষ ডিএনএ বহন করে। এমনকি ৯৪ বছর বয়সী একজন নারীতেও এটি লক্ষ করা গিয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয় গর্ভাবস্থার অনেক সময় পরেও মাইক্রোকাইমেরিজম স্থায়ী হতে পারে।
মাইক্রোকাইমেরিজমের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, গর্ভবতী মায়েদের জন্য এটি সর্বজনীন না হলেও খুবই সাধারণ।”
গর্ভাবস্থায় মায়েদের শরীরের যেসব অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা যায়, তার দীর্ঘতালিকায় আরো একটি বিষয় যোগ হলো।
ফিচার/আয়শা আহমেদ