৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০: রক্তদানের আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যে নামটি সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হলো সন্ধানী। সন্ধানী বাংলাদেশের মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি জাতীয় পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ বছর শুধু বাণিজ্য মেলায় দেয়া একটি স্টল থেকেই সন্ধানী শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ইউনিট সংগ্রহ করে ৩৭১ ব্যাগ রক্ত। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ছিল সন্ধানীর ৪৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। তাই আজকের প্রতিবেদন সন্ধানীর ইতিহাস নিয়ে।
প্রতিষ্ঠা
১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে যাত্রা শুরু করে “সন্ধানী”। বন্ধুর প্রতি ৬ জন উদ্যমী তরুণের অকৃত্রিম ভালবাসা থেকে জন্ম নেয় ‘সন্ধানী’।
ফিরে দেখা
১৯৭৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ইদ্রিস আলী মঞ্জু জানতে পারেন, তাঁদেরই এক সহপাঠী আর্থিক সমস্যার কারনে সকালের নাস্তা না করে দুপুর দুটা পর্যন্ত ক্লাস করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে নাস্তার টেবিলে ব্যাপরটি তিনি আরো পাঁচ জন সহপাঠীকে জানান এবং সবাই মিলে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সম্মুখস্থলের কড়ই গাছের নিচে একত্রিত হন। তাঁরা ছয়জন মিলে পরবর্তীতে ঐ সহপাঠীর সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করেন। এভাবেই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে সন্ধানী।
সহপাঠীকে সাহায্যের বিষয়টি নিয়ে ভাবনা থেকে এবং এমন আরো শত শত অসহায় শিক্ষার্থী ও হাসপাতালের রোগীদের কথা চিন্তা করে কাজটিকে একটি সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে, ১৯৭৭ সালের ১৯ মার্চ বিকাল ৫ টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকলে একত্রিত হন। সেখানে মোশাররফ হোসেন মুক্ত এর প্রস্তাবিত ‘সন্ধানী’ নামটি মনোনীত হয়।
একই সাথে সেদিন গঠিত হয় প্রথম কমিটি। পরবর্তীতে ছয় জন মিলেই তৈরি করে সন্ধানীর প্রথম সংবিধান ‘সন্ধানী নিয়াবলী’। সন্ধানীর উদ্দেশ্য হিসেবে সেখানে লেখা ছিল- “যাবতীয় অন্যায় অনাচার থেকে মুক্ত রেখে নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং মানবতার কল্যাণের জন্য সাধ্যানুযায়ী সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।”
সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করলেও ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী’ সন্ধানীর কার্যক্রমের আওতাভুক্ত ছিল না। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক বন্ধু সন্ধানীর সদস্যদের কাছে ছুটে এসে বলেছিলেন, ‘বাবার অপারেশন করতে হবে, জরুরি ভিত্তিতে রক্ত প্রয়োজন।’ পেশাদার রক্তদাতাদের অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের ভয়ে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেরাই রক্ত দেবেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ২ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের অধ্যাপক ডা. আবদুল কাদেরের সহায়তায় বাংলাদেশের প্রথম ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি’র আয়োজন করে সন্ধানী। সন্ধানীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইদ্রিস আলী মঞ্জু সবার আগে রক্তদান করেন। মেয়েদের রক্তদান কার্যক্রমে যুক্ত করতে প্রথম রক্ত দিয়েছিলেন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী হোসনে আরা লাকী। সকলের সহযোগিতায় ঐদিনে ২৭ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে এই দিনটিকেই ‘জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দেয়া হয়।
১৯৮০ সনে রক্তদানের থিম নিয়ে ডা. মাহবুব মোতানাব্বির লেখা ‘তারার পানে চেয়ে চেয়ে’ নামের ত্রিভুজপ্রেমের একটি নাটক টেলিভিশনে প্রচারিত হয়, যেটি ছিল প্রচারণা মাধ্যমে সন্ধানীর প্রথম আত্মপ্রকাশ। অভিনয়ে ছিলেন হিরু, সুপ্রীতি, প্রণব বালা, মাহফুজ বাবুল,মোখলেস,জামাল, হেলাল এবং প্রমুখ।
বর্তমানে সন্ধানী
১৯৭৯ সালের ১৮ অক্টোবর স্বতন্ত্র ইউনিট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় সন্ধানী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ইউনিট।
১৯৮২ সালের মধ্যে সন্ধানী ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশানী মেডিকেল কলেজ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ এবং ঢাকা ডেন্টাল কলেজে।
১৯৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে ৯টি ইউনিট নিয়ে গঠিত হয় সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ। বর্তমানে সন্ধানীর ২৫ টি ইউনিট বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে একযোগে কাজ করছে।
কার্যকরী কমিটি
সন্ধানীর প্রতিটি ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ঐ নির্দিষ্ট ইউনিটের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ২৮ সদস্যের একটি কার্যকরী কমিটির মাধ্যমে। সবগুলো ইউনিটকে সমন্বয় করার জন্য গঠিত হয় ‘কেন্দ্রীয় পরিষদ’।
সহযোগী প্রতিষ্ঠান
১৯৮২ সালের ২ জুলাই ‘সন্ধানী ডোনার ক্লাব’ এবং ১৯৮৪ সালের ২৫ নভেম্বর ‘সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি’ ও ‘সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
কার্যক্রম
প্রতিবছর সন্ধানী গড়ে ৪০,০০০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে। এছাড়াও মরণোত্তর চক্ষুদান সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সেবামূলক কাজে সন্ধানী জনসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক/সুবহে জামিল সুবাহ