৮ নভেম্বর ২০১৯:
সম্প্রতি ১২ বছরের এক শিশুর স্টিভেন জনসন সিন্ড্রোম (Steven-Johnson syndrome) এ আক্রান্ত হওয়া এবং তার চিকিৎসা নিয়ে ফেসবুক সরগরম। জ্বর, কাশি, চোখের উপসর্গ নিয়ে প্রথম যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিল, পরবর্তীতে রোগের প্রকোপের প্রতিক্রিয়ায় সেই চিকিৎসক নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ হবার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল করে এমন ঘটনার ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
কেন এই সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া?
সম্ভবত রোগের তীব্রতার ব্যাপারে পূর্বধারণা বা পূর্বাভাস না থাকার কারণে এমনটা হয়েছে।
আসুন দেখি আলোচ্য রোগটি কি?
Steven-Johnson syndrome তীব্র প্রতিক্রিয়া সম্বলিত (hypersensitivity) একটি বিরল রোগ, যাতে সাধারণত এক মিলিয়নে ২-৭ জন ব্যক্তি আক্রান্ত হন।
উপসর্গ কি?
ত্বক ও মিউকাস ঝিল্লি আক্রান্ত হয়। দেহের চামড়া, ঠোঁট, মুখ গহ্বর, কন্ঠ, অন্ত্র, পায়ু, মূত্রনালি, চোখ ইত্যাদি সবকিছুই আক্রান্ত হতে পারে। ফোস্কা পড়ে যায়। জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। শরীরের বাইরে যতটা আক্রান্ত দেখা যায়, ভেতরেও তেমন আক্রান্ত হয়। কয়েকদিনের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গ যেমন কিডনি, ফুসফুস, যকৃত অকেজো হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে।
দেহের ত্বকের ১০% এর কম আক্রান্ত হলে সাধারণত চিকিৎসায় আরোগ্য হয়, যদিও মাসখানেক সময় লেগে যায়। ৩০% এর বেশি অংশ আক্রান্ত হলে মৃত্যুর আশংকা ১০গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অনেকটা আগুনে পোড়া রোগীর মতো। ত্বক আমাদের দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ, যা বাইরের জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। এটি আক্রান্ত হলে সুরক্ষাব্যবস্থা ভেংগে পড়ে। মারাত্মকভাবে জীবাণু আক্রান্ত হলে বাঁচার সম্ভাবনা কমে যায়।
চিকিৎসা কি?
মূলত সাপোর্টিভ বা পরিচর্যামূলক চিকিৎসা (symptomatic treatment)। আক্রান্ত অংশের যত্ন, জীবাণু মুক্ত রাখা, ক্ষত পূরণের জন্য শরীরে পুষ্টি জোগান দেয়া ইত্যাদি। সেই সাথে বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হলে তার চিকিৎসাও চালাতে হয়। যেমন কিডনি বিকল হলে ডায়ালাইসিস, ফুসফুস অকার্যকর হলে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র ইত্যাদি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে হয়।
রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেল। এবার দেখা যাক এই রোগের কারণ কি?
জেনে আশ্চর্য হবেন যে প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে কোনো কারণ পাওয়া যায় না।
বাকিদের মাঝে কারণ খুঁজে পেতে দেখা যায় যে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মাঝে এই রোগের কারণে উল্লেখযোগ্য ভিন্নতা আছে। বড়দের মাঝে রোগের জন্য বিভিন্ন ওষুধ ও ক্যান্সারকে দায়ী করা হয়। শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয় জীবাণু সংক্রমণ থেকে।
অর্থাৎ জীবাণু সংক্রমণের ফলে জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গের পাশাপাশি এই স্টিভেন জনসন সিন্ড্রোম দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে। জীবাণু নিজে যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি জীবাণুর বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অতি সক্রিয় হয়ে নিজের শরীরকেই আক্রমণ করে বসেছে!
এ ধরনের উপসর্গ শুরু থেকেই আলাদা করা সম্ভব না। তাই জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রয়োগ করলে শুধু জীবাণু মরে, স্টিভেন জনসন সিন্ড্রোম এর প্রতিক্রিয়া একবার শুরু হলে তার তীব্রতা সময়ের সাথে বাড়তেই থাকে। তখন রোগীর ধারণা হতে পারে যে ওষুধ খেয়ে এই সমস্যা হয়েছে। শুধু রোগী কেন খোদ চিকিৎসক চিন্তিত থাকেন যে কোনো ওষুধ থেকে এটি হলো কিনা। তাই সাথে সাথে চলমান সব ওষুধ বন্ধ করে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে বলা হয় – এটাই এই রোগের চিকিৎসার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
সবার কি এই রোগ হয়?
আগেই বলা হয়েছে রোগটি বিরল। এমনও হয়, কেউ এক জীবনে বিভিন্ন সময়ে আশেপাশের চেনাজানা অনেকের মৃত্যু দেখেছে কিন্তু এমন রোগী কখনো দেখেনি, হয়তো এই প্রথম!
কেন?
কিছু জেনেটিক উপাদান এজন্য দায়ী বলে শনাক্ত করা গেছে। তাও বিভিন্ন জাতিতে ভিন্নতা আছে। যেমন, ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার মানুষের মাঝে এই রোগের জন্য দায়ী ওষুধে ভিন্নতা আছে। আবার সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গড় আক্রান্তের তুলনায় জার্মানিতে এই রোগের প্রকোপ অনেক কম।
করণীয় কি?
প্রথমবার আক্রান্ত হবার কারণ সাধারণত বুঝা যায় না। জীবাণু নাকি ওষুধ? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আমাদের দেশের জৈবপ্রযুক্তিগত (বায়োটেকনোলজি) সুবিধাদির অপ্রতুলতা বিবেচনায় অবান্তর। তবে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বেশ কিছু সংখ্যক থাকায় চিকিৎসা করার সুযোগ বেড়েছে।
সেরে উঠলে পরবর্তীতে যেকোনো সময় চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন একেবারেই উচিত নয়। প্রতিবারই চিকিৎসককে ইতিপূর্বে স্টিভেন জনসন সিন্ড্রোম আক্রান্ত হবার কথা অবশ্যই জানাতে হবে। ওষুধের কথা জানাতে হবে। চিকিৎসক শুনে বুঝে বিবেচনা করবেন। তথাপি পরবর্তীতে নতুন করে জীবাণু সংক্রমণের কারণে, একই ওষুধ সেবন না করা সত্ত্বেও, আবার স্টিভেন জনসন সিন্ড্রোম আক্রান্ত হলে চিকিৎসার ত্রুটি বা চিকিৎসকের বাড়ি না খুঁজে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের খোঁজ যত দ্রুত নেয়া যাবে, ততই রোগীর মঙ্গল ও রোগীর অভিভাবকের শুভবুদ্ধির পরিচায়ক।
অতি উৎসাহী অতি প্রতিক্রিয়া যদি রোগটির মতোই তীব্র হয়, হতাশা প্রকাশ ছাড়া বলার আর কিছু থাকে না।
সব রোগী আরোগ্য লাভ করুক। সব রোগীর স্বজন ভুল করে ভুল না বুঝে, কানকথায় চিকিৎসকের দোষ খোঁজার প্রবণতা বাদ দিয়ে প্রজ্ঞার পরিচয় দিবেন এবং চিকিৎসকদের সহায়তা করে চিকিৎসাব্যবস্থাকে উন্নত করতে সচেষ্ট হবেন বলে আশা করা যায়৷
প্রতিবেদক/ওয়াসিফ হোসেন ও ডা. মুরাদ হোসেন মোল্লা