৮ ডিসেম্বর ২০১৯
[পোস্ট পারটাম ব্লু, পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন কিংবা পোস্ট পারটাম সাইকোসিস এক ধরনের মারাত্মক কিন্তু নিরাময়যোগ্য মানসিক অসুস্থতা যা সন্তান জন্মের পর একজন মায়ের হতে পারে। পূর্বে কখনো কোন মানসিক রোগ না থাকা মায়েরও হঠাৎ করে এই রোগ হতে পারে। ভয়াবহ এই অভিজ্ঞতারই বর্ণনা দিয়েছেন একজন চিকিৎসক মা।]
একজন মাকে যখন এই কথা শুনতে হয় তখন কেমন লাগে জানি না। তবে আমার মনে হয়েছিল এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল। আমার কাছে আমার বাচ্চা নিরাপদ না এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে। অথচ এই কথাটি শুনে এই পরিস্থিতি সামলে আমাকে বাঁচতে হয়েছে সেইসাথে বাচ্চাটিকেও নিরাপদ রাখতে হয়েছে।
একটা প্রেগন্যান্সির শুরু এবং এর পর একটা মেয়ের খুব কম সময়ে অনেক হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। এটার সাথে মানিয়ে নেয়া খুব সহজ না। এসব কথা শুনলে আগের মানুষ জন খুব সহজেই বলে বসেন যত সব ন্যাকামো, আমরা আর মা হয়নি। সবই আজকাল কার মেয়েদের ঢং। নাহ… পোস্ট পারটাম ব্লু, পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন কিংবা পোস্ট পারটাম সাইকোসিস আগেও ছিল। এখনো আছে। কেবল আগে আমরা রোগটা ধরতে কিংবা রোগের কারণ সম্পর্কে এতটা অবগত ছিলাম না। বাচ্চা হবার পর তাদের বাচ্চা নিয়ে ভয় ছিল, কিংবা যে নতুন বউ মুখ তুলে জবাব দেয়নি, তার আচরণ একটু কেমন হয়ে গেছে সব কিছুতেই খিটখিটে। আমিতো আমার এক খালার কথাও শুনেছিলাম বাচ্চা হবার পর সে নাকি পাগল হয়ে গিয়েছে। কিংবা আরেকটু গ্রামে গেলে হয়তো শুনা যেত ঘরের বউ এর উপর জীনের আছর করেছে।
শরীরের রোগের যেমন চিকিৎসা দরকার, ঠিক তেমনি মনের রোগেরও। কিন্তু আমরা সেটাকে অবহেলা করতে করতে extreme পর্যায়ে নিয়ে যাই, যেটা আমি করেছি। তার উপর আবার নিজে ডাক্তার, ভেবেছি ডিপ্রেশন? একে পাত্তা দেবার কি আছে। আমি নিজেই নিজেকে মোটিভেট করব। কিন্তু না। সব কিছুরই একজন বিশেষজ্ঞ থাকে, একটা সময় নিজের দায়িত্ব না নিয়ে তার উপর ছেড়ে দিতে হয়। একটা জটিল সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসা, বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যে বাচ্চা হওয়া, ক্যারিয়ার গুছানো, একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে একা উপজেলা ডিউটি, পোস্টিং ঝামেলা, নতুন সংসারের মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে চলা সব কিছু যেন একই সময়ে চলছিল।
ডিপ্রেশন টাকে পুষে পুষে বড় করতে করতে সেটা বাচ্চার দুই বছরের সময় প্রকট আকার ধারণ করল। প্রথমত রোগের উপসর্গ ছিল বাচ্চাকে বাদে কাউকে সহ্য করতে পারতাম না। সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম। নিজের মা বাবা ভাই বোন হাজবেন্ড শাশুড়ী সবার সাথে। সামান্য কিছু ঘটলেও অতি মাত্রায় রিএক্ট করতাম। মা বাবা তো নিজের ছেলে-মেয়ের দোষ বেশিক্ষণ মনে রাখে না। কিন্তু সবাই তো আর তা না। মনমালিন্যতে নিজেই একা হয়ে যাচ্ছিলাম। তার পর আস্তে আস্তে শুরু হল ভয়াবহ অধ্যায়। যে বাচ্চা আমার সব কিছু, তাকে সহ্য করতে পারতাম না। কি ভয়ংকর সে দিনগুলো! মাথার মধ্যে কেউ একজন বলত আয়ান এর ক্ষতি কর, আরেকজন বলত না ও তোর সবচেয়ে আদরের বাচ্চা। দুটা ভিন্ন পারসোনালিটি তে, দুইজনের ঝগড়াতে যুক্তি তর্কে আমি হাপিয়ে উঠেছিলাম।
বুঝলাম পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। কয়েকজন সিনিয়র আপু বুঝালেন “তুমি PPD তে আছ। দ্রুত কনসালটেন্ট এর কাছে যাও।” বহুত সাহস সঞ্চয় করে আমি সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরনাপন্ন হলাম। ম্যাডাম আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করে বুঝে নিলেন সমস্যা। বললেন ভর্তি হতে। বাসায় আমার চিকিৎসা সম্ভব না। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন এটা বাংলাদেশ। যেখানে মানসিক রোগ মানেই পাগল, সেজন্য আবার চিকিৎসা, লোকে জানলে কি হবে?
পরিবার এর সিদ্ধান্তে বাসায় রাখা হল, শর্ত: আমার বাচ্চা আমার কাছে থাকতে পারবে না। ওষুধ দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হল। ৭ দিন। বলা হল চাকুরী থেকে ছুটি নিতে। কাজ করতে না।
এরপর কয়েক মাস। আমার জীবনে কি হচ্ছে কিছুই জানিনা। ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে কাটাই বেশিরভাগ সময়। কিছু সময় জেগে থাকতাম। অইটুকু সময় ছিল আমার অফিস এর সময়। যেহেতু রোগী দেখিনা, কলেজের শিক্ষকতা করতাম, সময়টুকু ম্যানেজ করে নিয়েছিলাম। সেইসাথে চলতে থাকল সাইকোথেরাপি।
আলহামদুলিল্লাহ। আমি আবার আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। আমার অদ্ভুত চিন্তাগুলোকে দূর করতে পেরেছি। আমার বাচ্চাকে আবার আমার কাছে পেয়েছি। আমার পরিবার সবসময় আমাকে সাপোর্ট দিয়ে গিয়েছে। তারপরও হয়ত কিছু ক্ষত থেকেই যায়। অনেকেরই হয়ত সেইসময় এর কথা মনে রয়েই গিয়েছে। অথচ যা ঘটার পিছনে আমি কতটুকু দায়ী তা সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন।
আজ প্রায় বছর পর বহু সাহস নিয়ে লিখছি। নাহ, আমি চাইনা আমার জীবনে, আমি যা সাফার করেছি তা অন্য কেঊ করুক। সময় থাকতে যেন সাহায্য নেয়, এত তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন যেন আর কেউ না হয়। সাহায্য চাওয়া বা করা কোনটাই দোষের কিছু না। মানসিক রোগের এই ট্যাবু আমি ভাংতে চাই। অসুস্থ যে কেউই হতে পারে। সেটা শারীরিক, মানসিক দুইটাই হতে পারে, তার জন্য সে চিরকাল অসুস্থ না। সঠিক সময় সঠিক চিকিৎসায় (কিছু ব্যতিক্রম) সব কিছু থেকেই মুক্তি পাওয়া যায়।
ডা. আফিফা ইসলাম