♣♣
একজন কন্সাল্টেন্ট তার মামাতো ভাইকে এনেছে দেখাতে।রুগীর সাথে কথা বলছি,এই সময় দরজা ঠেলে একজন ঢুকে পরলো।এই লোক আগেও বহুবার এমন করেছে।আজকে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম,
:রুগী দেখতেছি।
:আমি স্টাফ।
:আমি একজন ডাক্তারের রুগী দেখতেছি।তাছাড়া রুগী তো রুগীই তার প্রাইভেসী আছে।
সেই লোক মুখ বিকৃত করে বলে গেলো,
: আমরা কি বানের জলে ভাইসা আইছি।
একই দিনে আরেক স্টাফ,
:আমি ‘আর পি’ এর পিওন।
আমি কইলাম,
:নাম কি আপনার?
সে ‘আর পি ‘এর নাম বলে আমারে ফাপড় দেখায়।কইলাম,
:’আর পি আমার মেডিকেলের ছোট ভাই’,তার পিওনের নাম অমুক আপনার নাম বলেন।
তখন থতমত খেয়ে বলে,
:আমি আসলে তার পাশের রুমের।
♣♣
আমি জানি শত্রু বাড়লো।এদের আবার একতা বেশি।
যাইহোক,আমি স্ট্রিক্টলি একটা রুগীর সাথে আরেকজন দেখা খুব অপছন্দ করি,আমার বেশিরভাগ মহিলা রুগী তাদের প্রাইভেসীর ব্যাপার আছে।এই নিয়ে প্রায় সময় এইসব স্টাফদের সাথে টুকটাক ঝামেলা হয়ই।ঝামেলা কমানোর জন্যে অনুরোধও করি।
হাসপাতালের স্টাফরা হাসপাতালের ডাক্তারদের চেয়েও পাওয়ারফুল,এদের চক্র আছে, এদের ইউনিয়ন আছে,এদের সবচেয়ে বড় কথা একতা আছে যা ডাক্তারদের নাই।তাই হাসপাতালে ডাক্তাররা সবচেয়ে অসহায়।অনেক ডাক্তারদের দেখেছি এদের তোয়াজ করে চলতে।কিন্তু আমি পারিনা।কিছু কিছু স্টাফ সৎ।এদের সাথে আমার ব্যবহার সবসময় ভাল।তাদের সততার কারণে।
♣♣
হাসপাতালে ডাক্তারবাদে বেশিরভাগ স্টাফ বেতনটাকে মনে করে চাকরীতে বেতন তোলা একটা কাজ সেইটা তারা নিয়ম করেই তোলে।ফাও টাকা।বাকি তাদের সব কাজের জন্যে তারা টাকা নেয়।সেইটা রুগীর থেকেই হোক আর ডাক্তাদের থেকেই হোক।
♣
ডাক্তারদের জন্যে যে স্টাফরা আছে তারা সব কাজের জন্যেই ডাক্তাদের কাছে বাধ্যতামূলক টাকা নিবেই।না দিলে কাজ হবেনা।ডাক্তাররাও ঝামেলা এড়াতে এদের শুধু টাকা দেয় না, তোয়াজ ও করে চলে।
♣
এখন আসি রুগীদের ব্যাপার।হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু হয় নানারকম অনিয়ম। ট্রলি ধরার জন্যে লোক আছে,সে বেতনও পায় কিন্তু টাকা ছাড়া কখনওই হুইল চেয়ার বা স্ট্রেচার নিয়ে যাবেনা।এমন কি আমি যখন নিজেই ডি এম সি তে ট্রেনিং করি,অসুস্থ হয়ে ভর্তি হতে গেলে,আমার হাজবেন্ডের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছিলো।
এইসব আয়াদের দামি ড্রেস,দামি মোবাইল, জুতা, ব্যাগ,সোনার জিনিস দেখে অনেকেই তাদেরকেই অফিসার মনে করেন।আমার রুম পরিষ্কার করা খালার কাছে তাদের অনেক সম্পত্তির হিসাব জানা যায়।
♣
সার্জারিতে ট্রেনিং করার সময়,এডিমিশন মর্নিং এ অবস্ট্রাকশনের রুগী থাকলে ইনিমা ওর্ডার দিয়ে আসতাম,সন্ধ্যায় যদি দেখতাম রুগী পায়খানা হয়েছে তখন আর অপারেশনের ডিসিশনে না গিয়ে কঞ্জারভেটিভে চলে যেতাম।প্রায় দেখতাম রুগীকে ডুশ দেয়া হয় নাই।কেনো?রুগী টাকা দেয় নাই।এইসব দাদুদের সাথে কথা বলাও বিপদ। খুব গরীব রুগীর ক্ষেত্রে নিজেরাই পকেট থেকে টাকা দিয়ে দিতাম।তখনই মনে আছে সাপোজিটরি আর ইনিমা দেয়ার হাই রেট ছিলো।মানুষ কতটা অসহায় এদের কাছে।অথচ এরা কিন্তু বেতনভোগী।
♣
আমার শ্বাশুরীর একবার মাথা ফেটে গেলো হাসপাতালে নিলাম,ব্রাদার স্টিচ দিতে টাকা নিলো প্লাস দুই ধরনের দামি সুতা কিনায় নিলো যা হাসপাতালেই সাপ্লাই আছে।সে সাপ্লাই সুতা দিয়েই স্টিচ দিলো,কিন্তু সুতা নিলো বিক্রি করে দিবে।স্টিচ সবসময় আমরাই দিতাম,কে জানি ইমার্জেন্সিতে রুগীর লোড বেশি বা যেকারনেই হোক ব্রাদার এভাবে দিনে কত টাকা ইনকাম করতে পারে?ফিরে আসার সময়, একজন ডাঃ শুধু বলল,”আপনি ডাক্তার বলবেন না?আমি আপনাকে কত দেখেছি।”আমার হাসিও আসতেছিল না।আমি যাওয়ার পরেই বলেছিলাম,”আমার মা”কেউই গুরুত্ব দেয় নাই।পরিচয় দিয়ে কি করবো?মায়ের রক্তাক্ত মুখের সামনে কোন হিসাব বা পরিচয় চলেনা।আমার মতো প্রতিদিন হাজার হাজার ভুক্তভোগী রুগী এভাবেই সাফার করে।
♣
কয়দিন আগে এক সরকারী হাসপাতালে ঘটে যাওয়া এক ঘটনায় বহিরাগতদের হাসপাতাল ভাংচুরের কথা শুনলাম,সেখানে হাসপাতালে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ ছিলো হাসপাতালের গেটে তালা লাগানো।ডাক্তারদের কোন সিকিউরিটি তে তাদের কাজ নাই।এদের কাজ কম্পানীর লোকের কাছে টাকা পয়সা গিফট নিয়ে ঢুকতে দেয়া,কম্পানির মেয়েদের বিভিন্ন কুপ্রস্তাব দেয়া।শুনলে অবাক হচ্ছেন তাই না?এইসবই সত্য ঘটনা, প্রতিদিন নিজের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা।১২ বছর ধরে তার আগে ইন্টার্নিশিপের সময় থেকেই দেখে আসছি।
অথচ এইসব সিকিউরিটির সামনে ডাক্তারকে কেউ কিছু বললে বা এদের ডাকলেও আসে না।আসবে যদি ওদের টাকা দিয়ে রাখেন।
♣
এখন আসি টিকিট বিক্রি।অনেকেই দীর্ঘক্ষন লাইনে দাড়ায়ে টিকিট পায়না,কিন্তু ভিতরে নাকি একটা চক্র যাদের কাছে অতি চতুর লোকজন এক টাকা থেকে পাচ টাকায় ইজিলি টিকিট কেনে।শুধু তাই না,কোনরকম রিকুইজিশন ফর্ম ছাড়াই,লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াই নাকি হাতে হাতে টাকা দিলে টেস্ট করা যায়,এবং রিপোর্ট সাথে সাথেই পাওয়া যায়।এইসবই আমার রুগীদের কাছ থেকেই শোনা আর অবাক হওয়া।আমি নিজে লাইনে দাঁড়ায় টাকা দিয়ে টেস্টের জন্যে লাইনে দাড়ানোর ভয়ে টেস্টই করাই না।কাউকে অনুরোধও করতে ইচ্ছা হয় না।আর কত সুন্দর সিস্টেমের ভিতরে হাসপাতালে এইসব দুর্নীতি চলে!আমি হটাৎ সেদিন এইসব কথা জেনে আসলেই অবাক হই।কত অসুস্থ রুগী লাইনে দাঁড়ায় চিকিৎসা নেয়,টেস্ট করায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়ায়।
♣
একদল স্টাফের কাজ হাসপাতালের বাইরে রুগী ভাগানো,এরা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের, বিভিন্ন ক্লিনিকের দালাল।
♣♣
হাসপাতালের স্তরে স্তরে অনিয়মের কথা লিখে শেষ করা যাবেনা।হ্যা দায় ডাক্তারদের থেকেই যায়।কিন্তু একজন ডাক্তার আজীবন একটা হাসপাতালে থাকেনা,তাই অনিয়মের বিরুদ্ধে যেতেও চায় না।তাছাড়া এদের সিন্ডিকেট এতই পাওয়ারফুল যে, যেকোন সময় যেকোন ডাক্তারকে অনত্র পোস্টিং করায় দিতেও পারে তারা।তাছাড়া মানসম্মানের ভয়।
♣♣
এদের এত ক্ষমতার কারণ কি?
♦এরা বেশিরভাগ লোকাল হয়।
♦এরা পাওয়ারফুল কাউকে দ্বারা রিক্রুট করা,সেইটা যেভাবেই হোক।
♦এদের কোন বদলী নাই।
♦এরা সবসময় একতাবদ্ধ।
♦এদের মান সম্মানের কারবার নাই।
♣♣
অনিয়মটাই সবাই নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছে।কেউ এইসবের কোনও প্রতিবাদও কখনও করেনা।যারা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাদের বলবো ডাক্তারদের মত নিরীহদের বিরুদ্ধে ম্যালাই তো লিখলেন,এইবার এইসব ব্যাপারে একটু দৃষ্টি দিন, তাতে বহু অসহায় রুগী উপকৃত হবে।তাছাড়া যথাযথ কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।অন্তত মানুষ গুলো তাদের অধিকারের ব্যাপারে তো সচেতন হবে।
♣♣
পরিশেষে একটা গল্প বলে শেষ করি,ইন্টার্নির সময় আই য়ে প্লেসমেন্টের সময় ইনডোরে কাজ শেষে আউটডোরে আর এস এর রুমে রুগী দেখতেছিলাম।একজন হোমড়া চোমড়া,সব রুগীকে ধাক্কা দিয়ে রুমে ঢুকলো।তার পরিচয়, সে হাসপাতালের এক কর্মচারীর ড্রাইভার।স্যার ঠান্ডা মানুষ, লোকটাকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বললেন,
:আমার কর্মচারীর ড্রাইভার আছে,আর আমার গাড়িই নাই,এ কেমন কথা বলতো?
আজ চাকরীর বারো বছর পর আমার ঠিক স্যারের কথাই প্রতিধ্বনি করতে ইচ্ছে করে যখন শুনি, হেলথ সেকটরের বিভিন্ন স্তরে কত ছোট ছোট কর্মচারীর সম্পত্তির হিসাব।
©মিথিলা ফেরদৌস