অন্ধ থাকিলে প্রলয় থাকে না বন্ধ

১৮ মার্চ ২০২০:

মোকাররম আলাভী
এমডি নিউরোলজি (অধ্যয়নরত)
ইয়াংজো ইউনিভার্সিটি
জিয়াংসু, চীন

সুবহে সাদিকের প্রাক্কালে এই লেখা যখন লিখছি চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহর থেকে, পুবের আকাশে আলো মিটিমিটি খেলছে। ইদানিং আকাশটা বেশ ঝকঝকে দেখা যায়। করোনার প্রভাবে গত দুমাসে বায়ুদূষণ অবিশ্বাস্য হারে কমেছে, তাই আকাশটা খুব পরিষ্কার থাকে, তারাদের আনাগোনা সুন্দর করে উপভোগ করা যায়।

দুমাস হতে চলল প্রায় অবরুদ্ধ জীবন। ইদানিং লিখতেও ইচ্ছে করে না। দেশের খবরাখবর দেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাই আবারও কিবোর্ডে আঙ্গুল ঘুরানো। চীনের আকাশ থেকে এখন করোনা-মেঘের ছোবল সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার। একের পর এক দেশ লকড-ডাউন হচ্ছে। যারা এতদিন চীনকে নিয়ে উপহাস করেছে আজ তাদের হাঁসফাঁস চোখে তিরের মতো বিঁধে!

মা-র কাছে ডিজিটাল ফোন ছিল না। করোনা আউটব্রেকের পর আমার সাথে সারাদিন কথা বলার জন্যে মা একটা ডিজিটাল ফোন কিনে, দিনে এখন অসংখ্যবার আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলে। আমাকে অনেকবার বলেও দেশে নিয়ে যেতে পারেনি বলে তার কতো দুঃখ! তাকে আশ্বস্ত করতেই আমার দিন যেত— আমি ভালো আছি, নিরাপদে আছি। তারপরেও সারাদিন স্বজন এবং প্রিয়জনদের আমাকে নিয়ে কত উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা!

এখন সময়ের স্রোত আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে, মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে আমার ঘুম হয় না। মা সবচেয়ে ভালনারেবল-এইজ গ্রুপে, সাথে ডায়াবেটিস, অ্যাজমাসহ আরও নানান রোগ। মা-কে সবার থেকে দূরে থাকতে বলি। আমার মায়ের মতো লক্ষকোটি মায়েরা এখন জীবন নিয়ে হুমকিতে। লক্ষকোটি বাবারা জীবন নিয়ে হুমকিতে। সেসময় আমরা আতশবাজি ফুটাতে ভীষণ ব্যস্ত। হঠাৎ করে পাওয়া স্কুলছুটি উদযাপন করতে কক্সবাজার ভীড় করতে ব্যস্ত।

করোনা আউটব্রেকের কাছে ইতোমধ্যে বিশ্বের সব সুপারপাওয়ার কুপোকাত! সরকারপ্রধানেরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার খুব একটা করতে না চায়লেও অবস্থা বেগতিক— তা বুঝতে ট্রাম্পের মতো কট্টরপন্থীদেরও বাধ্য হতে হয়েছে। সারাবিশ্বে হাহাকার চলছে ভেন্টিলেটরের জন্যে। করোনারি সাথে যুদ্ধ করার এটাই যে শেষ এবং প্রধান হাতিয়ার।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান প্রতিদিন বলে যাচ্ছেন টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। এমন সময়েও আমরা ব্যস্ত কে বিদেশ থেকে আসলো কে কোয়ারেন্টিনে থাকলো তা নিয়ে! সরকার কোটি কোটি টাকা দেদারছে খরচ করতে পারে, কিন্তু করোনা টেস্ট কিট কিনে আনতে পারে না। সারাদেশে শুধুমাত্র একটি জায়গায় টেস্ট করা যায়— এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে কী না আমার জানা নেই।
তবুও এদের লজ্জায় জিভ কাটে না। এরা নগ্ন হলেও আমরা কেউ বলতে পারছি না— রাজা মশাই আপনার কাপড় কই। এরা প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলনে নামক কমেডি করে, আমরা তা সার্কাসের মত গিলি।

মানুষের জীবনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না। এখন বাঁচার একমাত্র রাস্তা হলো, লকড-ডাউন— সারাদেশে মাস-কোয়ারেন্টিন কমপক্ষে চৌদ্দদিনের জন্যে। এরপর সাসপেক্টেড সবাইকে টেস্ট করে আইসোলেশন। যেখানে উন্নত বিশ্বের সুপারপাওয়ারেরা থামাতে পারেনি, আমরা তাদের তুলনায় কী সেটা সরকার মশাই ভালো জানে।

মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং সরকার দয়া করে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দেশের মানুষের জীবন বাঁচান। আতংকের কিছু নেই বলে বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে তখন কিছু করার থাকবে না। সৎকার করার জন্যে মানুষ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে।

চীন, ইরান, ইতালি কিংবা যুক্তরাষ্ট্র এদের দেখেও যদিও কিছু শিখতে বা আন্দাজ করতে না পারেন, মহামান্য সরকার— বলতেই হয় আপনারা অন্ধ! কিন্তু অন্ধ থাকলে যে প্রলয় বন্ধ থাকে না। করোনা চুপিচুপি ছড়িয়ে পড়ছে দেশে। দয়া করে চোখ খুলে আমাদের একটু বাঁচান। আর কতোদিন এভাবে অন্ধ থাকবেন?

Platform

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনা মহামারি রোধে বিয়ের বিশাল আয়োজন ত্যাগ করলেন চিকিৎসক যুগল

Thu Mar 19 , 2020
১৯ মার্চ ২০২০: জানুয়ারিতে যখন বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছিলো, তখন থেকেই বাসায় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে স্কুল কলেজ মেডিকেলের বন্ধু বান্ধব কলিগ, ছোট বড় ভাই-বোন, শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলিয়ে তার অতিথিই হবেন ২০০ জন। মোট অতিথি হবেন হয়তো ৮০০-৯০০ জন। বলছি ডা. সাকিব হাসান ধ্রুব এর কথা। বাড়ির ছোট ছেলে হিসাবে সব কিছুতেই […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo