অস্তিত্ব – ডা. শ্রাবণী

প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -২৪

“অস্তিত্ব”

লেখকঃ —-শ্রাবণী
ইন্টার্ন চিকিৎসক,
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সেশনঃ২০১২-১৩

সেদিন ছিল এডমিশন নাইট।সারারাত রোগীর এত চাপ ছিল যে দুচোখের পাতা এক করার কোনো সময়ই পাচ্ছিলাম না।ইন্টার্নশীপ বলে কথা।এই ডাক পড়ছে অপারেশন থিয়েটারে,একটা অপারেশন শেষ হতে না হতেই আবার ডাক পড়ছে লেবার রুমে।তবে কাজ করতে আমার ভালই লাগছিল।বিশেষ করে ডেলিভারি করানোর পর বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে।হোক সেটা নরমাল ডেলিভারি কিংবা সিজার।
বাচ্চাগুলোর প্রতি কেমন জানি একটা টান অনুভব করতাম। কি হবে তার নাম,কি লেখা আছে তার ভাগ্যে, আমার হাত দিয়ে যার জন্ম!!আবার বাচ্চাগুলি যখন অকারণে চুপ করে থাকত,অক্সিজেন সিপিআর দিয়েও জেদ ভাঙানো যেতনা তাদের,তখন মনে হত কি জবাব দিব আমি তার মায়ের কাছে?ডাক্তাররা যে বড় অসহায়, নিয়তির কাছে!!
সেদিন রাতের ঘটনাটা ছিল আমার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা।প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে লেবার রুমে ঢুকলাম।রোগীর নাম ছিল দোলেনা।হঠাৎ করে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে ওর।অক্সিজেন দেয়া হয়েছে কিন্তু ততক্ষণে বাচ্চার হৃদপিণ্ড খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে।মায়ের প্রসব ব্যাথা থাকায় বাচ্চা ডেলিভারি করাতে কোনো সমস্যা হল না আমার।পৃথিবীতে আসা মাত্রই সে কি কান্না তার!! চল্লিশ সপ্তাহের বাচ্চা বলে কথা।”যাক্,বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল”- এই বলে যখন আমি প্লাসেন্টা বের করতে যাব,তখন হঠাৎই আমার হাত চেপে ধরল দোলেনা।বিড়বিড় করে সে কি যে বলল আমি ভাল বুঝতে পারলাম না।
দোলেনার বাচ্চাটা তখনও খুব কাঁদছিল।হয়ত সে বুঝতে পেরেছিল মা তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।হয়ত মাকে বিদায় দিতে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
রাত তিনটার সময় আমি দোলেনার ডেথ সার্টিফিকেট লিখলাম।মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিখলাম পালমোনারি এমবোলিজম।তারপর অনেক দিন পার হয়ে যায়। বছরখানেক তো হবেই। এর মধ্যে জন্ম মৃত্যুর খেলা খেলতে খেলতে আমাদের ইন্টার্নশীপও শেষ হয়। একদিন রাতের কথা।কি জানি একটা স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে গেল।বাইরে তখন প্রচণ্ড জোরে বজ্রপাত হচ্ছিল। এরই মাঝে মনে হল কে জানি আমাকে ডাকছে।খুব সাবধানে পা ফেলে আমি ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম।আওয়াজটা আরও স্পষ্ট হল। –“ডাক্তার আপা, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান, ডাক্তার আপা।”
ক্রমাগত বেজেই চলেছে সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর।ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছিল।কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বললাম- “কে আপনি?”
–” আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি দোলেনা।”
— “কে দোলেনা? কোন দোলেনা?”
— “ঐ যে সেদিন আপনাকে বলে গেলাম আমার বাচ্চাটাকে দেখতে।”
–“কে আপনার বাচ্চা? আমি কেন তাকে দেখতে যাব?”
এরপর আর সেই কণ্ঠস্বর শুনতে পাইনি।দৌড়ে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙে পরদিন বেলা বারটায়।প্রথমেই মনে পড়ে আগের রাতের ঘটনাটার কথা। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না সেটা স্বপ্ন নাকি সত্যি।হঠাৎ মনে পড়ে গেল লেবার রুমে দোলেনা নামের এক মহিলার মৃত্যুর কথা।তবে কি সেই দোলেনাই এই দোলেনা? রহস্যের সমাধান করতে দ্রুত রেডি হয়ে হসপিটালে গেলাম।লেবার রুমের পুরনো রেকর্ড ঘাঁটলাম।অনেক দোলেনার ভিড়ে সেই দোলেনাকে খুঁজে পেলাম।ঠিক দুই বছর আগে রাত তিনটায় দোলেনা মারা গিয়েছিল।
“কি হচ্ছে এসব আমার সাথে”– নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।হসপিটাল রেজিস্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে দোলেনার স্বামীর নাম আর ঠিকানা খুঁজে বের করলাম।
“এর একটা সমাধান আমার আজই করা চাই।”
চলে গেলাম ফুলপুর। জনাব সেলিম কে খুঁজে পেতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হল না।তিনি সেখানকার নামকরা ব্যবসায়ী।উনার বাড়িতে গিয়ে যা বুঝতে পারলাম তা সত্যিই দুঃখজনক।রেহানা সেলিমের দ্বিতীয় স্ত্রী,যিনি কিছুতেই দোলেনার সন্তানকে নিজের সংসারে রাখতে চান না।সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটার জন্য মায়ায় আমার বুকটা ভরে উঠল।আমি থাকতে কেন তার স্থান অনাথ আশ্রমে হবে? সেদিনই আমি ছুটকিকে আমার সাথে নিয়ে আসি।আস্তে আস্তে ও বড় হতে থাকে আমার সন্তান হিসেবে।ওকে নিয়ে আমার সংসারে কোনো সমস্যা হয়নি। এভাবেই কেটে যায় ষোলটি বছর।
আজ ছুটকির আঠারতম জন্মদিন।সেই আনন্দে আমার দুচোখে জল এল।ছুটকিকে দেখে কান্না লুকানোর চেষ্টা করলাম।কিন্তু পারলাম না।
–” কাঁদছ কেন মা?”
–” কই,কাঁদছি না তো।”
–” তাহলে চল কেক কাটব।”
–” চল্ তবে।”
রাত বারোটা এক মিনিটে আমরা কেক কাটলাম।প্রতি বছরেরর মত এবারও কোথা থেকে যেন একটা মিষ্টি হাওয়া এসে গায়ে লাগল আমাদের।
–“দেখেছ মা, এবারও প্রকৃতি আমায় উইশ করতে ভুলেনি।”
ছুটকির মুখে কথাটা শুনে হঠাৎ চমকে উঠি আমি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

শিউলীফুল - ডা.আল্ - আফরোজা সুলতানা

Tue Sep 4 , 2018
প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১৯ ” শিউলীফুল ” লেখকঃ ডা.আল্ – আফরোজা সুলতানা সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ  (সিওমেক) ২০১১-১২ চশমার কাচ টা আলতো করে ঘসে নিয়ে আবার চোখে পড়লেন জব্বার সাহেব। চারপাশ টা কি আসলেই ঘোলাটে? নাকি চশমার কাচ ঘোলা তা ঠাহর করতে পারছেন না। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বুঝলেন ঘোলাটে […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo