যদি ডিপ্রেশনে থাকতেই ‘ভালো লাগে’ তাহলে পড়ার দরকার নাই এই লেখা। যদি বের হয়ে আসতে চান এই ডিপ্রেশন থেকে, তাহলে পড়ে দেখতে পারেন। ‘বিফলে মুল্য ফেরত’ বলবো না, তবে অন্তত এইটুকু বোঝাতে পারবো, ‘তুমি একা নও’!!
## প্রথম কথা হল, মেডিক্যাল লাইফ, কষ্টের লাইফ সেটা আমরা ভর্তি হবার আগেও জানতাম। এটা নাকি বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন সিলেবাসের পড়া। এই ব্যাপারে আমার অমত আছে, কারন সব পড়াই কঠিন, সেটা যাই হোক। মেডিক্যালটা কঠিন কেবল তার সিস্টেমের কারনে, ফেল হবার রিস্কের কারনে। আর কিছু না। তাহলে বলেন, এটা একটা জানা কথা হবার পরেও কেন ভাবতে বসে যান? কেন পড়তে পড়তে পড়ার চাপে ডিপ্রেশনে চলে যেয়ে পাগলু হয়ে যান?!!
ভালো রেসাল্ট করার উপায় সিক্রেট হতে পারে, কিন্তু পাস করার উপায় তো খুবই সহজ! হাজার বার বলেছি! প্রতিটা লেকচার টিউটোরিয়াল করেন – স্যারদের কাছে ‘ভালো ছেলে/ ভালো মেয়ে’ হিসেবে চেহারা চেনান- যেটা বুঝেন না বন্ধু থেকে ডেমো খান – বই খুলে বারবার পড়েন – যারা পাস করে, তারা কিভাবে উত্তর করে পাস করে সেটা ফলো করেন – যদি কেউ তেল মেরে পাস করে, আপনিও তেল মারেন – কেউ মুখস্ত করে পাস করলে, আপনিও তাই করেন …!
ক্লাসের ১০০ টা ছাত্রের মধ্যে ১০০ জনই কষ্ট করে, ভীষণ হতাশায় ভোগে। তবুও ৯০ জন হতাশ থেকেও পড়া চালিয়ে যায়। বাকি ১০ জন এলোমেলো হয়ে যায়, সেখান থেকেও ৫ জন একদিন লাইনে ফিরে আসে। বাকি ৫ জনের ৪ জন ভেসে যায়, হয়ত ১ জন আত্মহত্যা করে … !! তাহলে ৯৯ জন মানুষ যেটা করলো না, আপনি সেটা করতে গেলে … আমার তো মনে হয়, সমস্যা মেডিক্যালের পড়ায় না, সমস্যা আপনার!! আপনার!! আপনার!!
## দ্বিতীয় কথা হল, আপনি দাবি করেন আপনার মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা ছিল না। আপনার পাষাণ বাপ-মা তাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য আপনাকে ধরে বেঁধে ডাক্তার হতে দিয়ে গেছে! তাই আপনি হতাশ! আপনি অনেক ক্রিয়েটিভ! আজকে যদি নিজের পথে চলতে পারতেন, তবে একদিন দেশ বরেন্য লেখক হতেন – পর্দা কাঁপানো অভিনেতা হতেন – ছবি একে দুনিয়া মাতাতেন – ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হতেন – গায়ক হতেন – নদীর মাঝি হতেন – ঘাস ফুল পাখি হতেন …!! আপনার জীবনে কোন হতাশা থাকতো না, নিত্যদিন নান্দনিক আবেশে জীবন কেটে যেত আপনার!!
… ভাই থামেন!! হতাশার দেখসেন কি?!! ক্রিয়েটিভ লাইনেও কি সুখ আছে রে, পাগলা!? পাবলো পিকাসো একটা ছবিও জীবদ্দশায় বেচতে পারে নাই –টাকার অভাবে না খেয়ে মরেছে। মাইকেল মধু/ জীবনানন্দের কবিতাকে পাগলের অপলাপ বলা হয়েছে, অ- কবিতা বলা হয়েছে। লিওনার্দো ডি কাপ্রিও এখনো একটা অস্কার হাতে পায় নি। তারা হতাশ ছিলেন না?!! তারা ভেবেছেন না, কি পেলাম এই জীবনে!!? ধুর!! মইরা যাই?!!
ক্রিয়েটিভ কিছুতে যে আপনি ভালো করতে পারেন সেটা জানা ছিল না, দুনিয়া মাতাবার সুযোগ পাবেন কিনা সেটার গ্যারান্টি ছিল না, দুনিয়া মাতালেও বেঁচে থেকে দুইটা ভাত যোগাড় করতে পারেন কিনা, সেই গ্যারান্টি ছিল না! … খালি পেটে কিসের ক্রিয়েটিভিটি ফলাবেন?!! বাপ-মা আপনার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই এমন একটা ‘বিদ্যা’ আপনাকে দিতে চেয়েছেন, যেটা হাতে নিয়ে আপনি বটতলায় বসেও দুইটা রুগী দেখে দুইটা পয়সার রুটি কিনে খেতে পারবেন! কিন্তু না, আমরা সেটা বুঝবো কেন?! আমাদের ভালো চাওয়া, সহ্য হয় না আমাদের!!
## তৃতীয় কথা হল, দুনিয়া দুনিয়াই, এটা বেহেশত না !! আপনি হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকবেন, আর দেবতার মতো শিক্ষক আপনাকে পড়া গিলিয়ে যাবে – দেবশিশুর মতো রুমমেটরা আপনি পিছিয়ে পড়লে আপনাকে প্রেরনা দিয়ে যাবে – সব পড়া পারেন, কিন্তু ডাক্তার সুলভ এটিচুড হয়নি তবুও দেবদূতের মতো এক্সটারনাল স্যার আপনাকে পাস করিয়ে যাবে … সেই ভাবনা ছাড়েন, ভাই!! এখানে আপনাকেই অর্জন করতে হবে সব!!
ফার্স্ট ইয়ারে ‘এন ম্যাম’ এর পড়া কিছুই বুঝতাম না। তিন মাস, টানা তিন মাস আমি কাঁদছি ক্লাস শেষে! মনে হতো শুধু আমিই বুঝি না, সবাই তো নিশ্চয়ই বুঝে!! না, পরে বুঝেছি কেউই বুঝে না তার পড়ানো। তাতে, কি হইসে?!! সেই ম্যামের জন্য আমি ডিপ্রেশনে চলে যাবো?!!
ভাগ্যিস যাই নি। ৮ বছর পর যখন বিএসএমএমইউ তে এমডি পার্ট ১ ভাইভা পরীক্ষা দিচ্ছি, একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম। স্যার জিজ্ঞেস করেন, কোন মেডিক্যাল ?! সিএমসি, শুনেই বলেন, তুমি ‘এন ম্যাম’ এর ছাত্রী, সে জন্যই তো পেরেছো !! সেদিন বুঝলাম, আমাদের অনেক স্যার ম্যামদের ক্যাপাবিলিটি বুঝার বয়স তখন আমাদের হয় নি বলেই উনাদের উপর আমরা হতাশ হতাম। বাস্তব কথা হল, যেদিন বুঝবো, সেদিন উনাদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। কাছে যেয়ে বলতে পারবো না, আমাদের পড়াবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ম্যাম!
আপনার রুমমেট আপনারই বয়সী, সেও খাবি খাচ্ছে তার পড়াশোনা নিয়ে – জীবনের নানা টানাপড়েন নিয়ে। কেন ভাববেন যে, সে আপনাকে খুব সহযোগিতা দেখানোর দায় নিয়ে দুনিয়ায় এসেছে?!! সে তার মতো চলবে, আপনার কপাল খুব ভালো হলে হয়ত টেনে তোলার মতো বন্ধু পাবেন, নয়ত না।
আপনি পাস করেন নি বলে, সে নিজের সাড়ে পাঁচ বছরের অর্জনের আনন্দ ভুলে মাতম করবে?! তারও একটা কষ্টের গল্প আছে, ভুলে যাবেন না। সে স্বাভাবিক উচ্ছাস করলো মানেই আপনাকে যন্ত্রণা দিতে করছে, সেটা যদি ভাবেন তাহলে সমস্যা আপনার! আপনার! আপনার!
## চতুর্থ কথা হল, আপনি বলবেন, এহ!! বলা সহজ – কিন্তু করা তো কঠিন!!
মেনে নিলাম আপনি একদম ঠিকঠাক ভাবেই সব ফাঁড়া কাটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অতন্ত্য অন্যায় ভাবে আপনাকে ফেল করানো হয়। সেদিন একটা আপুর কথা ভেবে মনকে শক্ত করবেন। সেই আপুটা ফাইনাল প্রফে প্লেস নাম্বার পেয়ে বসে ছিল। কিন্তু গাইনির মতো নস্যি একটা বিষয়ে অবিশ্বাস্য ভাবে ফেল হয়ে যায় দুই তিন নাম্বারের জন্য!! সবাই জানে, এটা ঠিক হয় নি, কিন্তু ভেবে দেখেন … সেই আপুটার কি অবস্থা! রেসাল্ট খারাপ হলে ডিপ্রেশনে যাওয়াটা যদি আপনার কাছে যৌক্তিক বলে মনে হয়, তবে এমন অন্যায় হলে তো ডিপ্রেসড হওয়াটা অধিকার! তাই না?! কিন্তু না, আপুটা সাহসের সাথে ওই সময়টা পার করেছে, এখনো অনেক ভালোই আছে।
মানলাম, আপনার পারিবারিক সমস্যা আছে – আর্থিক সমস্যা আছে – হৃদয় ঘটিত কাহিনী আছে। … খুঁজে দেখেন, একটা ছেলেকে পাবেন যে কিনা ফার্স্ট ইয়ার থেকেই নিজের পরিবারের সকল খরচ দিচ্ছে!! একটা মেয়ে পাবেন যে পরীক্ষার আগের দিনেও টিউশনিতে যাচ্ছে, কারন টিউশনিটা ধরে রাখা একই রকম জরুরী। খোঁজ নেন, আপনারই কোন বন্ধুর বাবা-মা নিত্য মারামারি করছে – কারো শৈশব কেটেছে ভাঙ্গা সংসারে – কারো সকল সৌভাগ্য নিঃশেষ হয়েছে পিতার ঘুষের বিষে!! ভুল মানুষের হাত ধরেছে – মন দিয়েছে – শরীর দিয়েছে , হৃদয় ভেঙ্গেছে – কিন্তু মনটা এখনো ফেরাতে পারে নি … !! কত কত কত কারন সবার হতাশার! খুঁজে দেখুক একবার, আপনার চেয়ে আপাত ভালো যারা আছে, তাদের ভেতর নয়! আপনার চেয়ে খারাপ যারা আছে তাদের ভেতর দেখেন।
গান শোনেন, ছবি আঁকেন, দুইটা টোকাই বাচ্চাকে পড়াতে বসান, সুযোগ পেলে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়েন … কিছুই করতে না ইচ্ছা করলে চরম ডিপ্রেসড সময়টায় একটা লম্বা ঘুম দেন!! কি আছে কপালে!! ঘুম থেকে জেগে দেখবেন সব ফকফকা!! মাথা ক্লিয়ার!!
মাথার উপর স্টুডেন্ট এর লেবেলটা যতদিন লাগানো আছে, কিসের এতো হতাশা?! জাস্ট ছাত্রজীবনটা পার হয়ে চাকরি করতে যাবেন যেদিন, ঘর সংসার হবে যেদিন, দুনিয়াদারী দেখবেন যেদিন … ডিপ্রেশনের আসল কারন সেদিন দেখতে পাবেন।
জানবেন, ঠিক উত্তর না দেয়ার জন্য স্যার বকা দিতেন, অথচ ঠিক কথা বলার জন্যই বসের ল্যাং খেতে হয়! আরও ভালো করার জন্য কলেজ আপনাদের টাইটে রাখে, অথচ সংসারের বেশীরভাগ সদস্য আরও টাইট দিবে যেন আপনি আরও খারাপ করুন!! আসে পাশের বন্ধুরা হয়ত কোন উপকার সাধন করেনি, অথচ কলিগরা এক পায়ে খাঁড়া আপনার ক্ষতি সাধনের জন্য!! আল্লাহ্র দোহাই, বিশ্বাস করেন, সেই দিনগুলো বেশী দিন পরের কথা নয়। কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাবেন, সেদিন বুঝবেন কত সামান্য ব্যাপার নিয়ে আজ ডিপ্রেশনে আছেন আপনি!!
হ্যাঁ, এতো বকবক আপনাদেরকেই বলছি। দেখি, হাত তোলেন, কারা কারা ডিপ্রেশনে ভোগেন …?
দাঁড়ান, আমিও লেখাটা একটু স্টপ করি! আমারও হাত তুলতে হবে তো, তাই!!
জ্বি! আমিও মাঝে মাঝে ডিপ্রেশনে ভুগি। বেশ ভালো ভাবেই ভুগি, এতোটাই যে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে মন চায়! আমাকে যারা চিনেন, তারা নিশ্চয়ই খুবই অবাক হচ্ছেন, দুনিয়ার এতো কিছু পেয়েও কেন মরতে চায় কেউ!! বিশ্বাস করেন, “কি জানি, কিসেরও লাগি, প্রান করে হায় হায়!” আমাদের সকলেরই হয়!! কারনেও হয় – অকারনেও হয়!
জন্ম নিয়েছেন, তাই মরে যাওয়াটা শেখার মতো কিছুই নাই।
বরং বেঁচে থাকাই শিখতে হয়। অন্য কোন জনম পেলে বাকি কিছু শিখবো!
এ জনমে চলেন, অন্তত বেঁচে থাকাটা শিখে নেই।
লিখেছেন: ডা. তাহসিনা আফরিন
এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি-আফ্রিকা উইং, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
রেডিয়েশন অনকোলজি (এমডি-পার্ট ২), জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতাল
পরিমার্জনা: বনফুল
Pray sob koyta point e amar sathe mile jaitese….. 🙁 😛 Nah…ei xcuse gula r dea jabe na….. 🙁
Rashmin sharif
Excellent. …
21
Shudhu Medical Student Der nea kano ???
Amra in general people Der nea likhle aro beshi upokrito hotam ….
Onek expectation nea Article ta open korechilam ..
Pore Dekhi lollll