১….
গল্পের বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিলো মাত্রাতিরিক্ত রকমের। ক্লাস থ্রি তেই আমার যে ছোটখাটো লাইব্রেরি ছিলো তার বইসংখ্যা ছিলো ৪০০ এর মত।বইয়ের আরেক জগত আমি আবিষ্কার করেছিলাম রামকৃষ্ণ মন্দিরের ভেতরে অবস্থিত এক লাইব্রেরিতে।সমসাময়িক বন্ধুরা যখন বিকেলে খেলাধুলা করে, আমি তখন সময় কাটাই মন্দিরের ভেতর লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ে।
যখন আইডিয়াল স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো, প্রতিটা ক্লাসে ছোটখাটো একটি লাইব্রেরির মত কাঠামো দাঁড় করানো হলো। গল্পের বই পিপাসু আমার আনন্দ তখন ছিলো দেখার মত।
ক্লাস এইটে যখন পড়ি তখন আমি ৩০ টি বইয়ের একটি লিস্ট তৈরি করেছিলাম, যে বইগুলো জীবদ্দশায় আমার পড়া উচিত।এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ টি বই পড়েছি, যদি বেঁচে থাকি তবে চাকরি থেকে অবসরে যাবার পর অধিকাংশ বই পড়ব, এই আমার প্ল্যান।
যে তিনটি বই আমি পড়েছি, তার একটা হলো #Crime_and_Punishment, ফিওদর দস্তয়ভস্কির একটি ফিলোসফিক্যাল নভেল।উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক বিত্তশালী বুড়িকে খুন করার পর কিভাবে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পানিশমেন্ট পায়–তার বর্ণনা এই নভেলে দেয়া হয়েছে।
বইটি আমি পড়ি ২০১০ সালে।আমি তখন ইন্টার্নশীপ কমর্প্লিট ও FCPS পার্ট ওয়ান পাশ করে সপ্তাহে একদিন নিজগ্রামে গিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি।বইটি কাঠখোট্টা টাইপের, পড়তে সময় লাগছিলো।বইটি যখন পড়ছি এমন সময় একদিন একটি unknown নাম্বার থেকে ফোন এলো।
ফোন করেছে কোনো এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একজন লোক।নিজের পরিচয় দিয়ে তৈলাক্ত কণ্ঠে তিনি জানালেন নিজগ্রামে যেখানে চেম্বার করি সেখান থেকে কিছু পেশেন্ট সেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে ইনভেস্টিগেশন করিয়েছে।কমিশন বাবদ আমার নামে একটি খাম তিনি দিয়ে এসেছেন।খামটি হাতে পেয়ে আমি যেন তাকে আবার ফোন ব্যাক করি।
বয়স অল্প ছিলো, পৃথিবীর কুটিলতা তখনও আমাকে তেমন স্পর্শ করেনি।”অভিশপ্ত” সেই খামটিকে স্পর্শ করার সাহস আমার তখন হয় নাই।
২.
বিসিএসে যাবার ইচ্ছা আমার কখনই ছিলো না।কাজেই Government job এ জয়েন করার পর থিতু হতে আমার সময় লেগেছে।
দেশের প্রান্তীয় অঞ্চলে গিয়ে থিতু হবার দুই-তিন মাস পর থেকেই আমার নাম এ আবার একাধিক স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অভিশপ্ত খাম আসা শুরু করলো।
সামনে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যে লোকটিকে পেলাম তাকে আমার নামে কোনো খাম দিতে বারণ করলাম এবং এও বললাম যে–‘যাদেরকে আমি পরীক্ষাগুলো করাতে ICDDR’B বা BSMMU পাঠাবো, তাদেরকে আপনারা দয়া করে কনভিন্স করে আপনাদের সেন্টারে পরীক্ষাগুলো করিয়ে দিবেন না….’
ফল হলো ভয়াবহ।ঘটনার দুই-তিনদিন পর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকটি এসে আমাকে নানাভাবে বোঝালো আমি যাতে এই ধরনের কথা আর না বলি…..
আমাকে এও বললো–“চেয়ারম্যান সাহেব কিন্তু আপনেরে সালাম দিছে…”
সালাম শব্দের অর্থ ‘শান্তি বর্ষণ’।কিন্তু সালাম যে ভীতিকরও হতে পারে-আমি সেদিন সেটা বুঝেছিলাম…..
৩…..
দিন যায়, মাস যায়।অভিশপ্ত খাম আসতে থাকে। আমি চুপচাপ থাকি, পাছে আবার কেউ ‘সালাম’ দিয়ে বসেন, চিকিৎসা দিতে এসেছি, যুদ্ধ করতে নয়। আমি খামগুলো আমার ড্রাইভারকে দিয়ে দেই যাতে রাস্তায় গরীব লোক পেলে তিনি তা বিলিয়ে দেন।ড্রাইভার সাহেব আনন্দিত মনে টাকা বিলান….
একদিনকার ঘটনা বলি।আউটডোরে রোগী দেখছিলাম।এক বুড়ীমা এসে তার কোমড়ের এক্সরে আমার সামনে মেলে ধরেছেন আর চোখের পানি ফেলছেন।এক্সরেটা আমিই করতে দিয়েছিলাম, প্রয়োজন ছিলো….
কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করলাম।বললেন, এক্সরে করার টাকা তার ছিলো না, ছেলে তার বউ নিয়ে থাকে, তাকে কোনোরকমে খাওয়াদাওয়া দেয়, এক্সরে করার টাকাটা তাকে আরেকজনের কাছ থেকে ধার করতে হয়েছে….
সরকারী হাসপাতালের এক্সরে মেশিন নষ্ট, তাই বুড়ীমাকে পরীক্ষাটি করাতে হয়েছে স্থানীয় এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।হয়ত মাস শেষে বুড়ীমার এই কান্নামিশ্রিত ধার করা টাকা আমার কাছে খামে ভরে আসবে।আমার আর সহ্য হলোনা….
ওইদিন দুপুরে একসাথে সব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকদের ডেকে তাদেরকে বললাম, ” আজ থেকে আমার নামে যাতে কোনো ধরণের খাম না আসে।এই অভিশপ্ত জিনিস আমাকে আর আপনারা দেয়ার চেষ্টা করবেন না।আমার কোনো রোগী যদি কোনো ভাবে আপনাদের কাছে যায়, তারা যেন অটোম্যাটিকেলী সর্বোচ্চ ডিসকাউন্টটা পায়….”
আমি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকদের রিজেক্ট করলাম।এর ফল আমার জন্য ভয়াবহ হতে পারতো, এই সিন্ডিকেট সর্ম্পকে যার আইডিয়া নেই তারা ধারণাও করতে পারবেন না যে তারা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। বুড়ীমার চোখের পানি আমাকে সাহসী করে তুলেছিলো….
৪….
প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, “ ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়”। আমি একমত ছিলাম, তবে এখন নই, মানসিক সুস্বাস্থ্য কিন্তু সংক্রামক।এক্সপ্লেইন করি….
আমি যখন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোকদের ডেকে বোঝাচ্ছি যাতে আমার নামে কোনো “অভিশপ্ত খাম” ইস্যু না হয়, আমি যখন বেশ Tensed, তখন আমার এক কলিগ কথোপকথন শুনে আমাদের কাছে আসে।সব কথা শুনে আমার সাথে সাথে সেও ঘোষণা করলো যাতে তার নামেও কোনো খাম ইস্যু না হয়….
একটি পাথর আমার বুক থেকে নেমে গেলো।ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আমি যখন নিজেকে একলা মনে করেছিলাম,
Muhammad Munir তোমার প্রতি আমার সম্মান আজীবন থাকবে…..
৫….
অন্যান্য দেশের জন্মইতিহাসের সাথে আমাদের দেশের জন্মইতিহাসের পার্থক্য রয়েছে।এই দেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তগঙ্গার উপরে।যে দেশের জন্ম এত মর্যাদাময় সে দেশকে আমরা দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছি।আমরা ভুলে যাই-এদেশের প্রতিটি সেক্টরে আমরা যখন সীমাহীন দুর্নীতি চালাই তখন এই ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তকে অবলীলায় পদদলিত করি……
এই দেশের বিভিন্ন সেক্টরে যারা দুর্নীতি করেন তারা কি এটা বোঝেন যে তারা তাদের সন্তানের শরীরে অবৈধ উপার্জনকে প্রবেশ করাচ্ছেন? তারা কি বুঝতে পারেন যে তাদের সন্তানের শরীরের লোহিত রক্ত কণিকা বেড়ে উঠছে তারই অন্যায় উপার্জনে? তারা কি তাই চান? যারা দুর্নীতি করেন তারা কি একটিবারও চিন্তা করেন–তার স্ত্রী তার উপার্জনে সাময়িক খুশী হবার অভিনয় করলেও একান্তে নিভৃতে তার স্বামীকে কতটা নীচু মনে করেন? এই ঘৃণ্য মানব জীবনের অর্থ কি?
৬….
দেশের সব সেক্টরে দুর্নীতি আছে, স্বাস্থ্যখাতেও বহুমাত্রিক দুর্নীতি আছে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে অন্যান্য সেক্টরে দুর্নীতির চিত্র আরো ভয়াবহ।সেটা কিভাবে বললাম? নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।এরপরও একটি থিওরেটিক্যাল এক্সপ্লেনেশন দেই।শিক্ষার মূল কাজ মানুষকে আলোকিত করা।যদি আমরা তা মেনে নেই, তবে বুঝতে হবে স্বাস্থ্য ও ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে আলোকিত মানুষ বেশী….
এরপরও অন্য সেক্টর রেখে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে কথা বলছি কেনো?
তার কারণ, প্রথমত, আমি এই সেক্টরের একজন সদস্য।দ্বিতীয়ত, আমরা যদি নিজেদের আলোকিত মানুষ দাবী করি, তবে অন্ধকারকে বিদায় জানানোর কাজটা আমাদেরকেই শুরু করতে হবে, নিজেদের সেক্টর থেকেই সেটা শুরু করাটা সমীচীন, শুদ্ধিকরণ নিজের ঘর থেকে স্টার্ট হোক…..
ডিএমসিতে যখন নিউরোলজীতে ট্রেনিং করি তখন রাউন্ডে একদিন Legendary প্রফেসর ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ স্যার বলেছিলেনঃ
“আমাদের পোশাকটা সাদা, কালির অল্প ছিটা লাগলে সেটা বেশি করে চোখে পড়ে….”
অল্প কিছু সদস্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কমিশন নেয়, তার ছিটা লাগে পুরো চিকিৎসক সমাজে।এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন….
কয়দিন আগে একটা রিপোর্টিং দেখলাম–ঢাকায় কোন্ কোন্ ডাক্তার কমিশন নেয় তার একটি লিস্ট দেখানো হলো।প্রশ্ন হলো-সে লিস্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেনো? আমরা কতদিন কালপ্রিটদের পাপের বোঝা বহন করবো? এটি বন্ধ করার পার্মানেন্ট ব্যবস্থা কি? আইনজ্ঞরা কি বলেন? আমাদের কোনো হেল্প লাগলে আমরা অধিকাংশ চিকিৎসক তা করতে তো রাজী আছি…..
৭….
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী হলেন মানসা মুসা।তার সম্পদের পরিমাণ নাকি এত বিশাল ছিলো যে তা গণনা পর্যন্ত করা যায়নি।সর্বকালের এই ধনী ব্যক্তিও মৃত্যুর সময় একটি কপর্দক সাথে করে নিয়ে যেতে পারেননি।ইতিহাসের এই শিক্ষাটি কি আমরা কখনো অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি?
মরমী কবি ও বাউল শিল্পী হাসন রাজার গানের কয়টি লাইন বলি, গানটি সবারই জানাঃ
“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা
নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই
মাঝার…….”
১২৫-১৩০ বছর আগে রচিত যে গান শুনে আমরা মুগ্ধ হই তার মর্মার্থ আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি? যদি চিন্তা করেই থাকি, তবে অবৈধ অর্থে ‘শূন্যের মাঝে’ আমরা কেনো একের পর এক স্থাপনা রচনা করার জন্য লালায়িত হই? কপর্দকহীন অবস্থায় এই রহস্যময় পৃথিবীতে এসেছি, কপর্দকবিহীন অবস্থায় আমাদের চলে যেতে হবে।এই পরম সত্যটা আমরা কবে বুঝব?
….
ডা. জামান অ্যালেক্স এর ফেইসবুক থেকে লেখাটি সংগৃহীত, ঈষৎ পরিমার্জিত।
https://www.facebook.com/ashaduzzaman.kanak
vai ur writing gives us inspiration to fight against all odds…pls write…..