চেম্বারে বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে মন খারাপ করা কিছু লেখা দেখলাম। স্যারদের নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশ ভাল, বলা চলে ১০০% ভাল।
ঘটনা-১ঃ আমি তখন প্রথম বর্ষে। মেডিকেলে চান্স পাবার পর প্রথম বাবাকে নিয়ে কোন চেম্বারে গেছি জাদরেল এবং গম্ভীর এক সহযোগী প্রফেসর স্যারের কাছে। পরিচয় পর্ব শেষে বেশ হাসি খুশি ভাবে কথা বললেন। ওষুধ লিখে আমাকে ভালমত ব্রিফ করলেন। এবার ভিজিট দেবার পালা, বাবা পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাচশ টাকার নোট এগিয়ে দিলেন, স্যার চশমার উপর দিয়ে নোটের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললেন, আপনার ছেলে কি করে? বাবা হেসে বললেন, মেডিকেলে পড়ে। স্যার বললেন, আমি ওর কে হেই? বাবা হাসলেন। উনি ধমকের সুরে বললেন, আমাকে টাকা দিচ্ছেন কেন?? .. গর্বে বুকটা ফুলে গেল।
ঘটনা-২ঃ মায়ের ডায়বেটিস ধরা পড়েছে। নিয়ে গেলাম সেরা একজন এন্ড্রোক্রাইনোলজিস্টের কাছে। উনি রাত ২ পর্যন্ত রোগী দেখেন, বলা চলে সিরিয়ালের জন্য মারামারি চলে। পরিচয় দিয়ে মাকে দেখালাম। ভালমত দেখলেন, নিজেই ব্লাড প্রেসার মাপলেন, সাথে ব্লাড সুগার টেস্ট দিয়ে আমাকে বললেন কাল মেডিকেলে আমার চেম্বারে রিপোর্টটা দেখিও। ভিজিট দিতে গেলেন মা, ফিরিয়ে দিলেন তিনি। প্রেসক্রিপশনের উপরে “Mom of medical student” বড় করে লিখে রেখেছেন। মা প্রায় ৪ বছরের বেশী সময় ধরে ওনার চিকিৎসা নিচ্ছেন আজ পর্যন্ত ১ টা টাকাও নেননি, প্রতিবারেই প্রেসক্রিপনের উপর একই নোট লিখে রাখেন.. কৃতজ্ঞতা কিভাবে জানাই?
ঘটনা-৩ঃ বাবার ক্যাটারাক্ট অপারেশন করাবো, ভাল দেখেন না, সেরা সার্জনের কাছে অপারেশন করাতে চান। যিনি সেরা তার সিরিয়াল ২ সপ্তাহ আগে দিতে হয়। দরজার মামাকে ম্যানেজ করে বিনা সিরিয়ালে দেখালাম। পরিচয় দেবার পর ভালমত দেখলেন, ব্রিফ করলেন। অপারেশনের ডেট দিলেন, নিজ ক্লিনিকে অপারেশন করাবেন। ভিজিট দিতে গেলে তা ফিরিয়ে দিলেন। অপারেশনের দিন থিয়েটারের সামনে দাড়িয়ে, স্যার ভেতর থেকে ডাকলেন, বললেন মাস্ক পড়ে দাড়িয়ে থাক। থাকলাম, আপারেশন শেষে কনসালটেন্ট রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন, বিলের ফাইল তৈরী হয়েছে। স্যার বললেন, লেন্সের দামটা শুধু দিও সাথে ওটি চার্জ, আমার কোন চার্জ দিতে হবেনা। সবমিলিয়ে চার্জ মাত্র ৫ হাজার করেই চলে গেলেন। স্যারকে ঠিকমত কৃতজ্ঞতাটাও বোধহয় জানাতে পারলাম না।
ঘটনা-৪ঃ বড় আপাকে নিয়ে গেলাম অর্থোর ডিপার্টমেন্টাল হেডের কাছে। বেশ হাসি-খুশি স্যার, তবে ভাইবোন ইথিক্স অনুসারে ফ্রি ট্রিটএবল নয় জন্য আপাকে আগেই বলে রেখেছি ৫০০ টাকা দিতে। পরিচয় দিতেই স্যার হেসে পাড়াশোনা কেমন চলছে তার খোজ খবর নিলেন। যত্ন করে দেখলেন, কিছ ব্যায়াম শেখালেন এরপর প্রেসক্রিপশন লিখে আমাকে দিলেন। আপা স্যারকে টাকা দিতেই উনি মুচকি হেসে টাকাটা আমার বুক পকেটে ঢুকিয়ে দেন, আর বলেন, তোমার আপুকে ঠিকমত ওষুধ বুঝিয়ে দিও। অসম্ভব একটা সুখানুভূতি নিয়ে চেম্বার থেকে বের হলাম।
ঘটনা-৫ঃ ছোট আপাকে নিয়ে গেছি এক গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট এর কাছে। পরিচয় শেষে ভিজিটের পালা। স্যার অমায়িক হাসি দিয়ে বললেন, আমার ছাত্র নিজে চলে এসেছে, টাকা কি নেয়া যায়? — শুনেই মনটা ভাল হয়ে গেল।
ঘটনা-৬ঃ মেজ আপার প্রেগনেন্সির ৪ মাস, মাঝরাতে হুট করে লেবার পেইন, অ্যাবরশন হতে যাচ্ছে। স্যারকে ফোন দিতেই উনি বললেন মেডিকেলে নিয়ে যাও এতরাতে ক্লিনিকে কেউ নেই। ভর্তি করালাম নিজ কলেজে। ইন্টার্ন ভাই অপরিচিত, নিজের পরিচয় দিলাম। ভাইয়া রেজিস্টার ম্যাডামকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। ম্যাডাম বলা চলে প্রায় দৌড়ে আসলেন আরো কয়েকজনকে নিয়ে। বললেন ব্লাড লাগতে পারে। এক বন্ধুকে ফোন দিলাম, সে সন্ধানীর চাবিটাই আমাকে দিয়ে বলল ব্লাড যা লাগে ফ্রিজ থেকে নিয়ে নিস। নিজেকে এত বড় গর্বিত কখনো মনে হয়নাই। পুরো সময়টাই ম্যাডাম পাশে ছিলেন, রিলিজের সময় ম্যাডামকে থ্যাংকস দিলাম তবে কৃতজ্ঞতাটা মনেহয় ঠিকমত প্রকাশ করতে পারিনি।
ঘটনা-৭ঃ বাবা হজ্জে যাবেন, লাংসে হুট করে শ্যাডো ধরা পড়ায় মেডিকেল কলেজে রেফার করেছে কনফার্ম করবার জন্য। বাবাকে নিয়ে গেলাম ডিপার্টমেন্টাল হেডের চেম্বারে, রোগী দেখে সময় কুলোতে পারেন না। স্যারকে চিরকুট আকারে নাম, পরিচয় লিখে মামাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম, স্যার ডেকে পাঠালেন। বাবাকে চেকআপ করে একটা আলট্রাসনোগ্রাম করতে বললেন কনফার্ম করবার জন্য। টাকা নেবার সময় বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিলেন, আর আমাকে বললেন, চিন্তা করোনা, মেডিকেল টিমের আমি হেড। সমস্যা যাই হোক সব ঠিক করে দেব। স্যার কে অজস্রো সালাম।
এগুলো খন্ড ঘটনা, আজ পর্যন্ত কোন স্যারের চেম্বারে গিয়ে খারাপ কোন অভিজ্ঞতা হয়নি। স্যারদের কাছে শিখেছি, কিভাবে প্রকৃত গুরু সুলভ আচরণ করতে হয়। প্রাউড ফর রংপুর মেডিকেল এন্ড প্রাইড টু বি আরপিএমসিয়ান! স্যার আপনারা আমাদের গর্ব। আপনারাই আমাদের শিখিয়েছেন কি ব্যবহার করতে হয়। আপনাদের স্যালুট!