আল্ট্রাসনোগ্রাফি নিয়ে কম বেশি অনেকেরই কিছু ভুল ধারণা বিদ্যমান। এই ভুল ধারণা একদিকে যেমন রোগীর জন্য ক্ষতিকর অন্যদিকে কিছু প্রতারক ব্যবসায়ীদের প্রতারণা করার মোক্ষম উপায়। তাই প্রথমেই আমরা যারা চিকিতসক আছি, তাদের এব্যাপারে সঠিক ধারণা নেয়া প্রয়োজন।
প্রায় সময়ই বিভিন্ন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশানে এডভাইজ হিসেবে লেখা থাকে – প্রেগনেন্সি প্রোফাইল উইদ কালার ডপলার / এনোমালি স্ক্যানিং উইদ কালার ডপলার ( 3D,4D স্ক্যানিং) ইত্যাদি।
অনেক রোগী আবার কালার ডপলার করলেও সন্তুষ্ট না, তিনি 4Dস্ক্যানিংও করতে চায়। বাচ্চার মুখাবয়ব না দেখলে মনে শান্তি পাননা।
এমনকি অনেক ডাক্তার দম্পতিও এর বাইরে না।
এসব কিছুর মূল কারণ, আল্ট্রাসনোগ্রাফি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণার অভাব এবং কিছু চটকদার বিজ্ঞাপনের মোহ।
বর্তমান যগের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি ইনভেষ্টিগেশান হল আল্ট্রাসনোগ্রাম। আর স্বাভাবিকভাবেই যেকোন টেকনোলজির ভার্শন যত উন্নত, ইনভেষ্টিগেশান ক্যাপাসিটি তত বেশি আপগ্রেডেড। আল্ট্রাসনোগ্রাফিও এর ব্যতিক্রম নয়।
আমরা সাধারনত 2D স্ক্যানিং করে থাকি। যা আসলে সাদা-কালোর কম্বিনেশান ছাড়া আর কিছুই না। এই সাদা-কালোকেই বলে গ্রে স্কেল। সাদা-কালোর কম্বিনেশান বিভিন্ন কালারেও প্রিন্ট করা যায়। কিন্তু এই কালার প্রিন্ট কখনই কালার ডপলার না।
ছবিঃ 2D স্ক্যানিং
এবার আসি 3D স্ক্যানিং এ। এক স্লাইস পাউরুটিকে খুব ভালভাবে দেখার জন্য
2D স্ক্যানিং যথেষ্ট। কিন্তু পুরা এক প্যাকেট পাউরুটিকে দেখার জন্য 3Dস্ক্যানিং উপযুক্ত। অর্থাৎ 3D স্ক্যানিং এ ভলিউম বা সারফেস বা উচ্চতা খুব ভাল বুঝা যাবে। ফিটাল মুখাবয়ব দেখার জন্য এই 3Dস্ক্যানিং ব্যবহার করা হয়।
ছবিঃ 3D স্ক্যানিং
এবার আসি 4Dস্ক্যানিং এ। এখানে চতুর্থ মাত্রা হল সময় বা মোশন। অর্থাৎ 3D স্ক্যানিং যখন রিয়েল টাইমে করা হয় তখন তাকে বলে 4D। 3Dস্ক্যানিং এর ভিডিও ফরম্যাট হল 4D. তারমানে 4D ছাড়া কেবল 3Dকখনই করা সম্ভব না। অর্থার সারকথা হল, যখন কেউ 3Dকরতে চায়, তাকে আসলে 4D করতে হবে।
এই 3D,4D তেই লুকিয়ে আছে প্রতারণার মূল রহস্য। কারণ বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে 3Dবললে একরকম রেট, আবার 4D বললে ডাবল রেট। 4D বলে রোগীকে একটা ভিডিও রেকর্ড /সিডি দিবে। রোগীর থেকে অযথা টাকা কামানোর উপায়।
এরপর যে জিনিসটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল কখন এই 3D/4D করতে হবে। প্রেগনেন্সিতে এইটা অনেক জনপ্রিয় একটা স্ক্যানিং। খুব অহরহ এটা করতে দেখা যায়। অথচ অযথা এটা করা অনাগত বাচ্চার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। যদিও এপর্যন্ত সেরকম কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তথাপি আমাদের এব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার।
3D/4D খুব খুব উচ্চমাত্রার শব্দ কম্পাংক ব্যবহার করা হয়। বলা হয়ে থাকে সেটা 2D থেকে প্রায় হাজার গুণ বেশি, যেটা অনাগত বাচ্চার অনেক সফিস্টিকেটেড টিস্যুর জন্য চিন্তার কারণ। হয়ত আপাতদৃষ্টিতে কোন সমস্যা পর্যবেক্ষিত হচ্ছেনা, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এটার ইফেক্ট যে পড়বেনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা।
এনোমালি স্ক্যানিং এর জন্য 2D সবেচেয়ে উত্তম। ৫০-৬০%:সমস্যা 2D তেই ধরা সম্ভব।যদি কোন সমস্যা 2D তে ধরা পড়ার পর কনফিউশন হয় কেবল তখন সেটা কনফার্ম হবার জন্য 3D/4D করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে কখনই নয়। আর বাচ্চার মুখাবয়ব দেখাত ফ্যান্টাসির জন্য 3D/4D করা কখনই উচিত না। প্রথমত এই মুখাবয়বই আসল মুখাবয়ব না, বরং এটা ইলেক্ট্রনিক সফটওয়ারের একটা ভার্শন। সুতরাং কাল্পনিক মুখাবয়ব দেখার ফ্যান্টাসি আমাদের দূর করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থেই। যদিও এটা রিয়েল ফেইস কিন্তু এই ইলেকট্রনিক ফেইস না দেখে বাচ্চা ডেলিভারির পর আসল মুখাবয়ব দেখাই উত্তম।
প্রেগনেন্সি ব্যতিত কিডনি,লিভার বা পেলভিসের জন্য 3D/4D এর কোন উল্লেখযোগ্য কার্যকারীতা নাই। তাই অযথা অকারণে 3D/4D এড়িয়ে চলতে হবে।
এখন আসি কালার ডপলার নিয়ে। ডপলার মূলত চার প্রকার আছে। তারমধ্যে একটা হল কালার ডপলার। এছাড়াও আছে কন্টিনিউয়াস ওয়েভ ডপলার, পালস ওয়েভ ডপলার এবং পাওয়ার ডপলার।
ছবিঃ কালার ডপলার
কালার ডপলার বলতে যে লাল-নীল রংকে বুঝায়, সেটার আসলে অনেক তাতপর্য রয়েছে। এই লাল-নীল রঙ আমাদের রক্তপ্রবাহের গতি প্রকৃতি নির্দেশ করে। কোন টিউমারের ব্লাড সাপ্লাই কিংবা ইনফার্কশন নিশ্চিত করতে কালার ডপলার অতুলিনীয়।প্রেগনেন্সিতে খুব উপকারী একটি স্ক্যানিং হল পালস ওয়েভ ডপলার। এটা দিয়ে আমরা নির্দিষ্টভাবে ধমনী এবং শীরার রক্ত প্রবাহের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে পারি। এমনকি সিরিয়াল স্ক্যানিং করে এটা বলে দেয়া সম্ভব যে কোন মায়ের লেট টার্মে প্রিএকলাম্পশিয়া ডেভেলপ করতে পারে কিংবা করবে। এজন্য আমরা ইউটেরাইন আর্টারি, আম্বিলিকাল আর্টারি ইত্যাদি স্ক্যানিং করে থাকি।
কন্টিনিউয়াস ওয়েভ ডপলার ইকোকার্ডিওগ্রাফিতে ব্যবহার করা হয়।
আর পাওয়ার ডপলার খুব সেনসিটিভ। যখন কালার ডপলারে রক্তপ্রবাহ বুঝা যায়না তখন পাওয়ার ডপলার দিয়ে খুব সামান্য রক্তপ্রবাহ থাকলেও সেটা নিশ্চিত করা যায়।
ছবিঃ পাওয়ার ডপলার
এই ডপলার ও ব্যবসায়ীদের প্রতারণা করার আরেকটি ফাদ। অনেকসময় তারা ডপলার না করে, কেবল 2D স্ক্যানিং কালার প্রিন্ট করে রোগীর কাছে কালার ডপলার বলে চালিয়ে দেয় এবং অধিক ফি আদায় করে নেয়।
সবকছুর মোদ্দা কথা হল- প্রেগনেন্সিতে প্রথম তিন মাস পর থেকে ডপলার স্ক্যানিং করা ভাল। কিন্তু এখানেও মনে রাখার বিষয় হল, এই ডপলার করতে হবে ১ম তিন মাস পরে। কারণ ডপলারেও উচ্চ শব্দতরংগ ব্যবহার করা হয়, যা প্রথম তিনমাসে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এখন যে প্রশ্নটা মনে আসতে পারে সেটা হল- 3D/4D এবং ডপলার উভয় ক্ষেত্রে উচ্চ শব্দকম্পাংক ব্যবহার হলেও কেন আমরা ডপলার প্রেগনেন্সিতে নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রেফার করছি, কিন্তু 3D/4D করছিনা? এর উত্তর আশা করি আপনারা নিজেই পারবেন, তবুও বলছি।
ডপলার করে আমরা প্রেগনেন্সি আউটকাম নির্ণয় করতে পারছি এবং খারাপ ইফেক্টের জন্য পূর্ব থেকেই সতর্ক হয়ে চিকিতসা নেওয়া সম্ভব। কিন্তু 3D/4D ‘র কোন উপযোগীতা প্রেগনেন্সিতে আদতে একেবারেই নেই। তাই যেখানে কিছু উপকারীতা আছে সেখানে কিছু অপকারীতাকে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যেটাতে কোন উপকারই নেই সেখানে শুধু শুধু যেচে ডেকে এনে সমস্যা বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ না। 3D/4D তে যে মোশন আমরা রিয়েল টাইমে দেখতে পাই সেটা আমরা 2D রিয়েল টাইমেও দেখতে পাই।
ছবি কৃতজ্ঞতা: গুগল
এই পোস্টের উদ্দেশ্য আমাদের নিজেদের সতর্ক হওয়া এবং রোগীদের র্যাশনাল সার্ভিস দেওয়া।
ডা. ফাতেমা তুজ জোহরা
নিউক্লিয়ার মেডিসিন
এম.ফিল (পার্ট-২)
BSMMU (NINMAS)
সম্পাদনাঃ তানজিল মোহাম্মাদীন