সব বেলার খাবার একা একা খেয়ে ফেলা যায়, ইফতার একা একা করতে নিলে অন্তরজুড়ে হাহাকার তৈরি হয়। হাহাকারটা যে বেশ তীব্র, তা আজই প্রথম বুঝতে পারলাম যখন ইন্টার্ন ডক্টরস রুমে একা ইফতার করতে বসলাম। আজান দিতে আর একটুক্ষণ বাকি, শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোগী এসেছে; আমার সাথের ইন্টার্ন ভাইয়া গেছেন তাকে দেখতে। আমার একটা ডিসচার্জ পেপার লেখা শেষ হতে হতেই মুয়াজ্জিন সুললিত কণ্ঠে আজান দিয়ে দিলেন। হসপিটাল থেকে পলিথিনে করে ইফতার দিয়ে গিয়েছে, একটা বোতল ছিল, পানি নিলাম। কীসে খাব তা জানি না, অগত্যা পলিথিনের মধ্যেই খাচ্ছি। আমার আম্মু জানেন না, আমি পলিথিনে একা একা ছোলা মুড়ি খাচ্ছিলাম।
পেশেন্ট রিসিভ করে বিধ্বস্ত অবস্থায় অন্য ইন্টার্ন ভাইয়া এসে রোজা ভাঙলেন। তিনি ভাজাপোড়া খেতে পারেন না, একটা ছোট কেক আর বিস্কিট নিয়ে এসেছেন। আমরা ইফতার করছিলাম, ভাইয়া অর্ধেকটা কেক খেয়েছেন।
দরজায় নক, সদ্য ডায়াগনোসিস হওয়া একিউট লিউকেমিয়ার একটা পেশেন্ট ছিল ওয়ার্ডে, অবস্থা তেমন ভালো না। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটির মা আর আত্নীয় এসে বললেন, ডাক্তার, “এখনই একটু আসেন, আমাদের রোগীর অবস্থা খুব খারাপ।” আমাদের মেডিসিনের হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্ট বলেছিলেন, “সবসময় চিন্তা করবে তুমি যদি রোগী হয়ে ঐ মানুষটার কাছে যেতে তখন তুমি তার কাছে কী প্রত্যাশা করতে।” প্রত্যাশা করতাম, ডাক্তার সাহেব ইফতার ফেলে দৌড়ে আসেন। দুজনে ইফতার ফেলে ছুটলাম, দেখি আই এম ও আপু এদিকের শোরগোলে হাত না ধুয়েই বেরিয়ে গেছেন রুম থেকে। হসপিটাল থেকে বেরোবার সময় ভাইয়ার অর্ধেক কেক আর আমার মুড়ি ওভাবেই পড়ে ছিল। মনে মনে দু’আ করছিলাম মাগরিবের নামাজটা পড়ার যেন একটু সময় পাই।
এডাল্টস স্টিল ডিজিজ নিয়ে এক মেয়ে ভর্তি হয়েছে হাই ফিভার নিয়ে, অনেকটাই ডিজওরিয়েন্টেড, প্রেশার বেশ কম। কিচ্ছু খেতে পারে না, কয়েক ঘণ্টা ধরে রোগীর বিভিন্ন লোক চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার প্রতি সিএ’র নির্দেশনা ছিল আধাঘণ্টা পরপর ব্লাড প্রেশার দেখা। রোগীর লোক বলে, “স্যার আপনি থাকেন। তাহলে একটু খাবে।” ঐ লোকের কথা দেখলাম সত্যি। তার মা পাউরুটি একটুখানি করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে, আর আমি প্রতিবার বলছি, “একটু খাও আপু, না খেলে সুস্থ হবা না তো।” প্রথমবারের মতো সে একটু খেলো। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।
তাকে আরেকবার গিয়ে ফলো-আপ দিচ্ছিলাম, যে পেশেন্টকে ডিসচার্জ অন রিস্ক বণ্ড দিয়েছি, তার এক লোক বলছে, “ডাক্তার সাব, আমার লোকরে তাড়াতাড়ি নিচে নামানোর ব্যবস্থা করেন।” আমি কিছুটা হতাশ হলাম। হতাশা গোপন না করতে পেরে বলে ফেললাম, “তাকে নিচে নামানো তো আসলে ডাক্তারের কাজ না।” আরেকজন বলছে, “আমাদের রোগীর সাথে কি এখানের একজন এম্বুলেন্সে করে যাবে না?”
আমার বলার কিছুই ছিল না!
তিনি জানেন না, তার রোগীই আমাদের একমাত্র রোগী নন, আরও অনেকজন আছেন। তিনি জানেন না, আমাদের প্রতিদিন এই একই কাজ করতে হয়, কাল সকালে আবার ডিউটিতে আসতে হবে। তিনি জানেন না, ৫১২ নাম্বারে ১০২ সোডিয়াম নিয়ে ভর্তি মানুষটার অবস্থা কখন খারাপ হয়ে আই সি ইউতে পাঠানো লাগে সে চিন্তা মাথায় ঘোরে, ৪১০-এর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে সেখানে যেতে হবে সেই তাড়া থাকে, ৫১০- এর পেশেন্ট নিজে নিজেই টান দিয়ে স্যালাইন ব্যাগ খুলে ফেললে দুশ্চিন্তার বিষয়, ফিমেল ৫১২ -এর হিস্ট্রি কমপ্লিট করে লিখিনি সেটা টিচাররা দেখলে মনোক্ষুণ্ণ হবেন তা লিখতে হবে…
এশার নামাজের জামাত শুরু হয়ে গেছে, মিস না হয়ে যায় সেই উদ্বিগ্নতা কাজ করে!
ডা. মারুফ রায়হান খান
এনাম মেডিকেল কলেজ/ ২০১০-১১