দেখতে দেখতে আরেকটি ঈদ এসে গেল। সমান্তরালে এলো রসনাবিলাসের উপলক্ষ। বাঙালির বৈচিত্র্যময় রসনার মাঝে বাড়তি মাত্রা যোগ হয় এই ঈদে, ঈদ উল আযহায়। পশু কুরবানির সাথে সাথে রান্নার হাঁড়ি, খাবারের পাত হয়ে উদরপূর্তি হয় রেড মিট বা লাল মাংস দিয়ে। ঘরে ঘরে মাংস থাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে আহারের নানা পদে মাংসের আধিক্য থাকে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটি উপভোগ করার অবকাশ পায় দেশের অধিকাংশ মানুষ। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ এবং নিমন্ত্রণের এক সুযোগ তৈরি হয়। এখন সময় উপভোগের।
পরিবারের সবাই কি আসলে একইভাবে উপভোগ করতে পারেন? আত্মীয় পরিজন? বন্ধুরা সবাই?
হয়তো না। কেউ হয়তো অসুস্থ । কারো খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রিত। রেড মিট বা গরু খাসি ইত্যাদি মাংস খাওয়া বারণ। তেল চর্বির কিছু লোভনীয় পদ নিষিদ্ধ। নানা পদের মিষ্টান্ন ধরা ছোঁয়া যাবে না। কারো ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেসার, এজমা, গাউট, হৃদরোগ, হাইপার কোলেস্টেরলিমিয়া ইত্যাদি থাকতে পারে। কেউ হয়তো সদ্য হাসপাতাল ফেরত । এসব ভারি খাবার নিতে পারছেন না সহসাই। কেউ অতিরিক্ত ওজনধারী। সতর্কতা হিসেবে ভারি খাবার এড়িয়ে চলেন। তাহলে? এমন একটা উপলক্ষে সবাই মিলে খাওয়া আর জম্পেশ আড্ডা কিভাবে হবে? কিভাবে রক্ষা হবে কুটুমবাড়ির নিমন্ত্রণ ?
প্রয়োজন একটু সচেতনতা।
১. পরিবারের যিনি বা যারা অসুস্থ, ভারি খাবার(রেড মিট/মিষ্টি/তেল চর্বি) এড়িয়ে চলেন, তাঁদের আহারের প্রতি নজর দিন। তাঁদের পাতে থাকুক সেই খাবার যা তাঁদের জন্য প্রযোজ্য। মাছ বা মুরগী ইত্যাদি হতে পারে বিকল্প। শুধু শাক সবজি দিয়েই অনেক প্রকার স্বাস্থ্যকর ও মজাদার খাবার তৈরি সম্ভব।
২. রান্না হোক কম তেলে বা বিনা তেলে। পাতে নুন নিষেধ। কম নুনে রান্না হোক।
৩. কয়েক পদের ফল, শাকসবজি থাকুক যথেষ্ট পরিমাণে। সালাদ হোক অবারিত, সাথে রসুন, গাজর। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ লেবু, কাঁচা মরিচ স্বাদে আনুক বৈচিত্র্য। ফলের জুস, চিনি ছাড়া – বাড়তি মাত্রা যোগ করবে। এসবে আছে প্রচুর এন্টি অক্সিডেন্ট। বিপাক ক্রিয়ায় উৎপন্ন অক্সিডেন্ট কে প্রশমিত করে বিপদ থেকে রক্ষা করবে। টক দই ফিরে আসুক ঘরে ঘরে।
৪. মিষ্টান্ন ও মাংস থাকুক পরিমিত। থাকুক এদের বিকল্প। হঠাৎ অনেক মাংস (রেডমিট) খেলে তার সাথে যে পরিমাণ তেল চর্বি শরীরে প্রবেশ করে, তাতে হৃদরোগ প্রবণ ব্যক্তিদের অসুস্থ হবার ঝুঁকি থাকে। যাদের পরিবারে হৃদরোগ/ডায়াবেটিস/স্ট্রোকের ইতিহাস আছে অথবা বয়স চল্লিশোর্ধ্ব অথবা বাড়তি ওজনের, কায়িক পরিশ্রম কম করেন তাঁরা এই ঝুঁকিতে থাকেন। সুতরাং সতর্কতা আবশ্যক। যারা ইতিপূর্বে অসুস্থ হয়েছেন এসব যেকোনো একটা কারণে তাঁরা আহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবেন।
৫. নানান কাজের ব্যস্ততায় শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ দের প্রতি সময় মত খেয়াল রেখে খাবারের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে যায়। তাঁদের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি রাখুন। যেন চট জলদি খাবার পরিবেশন সম্ভব হয়।
৬. অতিথি কে দাওয়াত দেয়ার সময় বিনয়ের সাথে খাদ্যাভ্যাস বা অসুস্থতার কারণে নিষেধ এমন খাবারের খবর জেনে নিন। নয়তো দেখা যাবে খুব কষ্ট করে নানা পদের মিষ্টান্ন আয়োজন করেছেন আর অতিথি মুখ হাঁড়ি করে বসে আছেন। কিছুই মুখে নিতে পারছেন না, ডায়াবেটিস ! আপনার জানা না থাকায় উভয়েই বিব্রত। অথচ একটু জেনে নিলেই বিকল্প ব্যবস্থা করা যায়।
৭.যেকোনো ডিশ তৈরিতে বা পরিবেশনে সুষম খাবারের চর্চা করুন, যেকোনো উপলক্ষে, সবার জন্যে।
শর্করা ৫৫-৬০%, আমিষ ৩০-৪০%, তেল/চর্বি ৫-১০%। শাকসবজি ও ফলমূল প্রচুর। যথেষ্ট পরিমাণ পানি।
৮. দাওয়াত হোক বা নিজ ঘরে, পরিমিত আহার করুন। একটু খিদে অতৃপ্ত থাকতেই উঠে পড়ুন।
৯. নিরোগ শিশুদের জন্য ডায়েট কন্ট্রোল বা অন্য কোনো প্রকার বারণ নেই। মিষ্টান্ন, তেল চর্বি, কলিজা মগজ ইত্যাদি খেতে মানা নেই। বড়দের পাত থেকে এসব তুলে দিন ছোটদের পাতে।
ঈদের আনন্দে আবাহন হোক সবার। সবাই যেন যার যার মতো করে উপভোগ করতে পারেন সেজন্য কর্মক্ষম ব্যক্তিদের দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্বটুকু উপভোগ করুন। একটু নজর দিন আশেপাশে। সবার জন্য আনন্দের উপলক্ষ তৈরি করে বিস্ময়কর সময় উপভোগ করুন।
এ পৃথিবী আনন্দময়, যদি আমরা চাই।
লেখক: –
ডা. মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা