একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর চলার পথ কতোটা কণ্টকাকীর্ণ

বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০

 

মঈনুল ইসলাম
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হসপিটাল মেডিকেল কলেজ।
সেশন ২০১৭-১৮

 

যেদিন মেডিকেলে প্রথম এপ্রোণ জড়িয়ে ক্লাস করতে গেলাম, শীতকালের সকাল। হাঁড় কাপাঁনো শীতকে উপেক্ষা করে আমার মাঝে ভর করেছে প্রচন্ড উত্তেজনা। সাদা এপ্রোণটাকে সব থেকে পবিত্র কাপড় মনে হয়েছিলো আমার সেদিন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুকটা ফুলিয়ে আম্মুকে বলেছিলাম, “আম্মু দোয়া করে দেন, যাতে সারাটাজীবন মানুষের সেবা করে যাইতে পারি!”

আব্বু আম্মুর দোয়া নিয়ে শুরু করি আমার মেডিকেল জীবন।

তারপর আমার ক্লাস ভালোভাবেই শুরু হয়ে গেলো।একটানা সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। মাঝে একটা ব্রেক থাকে, মাত্র ৩০ মিনিটের। এই ৩০ মিনিটের মধ্যে ক্লাসের লেকচারেই চলে যায় আরো ১৫ মিনিট। বাকি ১৫ মিনিটে কোনমতে খাবার গোগ্রাসে গিলে আমরা আবার ক্লাসে ঢুকি।মেডিকেলের শুরুতে প্রচন্ড ভয়, ইংরেজিতে সবগুলো বই, আইটেমকে মনে হতো পৃথিবীর সবথেকে ভয়ংকর ব্যাপার। স্টার্নাম (বুকের মাঝের হাড্ডি) আইটেমের দিন সারাটারাত আমি ঘুমাইনি, ভয়ে শুধু কাঁপছিলাম, স্যারকে কালকে গিয়ে কি পড়া দিবো!

তারপর আসলো লাংস, হার্ট। প্রতিটা রাতে আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম। মনে হতো আমি আর পারছিনা।রাত ২টায় ঘুমিয়ে আবার সাড়ে চারটায় উঠে ঠান্ডা পানিটা চোখে লাগাতে যে আজাব আমার শরীরে নেমে আসতো, সেটা আমি একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়েই বলতে পারবো শুধু। আমার পাশের রুমে আমার বাপ নাক ডেকে ঘুমাতো। আমি এতো জোড়ে জোড়ে হার্টের রাইট করোনারী আর্টারী কোন দিক দিয়ে গিয়ে কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে, রাইট এট্রিয়ামে কি কি ফিচার পাওয়া যায় পড়ছিলাম।আমার পড়ার চিৎকারে মাঝে মাঝে আব্বার ঘুম ভেঙে যেতো।

আমার এখনো মনে আছে, সারাদিন ক্লাস করে, কোচিং করাতে যেতাম। এসে যখন নিজের পড়া পড়তে বসেছি, গভীর রাত, আমার বায়োকেমিস্ট্রির প্র‍্যাক্টিক্যাল লিখে ফেলেছিলাম ঘুমের ঘোরে ফিজিওলজির খাতায়। এতোটাই পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম প্রেশারে। তারপর ঈদের আগে আমার জন্ডিস ধরা পড়লো। দীর্ঘ দুই মাস মেডিকেলে পিছিয়ে থেকে সব পড়া টেনেছিলাম। সবগুলো টার্ম আমার আনকম্পলিট ছিলো। স্যার ম্যামরা অনেক সাহায্য করার পরও খুব কষ্ট হচ্ছিলো পড়া টানতে।খুব দুঃখে একবার সেকেন্ড টার্মে কিছু পারিনি বলে বাথরুমে গিয়ে সে কি কান্না আমার!

ফার্স্ট প্রফের মতো বিভীষিকা সবার জীবনে কম আসবে। আমার বাবা-মা আমার থেকে অনেক দূরে, আমি পিছিয়ে আছি পড়া থেকে। এই সময়টায় রাতের ঘুম কখনোই কম্পলিট হতোনা আমার। নানান আজেবাজে দুঃস্বপ্ন দেখতাম। ফেইল করেছি, বকা খেয়েছি- মাথায় এগুলো ঘুরতো। আমি জানি, মানসিক ভাবে আমি সুস্থ থাকার প্রচন্ড চেষ্টা করে যাচ্ছি তখনো। প্রফ এলো তারপর, আমাদের প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট পরীক্ষার আগের রাতে কষ্টে, প্রেশারে চোখের পানি ফেলেছি। পুরোটা রাত একটা ফোটা না ঘুমিয়ে পরীক্ষার হলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে কারো কারো। এই হচ্ছে আমাদের প্রফেশনাল এক্সাম!

থার্ড ইয়ারে উঠে গেলাম ওয়ার্ডে। পুরো দুই ঘন্টা আপনি একটানা দাঁড়িয়ে থাকবেন বেডের পাশে, কথা বলবেন, প্রশ্ন করবেন রোগীকে। দুই ঘন্টার মাঝে কতোবার যে মনে হয়েছে গ্লুকোজ লেভেল কমে গেলো, ঘেমে যাচ্ছি খুব, কষ্ট হচ্ছে এতোক্ষন দাঁড়াতে। ওয়ার্ডের পরেই আইটেম, একদিকে ওয়ার্ড করছি আরেকদিকে পাগলের মতো পড়ে যাচ্ছি আইটেমের পড়া। শরীর কাঁপছে, না পারলে আজও আইটেমে!

বিকেল বেলায় আবার ইভেনিং ওয়ার্ড। খেয়ে না খেয়ে সবাই বসে থাকে, ওয়ার্ড হবে, তারপর বাসায় যাবে রাতে। সকালে পরে আসা ধবধবে সাদা এপ্রোনে ঘাম জমে যায়, দেখতে দেখতে আমাদের এপ্রোন চোখের পলকে ধূসর রূপ ধারণ করে।

এই সিনারিওটা শুধু আমার না, প্রতিবছর বাংলাদেশে ভর্তি হওয়া নয় হাজার মেডিকেল স্টুডেন্ট এর প্রতিদিনের গল্প। আমাদের গল্পগুলো এপ্রোণের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। আসলে আমরা চাপা দিয়ে রাখি! শুধুমাত্র আমাদের আশেপাশের মানুষগুলোকে সেবা দিবো বলে, তাদের উপকার করবো বলে! প্রতিটা ডাক্তার এভাবেই অসহ্য কষ্ট যন্ত্রনায় ভেতর দিয়ে তৈরি হয়, খুব কমই ফাকিবাজি করে এই পথটা পার হওয়া যায়।

এতো কষ্ট করে গড়ে ওঠা একটা ডাক্তার শপথ নেয় রোগীদের সেবায় নিজেকে বিলানোর। কিন্তু তাঁকেই মেরে ফেলা! সারাটাজীবন সেবা দিয়ে রোগীদের হাতে লাঞ্চিত হওয়াই কি একজন ডাক্তারের প্রাপ্য?মানুষের অকথ্য গালাগালে ভরা কমেন্টই কি আশা করে একটা ডাক্তার? তাকে খুন করে ফেলার নিউজে ‘খুব ভালো হয়েছে’ এমন কথা কি মানানসই? ‘কসাই’ শব্দটাই কি এই সাদা এপ্রোনে ঢাকা মানুষগুলো ডিজার্ভ করে?

প্রশ্ন রেখে গেলাম সাধারণ মানুষের কাছেই। কারো যদি তাও লিখাটা অযৌক্তিক মনে হয় তাহলে উপর থেকে আবার পড়ুন।

Sarif Sahriar

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

করোনায় মরে যাওয়াই যথেষ্ট নয়; তাই ডাক্তারদের পিটিয়েও মারছি

Thu Jun 18 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০ দেবব্রত মুখোপাধ্যায় সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক আমার ধারণা ছিলো, সরকারী চাকরি মানেই বেতনটা অন্তত ১ তারিখে নিশ্চিত। গত পরশু এক তরুন ডাক্তার বললেন, দুই মাস ধরে বেতন পান না। একেবারে লাজুক কণ্ঠে বললেন, সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। আমাদের বেশীরভাগ ডাক্তারের মাসিক আয় কতো […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo