ডা সুরেশ তুলসান।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।
টক’-শো তে তো কতো লোকে কত কথাই বলে।
ওষুধের স্যাম্পল নাকি ডাক্টাদেরকেই খেতে হবে।
তিনি এটা বলতেই পারেন।
কিছুদিন পুর্বে এক জন বুদ্ধিজীবী সাংঘাতিক একটা টক’শো তে এরকমই একটি মন্ত্যব্য করে ব্যাপক জনরোষ, সরি ডাক্তার রোষের শিকারে পরিনত হয়েছিলেন।
মন্তব্যটা ছিল অনেকটা এরকম, যদিও আমি নিজে চোখে / কানে Live দেখি নাই বা শুনি নাই, পরে জেনেছি। ” ডাক্তাররা কোন একটি ঔষধ কোন রোগী কে লেখার আগে সেই ঔষধ ওই ডাক্তার সাহেবকে নিজে খেয়ে ঔষধের গুনাগুন ও পার্শপ্রতিক্রিয়া গুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে।” একটু এদিক ওদিক হতে পারে ভাষার তারতম্যে।
তার এই মন্তব্যের ব্যাপক যৌক্তিক / অযৌক্তিক সমালোচনা হয়েছে। অনেকে তাকে ছাগোল, বুদ্ধিজীবী, পাগোল,উন্মাদ,বেকুব,জ্ঞানপাপী, সাংঘাতিক, হাবিজাবি অনেক কিছু গালমন্দ ও উপাধি দিয়েছন। ডাক্তার দের কেউ কেউ উনাকে চিনে রাখার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, উনি কোন ডাক্তারের চেম্বার এ ঢুকলেই যেন বের করে দেয়া হয়। চিকিৎসা দেয়া না হয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি অনেক কথা।
ঔষধের স্যাম্পল বলে একটা বিষয় আমাদের ঔষধ শিল্পের উৎপাদন ও বিপনন ব্যাবস্থায় বৈধভাবে স্থান করে আছে অনেক দিন ধরে।
আমার জানা ভুল হতে পারে, যতদুর জানি এই স্যাম্পল এর ওষুধ বিনা ট্যাক্স এ বাজারে আসে, অর্থাৎ টাক্স ফ্রি।
স্যাম্পল এর ঔষধ ডাক্তারদের মাঝে বিলি করার জন্য প্রায় সকল ঔষধ কোম্পানিরই একটি করে ভালো বেতন-ভাতা ভুক্ত দক্ষ্ ও উচ্চশিক্ষিত M P O বাহিনী আছে যাদেরকে স্থানীয় ভাষায় রিপ্রেজেন্টিটিভ বলা হয়।
এখন প্রশ্ন
———————
ডাক্তার সাহেব যদি এই স্যাম্পল না খাবেন তাহলে এই স্যাম্পল দিয়ে কি করবেন ? কেইবা খাবে ?
(১) প্রথম উত্তর রোগীকে খাওয়ায়ে দেখবেন ঔষধের গুণাগুণ ঠিক আছে কিনা, পার্শপ্রতিক্রিয়া কেমন?
আজকের দিনে বিশ্বের কোথাও এই সুযোগ নেই। কারন এই আধুনিক বিজ্ঞান এর যুগে যে কোন একটি ঔষধ কে বাজারজাত করার পুর্বে ল্যাবরেটরিতে, প্রানীদেহে এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মানবদেহেও বিভিন্ন রকম পরীক্ষানিরীক্ষা, Clinical Trial এর পর বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক ঔষধের গুণাগুণ, কার্য্যকারিতা,ও নিরাপদ কিনা সে বিষয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে বাজারজাত করতে হয়।
আর সাধারনত কোন একটি ঔষধের এক সেট স্যাম্পল এ এত পর্যাপ্ত পরিমান ঔষধ থাকে না যা দিয়ে কোন একটি নির্দিষ্ট ঔষধ একজন রোগীর কোন একটি নির্দিষ্ট রোগের উপর পরীক্ষা করা যায়।
একটা বিশেষ রোগের শ্রেণীভুক্ত রোগীর উপর পরীক্ষা তো অনেক পরের কথা।
প্রচলিত আইনে স্যাম্পল ঔষধ বাজারে বিক্রয় নিষেধ। ধরা পড়লে শাস্তি, জরিমানা।
(২) তাহলে দ্বিতীয় উত্তর, ওই ঔষধ ডাক্তারকে নিজেকেই খেয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, হোক না তা যত কঠিন রোগেরই ঔষধ। সে ওষুধের পার্শপ্রতিক্রিয়া যত কঠিনই হোক না কেন তা ডাক্তার সাহেবকেই খেয়ে দেখতে হবে।
তা না করা হলে বাংলা দেশের ঔষধ শিল্পের উৎপাদন ও বিপনন ব্যাবস্থা থেকে স্যাম্পল নামক এই ব্যবস্থাটি চিরতরে বিলুপ্ত করতে হবে। যদি তা না করা হয়, তা না হলে আমি টক’শোর ওই সাংঘাতিকের সাহেবের পক্ষে।
ঔষধ স্যাম্পলের কিছু ক্ষতিকর দিক।
—————————————-
১. যেহেতু ট্যাক্স ফ্রি অথচ শেষমেশ বাজারেই বিক্রি হয়, সরকার কিছু রাজস্ব হারায়।
২. স্যাম্পলের নামে কারখানার বাইরে এনে ট্যক্স ফাঁকি দিয়ে বিক্রির একটা সুযোগ থেকেই যায়।
৩. স্যাম্পল গুলো অনেক সময় পড়ে থেকে নষ্ট হয়, সুতরাং অপচয়।
৪. প্রায়শই স্যাম্পল সমুহ কাটা কাটা স্টিপে থাকে বিধায় মেয়াদ উত্তির্ন হলেও বোঝা যায় না। অনেক সময় বস্তা ভরতে যে সময় লাগে সেই সময়ে অনেক স্যাম্পল ঔষধেরই মেয়াদ থাকে না। অথচ অজান্তে বা জ্ঞানত বাজারে বিক্রি হয়ে যায়।
৫. অনেকে হয়তো মনে করে থাকবেন যে ডাক্তারেরা ঔষধের স্যাম্পল পেয়ে থাকেন বিধায় ডাক্তারদের নিজের এবং পারিবারিক প্রয়োজনে ঔষধ কেনা লাগে লাগে না।
বিষয়টি মোটেও ঠিক না। স্যাম্পল হিসাবে প্রাপ্ত ঔষধ কখনোই ডাক্তারদের নিজের বা পারিবারিক প্রয়োজনে তেমন কোন কাজে আসে না এবং এই স্যাম্পল হিসাবে প্রাপ্ত ঔষধের জন্য ডাক্তাদের অনেক সময় বিরম্বনায় পড়তে হয়।
কারণ যে মুহুর্তে যে ঔষধ প্রয়োজন সেটা সেই মুহূর্তে খুজে পাওয়া যায় না বা স্যাম্পলের বস্তা ঘেঁটে খুজে পাওয়া দুষ্কর। আর খাকলেও পরিমানে পর্যাপ্ত হয় না যা দিয়ে কাজ চলতে পারে। সুতরাং আল্টিমেটলি ঔষধ কেনাই লাগে। আর বিরম্বনা একারণে যে, স্যাম্পল হিসাবে প্রাপ্ত মনে করে অনেক সময় কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ডাক্তারের নিজেও খাওয়ার জন্য কেনা ঔষধেও ভাগ বসান, যেনো তোমরা তো এমনি এমনিতেই পাও।
৬. সামান্য স্যাম্পল বিলির জন্য এত বড় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যবহার অপচয় এবং লজ্জাকর।
৭. বর্তমান বাজারে বেশ কিছু ভালো ভালো ঔষধ কোম্পানি আছে যাদের মার্কেট পলিসি তে স্যাম্পল নামক কোন বিষয় নেই।
৮. আবার এমন ডাক্তারের সংখ্যাও অনেক যারা স্যাম্পল নিতে অস্বীকার করেন।
৯. স্যাম্পল ঔষধ প্রস্তুত, প্যাকিং, বিলি- বন্টন ইত্যাদির খরচ ও অপচয়ের বোঝার প্রভাব পড়ে ঔষধের দামের উপর। দাম বাড়ে।
সুতরাং, সময় এসেছে আইন করে ঔষধের স্যাম্পল বিলি নিশিদ্ধ করার।
অনেকে আমার এই লেখা পড়ে ঔষধ কোম্পানি আর ডাক্তারদের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার রকম সম্পর্ক, লেনদেন, উপঢৌকন, বিদেশ ভ্রমণ, ইত্যাদি নিয়ে নানা কথা বলবেন। তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য এই যে, সব কিছু আমরা ঠিক করতে পারবো না। তবে স্যাম্পল নামক এই দুষ্ট প্রথা যদি আমরা দূর করতে পারি সেটাই বা কম কি ?
আমার বিশ্বাস বর্ত্তমান সময়ে অধিকাংশ ডাক্তারই স্যাম্পল প্রথার বিপক্ষে। Unfortunately আমিই হয়ত প্রথম মুখ খুললাম।