প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার
ডা. কাওসার উদ্দিন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
কে- ৬৫ ব্যাচ
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একটি করোনা ডেডিকেটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। তার মানে কি সেখানে করোনা রোগী ছাড়া আর কোন রোগী ভর্তি হবে না? তাহলে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক যারা আছেন, তারা সেখানে শিখবে কি? তারা কি শুধু করোনা চিকিৎসাই জানবে? যার সাপোর্টিভ ম্যানেজমেন্ট ছাড়া অন্য কিছু নেই! তরুণ চিকিৎসকরা বাকি রোগীদের ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে আজ যদি হাতে কলমে না শিখে যায়, তবে তাদের ভবিষ্যৎ কি?
হ্যাঁ, এমনটাই ঘটছে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর এ কারণে সেখানে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা আছেন কর্মবিরতিতে। কিন্তু কেন এমনটা ঘটবে? সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ। নাম শুনলেই মাথায় যে শব্দটি প্রথমে আসে, সেটি দুর্নীতি। যদিও কোন এক সময়ের বড় কোন মন্ত্রীর অধীনে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল। তবুও এটি নিয়ে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে ও হচ্ছে তা সীমাহীন। প্রকল্প বরাদ্দ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ের ওষুধ, যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় এ হাসপাতালের রয়েছে লাগামহীন দুর্নীতির ইতিহাস। যা এখনো দুদকে তদন্তাধীন এবং যার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ের পত্রিকার নিউজ। প্রতিষ্ঠার এত বছরেও চালু হয়নি ইমার্জেন্সি নাই এটি চালুর যথেষ্ট জনবল। বাংলাদেশে দিনদিন যেমন বাড়ছে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ, তেমনি হচ্ছে জেলায় জেলায় সরকারি মেডিকেল। এতে সেখানের রোগীদেরই লাভ। কিন্তু মানের উন্নয়ন না ঘটিয়ে এমন ভগ্নগ্রস্ত কার্যক্রমের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল বাড়িয়ে আমরা যে ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যসেবাকেই নষ্ট করছি, সে চিন্তা অনেকের নেই। বরং সংখ্যা বাড়ানোতেই সফলতা, এমন ভুল চিন্তা ও ভুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি মেডিকেল অনুমোদনে লাভ, সিট বাড়ালে লাভ, মান যাই হোক। সরকারিতেও লাভ, প্রজেক্ট ডিরেক্টরদের লাভ, বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয়ে লাভ, সংশিষ্ট মন্ত্রী এমপিদের লাভ। কিন্তু এর মান দেখভালের যেন কেউ নেই! যাই হোক এ আলাপ বাদ দেই। এখন কথা হল, ওখানে যারা বর্তমান ব্যবস্থাপনায় আছেন, সেই শ্রদ্ধেয় স্যাররা তাদের সন্তানতুল্য নব্য চিকিৎসকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে মোটেও কি চিন্তিত? যদি চিন্তিত হন, তবে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেন!
করোনা ডেডিকেটেড আলাদা অংশ থাকবে। নিতান্ত প্রয়োজনে রোস্টার করে তাদের সেখানে কিছুদিনের জন্য ডিউটিতে পাঠানো যায়, আর বাকি সময় জেনারেল ওয়ার্ডগুলোতে নিয়মানুযায়ী কাজ করবে। এতে সামাল দেয়া যাবে দু’দিকের রোগীই, আর হাসপাতালে করোনা রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীরাও পাবে যথোপযুক্ত সেবা। অন্যথায় বাইরের মানহীন ক্লিনিকগুলোতেই সেবা নিতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। যেসব ক্লিনিকের অধিকাংশেরই মালিক স্থানীয় আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা। এমনকি তাদের সাথে জড়িত হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকও। তাই কথিত আছে, উভয় পক্ষের অনেকে অতটা উৎসাহিত না হাসপাতালে ইমার্জেন্সি চালু করার ব্যাপারে, কারণ এতে তাদের ক্লিনিক ব্যবসায় ভাটা পড়তে পারে!অনেক ভুক্তভোগী ইন্টার্ন চিকিৎসক বিষয়টি আমাদের জানাচ্ছেন। আমরা আমাদের কথাগুলো বলছি, কিন্তু বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব সেখানকার কর্তৃপক্ষের। আশা করি তারা সেটি দ্রুতই করবেন।
ইন্টার্নরাও যে দোষের উর্ধ্বে সেটা বলছি না। শুরুতেই যখন এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে কথাবার্তা হল, তখন ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অনেকেই এ ব্যাপারে কোন কথা বলেনি। চিন্তা করেনি তাদের এই ভবিষ্যৎ সমস্যাগুলো সম্পর্কে। তখন হয়তো তাদের চিন্তা ছিল শীঘ্রই করোনা শেষ হবে, বা অনেকের এমন চিন্তাও থাকতে পারে যে, করোনা ডেডিকেটেড হলে ডিউটির চাপ কম থাকবে। আর এ কারণে শুরুতে এমনটাও হয়েছে, অনেকেই করোনা ডেডিকেটেড অংশেও ডিউটি না করে বাড়িতে চলে গিয়েছিলো। পরে তাদের চিঠি দিয়ে আনা হয়েছে, বা কোন ডিউটি না করেই লগবুকে সাইন নেয়ার জন্য গিয়েছে। তাই কিছু ভুল হয়তো তাদেরও ছিল! অন্যদিকে, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালকে পুরোপুরি করোনা ডেডিকেটেড করার ব্যাপারেই তাদের সামগ্রিক আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আর এর পিছনে কারণ থাকতে পারে ডেডিকেটেড হলে বেসরকারি বরাদ্দ বেশি প্রাপ্তির সম্ভাবনা এবং ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বর্তমান সমস্যাগুলো সম্পর্কেও তারা ছিলেন উদাসীন। হয়তো কর্তৃপক্ষের চিন্তা ছিলো ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সদর হাসপাতালে নির্দিষ্ট সময়ের সংযুক্তিই তাদের শেখার জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু সদর হাসপাতালে তো যথেষ্ট মিডলেভেল নাই। সেখানে তাদের শিখাবে কে? অর্থাৎ সব মিলিয়ে একটি হযবরল অবস্থা।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ হয়তো অন্য অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলমান সিস্টেম ফলো করতে পারে। এই যেমন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কথাই ধরি। সেখানে কর্তৃপক্ষের কার্যকর সিদ্ধান্ত ও সকল পর্যায়ের চিকিৎসকদের সার্বিক সহযোগিতায় করোনা রোগী, সাসপেক্টেড করোনা রোগী, জেনারেল ওয়ার্ড সবই পৃথকভাবে সুন্দর চলছে এবং সেবা পাচ্ছে সবাই। ট্রায়েজ, অবজারভেশন মেইনটেইন করে সাসপেক্টেড রোগীদের আলাদা করা হচ্ছে। নেগেটিভ হলে জেনারেল ওয়ার্ডে চলে যাচ্ছে। ইন্টার্নরা আলাদাভাবে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও অন্যান্য ব্রাঞ্চগুলোতে কাজ করছেন। সর্বোচ্চ সেবাদানের পাশাপাশি তারা শিখছেন হাতে কলমে। মিডলেভেল চিকিৎসকরা জেনারেল ওয়ার্ডের পাশাপাশি করোনা ওয়ার্ডের সার্বিক দেখভাল করছেন। সিনিয়র স্যাররা কোভিড ও নন-কোভিড উভয় ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট রোস্টার ভিত্তিক দেখশুনা করছেন। এতে একদিকে যেমন সার্বিক সেবা পাচ্ছে করোনা রোগীরা, তেমনি অব্যাহত সেবা পাছে অন্য সব বিভাগের রোগীরা। যতটুকু জানি অন্য অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই একই নিয়মে চলছে। যাই হোক, যে বিষয়টি বলার জন্য এত কিছুর অবতারণা সেই সমস্যার সমাধান হোক। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকবৃন্দের দাবিগুলো মেনে নিয়ে সেসব সমাধানকল্পে অতিদ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। নিশ্চিত করা হোক করোনাসহ সেখানে অন্য সব রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। আর অতি সম্প্রতি যেহেতু এটি ৫০০ বেডে উন্নিত হয়েছে, তাই সেভাবেই জনবল নিশ্চিত করে ইমার্জেন্সি চালু করা হোক। ইন্টার্ন চিকিৎসক, শিক্ষকবৃন্দ, কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ সবাই তাদের ব্যক্তিগত লাভ বা গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক ঘূর্ণি থেকে বের হয়ে বর্তমান সমস্যা নিরসনে একতাবদ্ধ হয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হবেন সেই কামনা করছি।
নিজস্ব প্রতিবেদক/ নুসরাত ইমরোজ হৃদিতা