প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ৯ মে ২০২০, শনিবার
Dr. Sheik Aleemuzzaman
Visiting Professor at tohto College of health science, Japan
দেশে দেশে গৃহবন্দী জীবন, অতিষ্ঠ মানুষ মুক্তির দিন গুনছে, কিন্তু সেই সুদিন কবে আসবে কেউ জানে না। মুক্তির প্রথম ধাপ লকডাউন প্রত্যাহার, সেখানেও দেশ-কাল ভেদে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। জাপানে লকডাউন নেই, তবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ আশাংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৬ এপ্রিল দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। জরুরী অবস্থা মানে গৃহবন্দী জীবন, সীমিত লকডাউন। ঘোষণার পর নতুন কেস, ১৭ এপ্রিল ৭০০ থেকে ১ মে ২৭৪ এ কমে আসে। তবে জাপানে করোনা সংক্রমণের হ্রাস-বৃদ্ধিতে মালভূমি নয়, একটি চলমান ঢেউ এর প্যাটার্ণ দেখা যায়। অর্থাৎ সরকার নিয়ন্ত্রণ শক্ত করলে কেস কমে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ শিথিল করলে কেস বেড়ে যায়। তাই কেস কমে গেলেও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার পরিবর্তে ৪ মে প্রধানমন্ত্রী আবে জরুরী অবস্থা ৩১ মে পর্যন্ত বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণার পরের দিন, জাপানের ওসাকা প্রিফেকচার (দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল) জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের একটি আংকিক গাইড লাইন প্রস্তাব করেছে। দেশে দেশে জরুরী অবস্থা কিংবা লকডাউন নিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, দোর গোড়ায় কড়া নাড়ছে দুর্ভিক্ষ। খাদ্য নাকি স্বাস্থ্য, কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে, ওসাকা গভর্ণর য়োশিমুরা ঘোষিত আংকিক গাইড লাইনটি মনে হয় যৌক্তিক ।
জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের ওসাকা গাইড লাইনে তিনটি টার্গেট আছে।
১) করোনাভাইরাস শনাক্ত করার জন্য প্রতিদিন সংগৃহীত নমুনার ৭% এর কম পজিটিভ হতে হবে।
২) কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী কি ভাবে কার মাধ্যমে সংক্রমিত হলেন তা অজানা রোগীর সংখ্যা ১০ জনের কম হতে হবে।
৩) করোনা রোগীদের জন্য হাসাপাতালে সংরক্ষিত বেডগুলির ৪০% বা তার অধিক খালি থাকতে হবে। যদি এই তিনটি টার্গেট ক্রমাগত সাতদিন অর্জিত হয়, সেক্ষেত্রে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এই টার্গেটগুলো নির্ধারণ করার রোগতাত্ত্বিক হিসাবটি বেশ জটিল হলেও কিছু কথা বলে রাখা দরকার।
একটি সংক্রামক রোগ কতটা ছোঁয়াচে তা নির্ধারণ করার জন্য প্রথমে জানতে হয় তার R0 (Basic reproduction number) এবং Re (effective reproduction number)। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে R0 (আর নট) ২ থেকে ৩ যার অর্থ এই রোগ প্রথমে সংক্রমিত হওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে ২ থেকে ৩ জনের কাছে ছড়িয়ে পড়ার মতো ছোঁয়াচে। ‘আর নট’ হার্ড ইমিউনিটি অনুমান করার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। Re হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময় পার হবার পর কোভিড-১৯ এর ছোঁয়াচে হবার ক্ষমতা কতোটা বেড়েছে বা কমেছে তার পরিমাপ। এই R0 বা Re পরিমাপের কয়েকটি পদ্ধতি আছে, যার জন্য অনেক তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন পড়ে। কোভিড-১৯ এর কয়েকটি প্রধান রোগতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রতিদিন জনগণকে জানাচ্ছে। তবে অন্যান্য অনেক তথ্য বিশেষজ্ঞরা নানা প্রয়োজন কিংবা গবেষণার জন্য ব্যবহার করছেন।
জাপানের চিবা বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি কোভিড-১৯ এর Re অনুমান করা বিষয়ক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে, যেখানে পৃথিবীর ৪০ টি দেশের দৈনিক পজিটিভ নমুনার সাথে মৃতের সংখ্যার একটা যোগসূত্র তুলে ধরা হয়েছে। যে সব দেশে দৈনিক পজিটিভ নমুনা ৭% এর কম সে সব দেশে মৃতের সংখ্যাও কম। কিন্তু যে সব দেশে দৈনিক পজিটিভ নমুনা ৭% এর বেশী, সে সব দেশে মৃতের সংখ্যা আনুপাতিক হারের চেয়েও অনেক বেশী। মৃতের সংখ্যা অনেক বেশী হওয়ার অন্য অর্থ, করোনা রোগীদের জন্য হাসাপাতালে সংরক্ষিত বেড এর স্বল্পতা, যেটা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় একটি বৈশ্বিক সমস্যা। জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের ওসাকা গাইড লাইনে চিবা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরোক্ত গবষণার ফলাফল প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলাদেশে রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ মোকাবিলায় একছত্র ভূমিকা পালন করলেও সম্প্রতি সে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে গত ২৬শে মার্চ থেকে (অঘোষিত) লকডাউন চলছে। ঐ তারিখে সংগৃহীত নমুনার ৪ % পজিটিভ ছিল এবং কেউ মারা যায় নি। সম্প্রতি ১৬ মে পর্যন্ত সরকারি ছুটির সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং সীমিত পর্যায়ে ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেয়া হচ্ছে। এই পটভূমিতে ৭ মে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিন সূত্রে জানা যায়, সংগৃহীত নমুনার ১২ % পজিটিভ, তবে মৃতের সংখ্যা তারা তাৎক্ষনিক বলতে পারেন নি। পরে প্রেস রিলিজে জানানো হয় ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এর পাশাপাশি সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত ৬০২ জন চিকিৎসক। রোগতত্ত্বের কোন হিসাবে বাংলাদেশে লকডাউন ঘোষিত হলো আর এখন শিথিল করা হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। বরং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ওসাকা গাইড লাইনের তিন টার্গেটের প্রায়োগিক দিক নিয়ে নীতি নির্ধারকরা আলোচনায় বসলে, বর্তমান সংকট উত্তরণ সহজ হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলভিয়া মীম