শনিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২০
করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণে সারাবিশ্ব আজ বিপর্যস্ত, উন্নত থেকে দরিদ্র দেশ, রাজা থেকে প্রজা কেউ রেহাই পাচ্ছে না। করোনা ভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, অতিক্ষুদ্র এই অনুজীবের কাছে আমাদের উন্নত রাষ্ট্রগুলো আজ ধরাশায়ী। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হচ্ছে, এই রোগের এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত ও যথাযথ ভাবে কার্যকর কোন ঔষধ বা টিকা নেই পৃথিবীতে। অনেক দেশ ও প্রতিষ্ঠান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কত দ্রুত এই অনুজীবকে প্রতিহত করার বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত ও কার্যকর প্রতিষেধক বাজারে আনা যায়।
এই চরম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা সবাই কোভিড-১৯ প্রতিরোধে অপেক্ষায় আছি সেই কাঙ্ক্ষিত প্রতিষেধকের, কত দিনে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ পাবে সেই ঔষধ বা টিকা? আসুন, মেডিসিন শাস্ত্রের একজন ছাত্র হিসাবে আপনাদের সামনে আলোচনা করি কোভিড-১৯ রোগের ঔষধ বা টিকা আমাদের কাছে আসার প্রক্রিয়া ও তার সম্ভবনা নিয়ে।
চিকিৎসা পদ্ধতি সমূহঃ
প্রতিটি রোগের চিকিৎসা প্রধানত তিন ভাবে হয়।
১) উপশমক (Palliative), যার মাধ্যমে রোগের উপসর্গগুলো উপশম বা লাঘব করা হয়।
২) রোগ নিরাময়ক (Curative), যার মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীর রোগ নিরাময় হয়।
৩) প্রতিষেধক বা টিকা (Preventative), যার মাধ্যমে সুস্থ মানবদেহে রোগ যাতে না হয় সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরী করা।
রোগের চিকিৎসার জন্য উপরে উল্লেখিত যেকোন পদ্ধতি ব্যবহার করার আগে নিশ্চিত হতে হবে যে পদ্ধতিটি মানবদেহের জন্য নিরাপদ কিনা, আর নিরাপদ নিশ্চিত হলেই কেবল মাত্র ব্যবহারের অনুমতি মেলে বিভিন্ন দেশের অনুমোদনকারী সংস্থা থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ঔষধের ব্যবহার নিশ্চিত করা দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উপরে আছে আমেরিকা এবং তাদের ওষুধের মাননিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা এফডিএ (US-FDA) পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংস্থা যাদের মান নিয়ে পৃথিবীর কোন দেশের সংশয় না রাখাটাই ভাল। পৃথিবীর যত চিকিৎসা পদ্ধতি আছে তার বেশীর ভাগই তাদের দ্বারা অনুমোদন প্রাপ্ত হয়েছে, এবং পরবর্তীতে তা ব্যবহারকারী দেশের অনুমোদন সাপেক্ষে বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-19) পৃথিবীর তাবৎ উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুলে দেখিয়ে তার রাজত্ব করছে। এই মুহূর্তে কোন বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ও নিরাপদ ঔষধ বা টিকা না থাকায় বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দ্রুত এই রোগ প্রতিরোধে।
১) উপশমক পদ্ধতি
চিকিৎসকরা উপশমক পদ্ধতিতে ওষুধ ব্যবহার করছে কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ বা লক্ষণগুলো উপশম করার উদ্দেশ্যে। এটি মূলত উপসর্গ বা লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন, জ্বর হলে প্যারাসিটামল, ঠান্ডা হলে অ্যান্টি-হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে। যা হয়তো সাময়িকভাবে উপসর্গ বা লক্ষণগুলো নিবৃত্ত করবে কিন্তু এটি ভাইরাসকে ধ্বংস করে রোগমুক্তির চূড়ান্ত কোন চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। কোভিড-১৯ রোগ চিকিৎসায় এই পদ্ধতির গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম তাই এই পদ্ধতি নিয়ে তেমন গবেষণা নেই বললেই চলে।
২) রোগ নিরাময়ক পদ্ধতিঃ
করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-19) দ্বারা সৃষ্ট রোগ একেবারেই নতুন হওয়ায় বিজ্ঞানীদের কাছে এটির নিরাময়ে সুনির্দিষ্ট কোন ঔষধ না থাকায় তারা চেষ্টা করছে দ্রুত কার্যকর ঔষধ আবিষ্কার করার। তারা নতুন ওষুধের পাশাপাশি অন্য রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ নিয়ে পরিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে কার্যকর ও নিরাপদ ঔষধের খোঁজে। এই রোগ নিরাময়ে এখন পর্যন্ত দুইশটির অধিক ঔষুধ নিয়ে বিভিন্ন দেশে পরীক্ষা চলছে। এফডিএ ইতিমধ্যে এমন কিছু ওষুধের মানব শরীরে পরীক্ষার জন্য অনুমোদন দিয়েছে এবং গবেষণামূলক ওষুধ (Investigational Drug) হিসেবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে, যা শুধু কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত মূমূর্ষ রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য সব রোগীর জন্য নয়। কয়েক মাসের মধ্যে এই ওষুধগুলোর কার্যকারিতা ও নিরাপদ কিনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যাবে। যেমন-
ক) হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন বা ক্লোরোকুইন, এটি মূলত ম্যালেরিয়া, লুপাস ও বাতজ্বর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এটি কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় কার্যকারিতা ইত্যিমধ্যে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে প্রমানিত হলেও, কার্যকর এবং নিরাপদ ব্যবহারের জন্য এফডিএ মানব শরীরে এর নিরাপদ ব্যবহার ও কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশের অল্প কিছু ওষুধপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এটি তৈরী করে ফলে কোভিড-১৯ রোগ চিকিৎসায় পরীক্ষা করার জন্য গবেষণামূলক ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। তার অর্থ এটি শুধু অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকারিতা পরীক্ষার উদ্দেশ্যে মানব শরীরে প্রয়োগ করা যাবে, কিন্তু পরীক্ষা শেষে কার্যকরিতা ও নিরাপদ প্রমান সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন (Final approval) নিয়ে নিরাপদ ও কার্যকর বহুল ব্যবহারের জন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
খ) ফ্যাভিপিরাভির, এটি মূলত জাপানে আবিষ্কৃত অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ যা জ্বর, সর্দিকাশির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি চীনে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় কার্যকর বলে প্রমানিত হলেও মানব দেহে কার্যকর ও নিরাপদ কিনা পরীক্ষা জন্য গবেষণা ওষুধ হিসাবে আক্রান্ত রোগীকে ব্যবহারের অনুমোদন পেয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করলেও প্রমান সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন (Final approval) নিয়ে নিরাপদ ও কার্যকর বহুল ব্যবহারের জন্য এটির আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের অল্পকিছু প্রতিষ্ঠান এটি গবেষণামূলক ওষুধ হিসেবে বাংলাদেশে ব্যবহারের অনুমোদন পেলেও নিরাপদ ও কার্যকর ঔষধের অনুমোদনে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক মাস।
গ) রেমডেসিভির, এটি মূলক কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ যা ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে বলে আবিষ্কৃত হলেও এটি কার্যকারীতা প্রমানে ব্যর্থ হলেও এফডিএ গবেষণামূলক ওষুধ হিসাবে কোভিড-১৯ রোগী ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুমোদন পেয়ে মানবদেহে কার্যকারীতা প্রমানে জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হলেও অপেক্ষা আরও কয়েক মাসের। বাংলাদেশেও গবেষণামূলক ওষুধ হিসাবে এটির অনুমোদন পেলেও কার্যকারীতা প্রমান সাপেক্ষে বাজারে আসতে সময় লাগবে আরও কিছু দিন।
ঘ) ইআইডিডি-২৮০১, নতুন আবিষ্কৃত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ যার মানব দেহে কার্যকারিতা ও নিরাপদ কিনা পরীক্ষার জন্য এফডিএ গবেষণামূলক ওষুধ হিসাবে অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমান সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে এটির অন্যগুলোর চেয়ে বেশী সময় লাগবে। যেহেতু নতুন ওষুধ তাই বাংলাদেশের এটি প্রস্তুত হয় না।
এছাড়াও কয়েকটি সমন্বিত ওষুধের প্রয়োগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে যেমন, লোপিনাভির ও রিটোনাভির (দুটিই এইচআইভি রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়), সাইটোকাইন ইস্টোম (টোসিলিজুমাব ও ইন্টালিউকিন-৬), ইভারসেকটিন (পরজীবীনাশক ওষুধ) মানব শরীরে ব্যবহারের উপযোগী পরীক্ষায় ব্যবহার হচ্ছে। এখন এই ওষুধ গুলো মানব শরীরের মত জটিল যন্ত্রে নিরাপদ ও কার্যকর প্রমান করতে যেমন অনেক সময় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন, তেমন এটিও সত্যি হয়তো বেশি ভাগ কার্যকর হলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে মানব শরীরে ব্যবহারের উপযোগী নাও হতে পারে। তাই একটি কার্যকর রোগ নিরাময়ক ওষুধের জন্য আমাদের অপেক্ষা দীর্ঘতর হতে পারে।
৩) প্রতিষেধক বা টিকা পদ্ধতি
মানবদেহে রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি যার মাধ্যমে সুস্থ মানব শরীরের ভিতরে ভাইরাস প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরী করা। ফলে ভাইরাস শরীরের প্রবেশ করলেও প্রতিরোধী ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু অন্যসব পদ্ধতি থেকে এটি বেশি জটিল ও কঠিন। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কোন প্রতিষেধক বা টিকা এ মূহুর্তে পৃথিবীতে নেই, এমনকি বিজ্ঞানীদের কাছে কোন ধারণাও নেই। খুব দ্রুত এটির জিন সিক্যুয়েন্স আবিষ্কার হওয়ায় ইতিহাসের সবচেয়ে দ্রুততর সময়ে এটির প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কারের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীতে বিশটির অধিক টিকার আবিষ্কারের ঘোষণা এসেছে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে। এত্যিমধ্যে এর কয়েকটি মানবদেহে কার্যকারিতা ও নিরাপদ কিনা সেটির পরীক্ষার জন্য অনুমোদন পেয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। কিন্তু এটির নিরাপদ ও কার্যকারী ব্যবহারের পরীক্ষা অনেক জটিল ও কঠিন পদ্ধতি, তাই সংকটময় অবস্থা বিবেচনা করে দ্রুত সব প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে অনুমোদন পেতে ন্যূনতম আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের আগে কোনভাবেই সম্ভব নয়। যদি এটি আগামী বছর অনুমোদন পাই তাহলেও পৃথিবীর সবদেশে এটি কার্যকর নাও হতে পারে জেনেটিক মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তনের কারনে, ভাইরাস এরমধ্যে ৩৮০ বারের অধিক জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে এফডিএ ‘কনভ্যালসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ নামক অনেক প্রাচীন পদ্ধতির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে। এই পদ্ধতির কার্যকারিতা বা নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য। যে পদ্ধতির মাধ্যমে একজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী সুস্থ হওয়ার পর তার দেহ থেকে প্লাজমা পৃথক করে নতুন আক্রান্ত অন্য কোন রোগীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে। যেখানে রোগ থেকে সেরে ওঠা রোগীর দেহে ভাইরাস প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি রক্তরসের মাধ্যমে নতুন অক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে তার দেহে ভাইরাস প্রতিরোধে একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। কিন্তু রোগী ব্লাডগ্রুপ এরং রক্ত অ্যান্টিবডির পরিমাণসহ এই পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা ধরা পরেছে। এটির নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবহারের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ওষুধ বা টিকার বাজারজাত করণের প্রক্রিয়া
একটি নতুন প্রতিষেধ/টিকা অথবা ওষুধ পরীক্ষাগার থেকে সাধারণ জনগনের কাছে ব্যবহারের জন্য আসতে গড়ে ১২ বছর সময় এবং ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়। আপনার চোখ কি কপালে উঠল, তাহলে জেনে নিন গড়ে ১০০০ টি পরীক্ষাগারে তৈরী ওষুধ থেকে ১টি মাত্র ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে মানব দেহে ব্যবহারের অনুমোদন পাই এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ক্লিনিক্যাল তথ্যের ভিক্তিতে গড়ে মাত্র ১৪ শতাংশ ওষুধ সাধারনের ব্যবহারের জন্য বাজারজাত হয়। সাধারনত টিকা বা ওষুধের বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া খুবই জটিল, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ্। কোন নিদিষ্ট রোগের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে নতুন ওষুধ তৈরীর লক্ষ্যে পরীক্ষাগারে অনেক পরীক্ষা-নিরক্ষার পর ক্যামিকেলি কোন ওষুধের উপাদানের কার্যকারিতা প্রমানিত হলে প্রাণীদেহ এটির কার্যকারিতা প্রমাণের প্রয়োজন হয়, এই দুই প্রক্রিয়া শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। প্রাণীর দেহে কোন ওষুধ কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হলে সব তথ্য উপাত্তসহ মানব দেহে পরীক্ষামূলক ওষুধ হিসাবে ব্যবহারের অনুমোদনের আবেদন জমা দেওয়া হয় ওষুধ প্রশাসনের কাছে, তখন ওষুধ প্রশাসন সকল তথ্য উপাত্তসহ বিচার বিশ্লেষণ করে ঐ ওষুধকে মুমূর্ষু রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। এই পরীক্ষায় সবুজ সংকেত আসেই সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে পরীক্ষা করা হয় তখন থেকেই মূলত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়, যেটি তিনটি ধাপে সুস্থ মানব শরীরে ওষুধের কার্যকারিতা ও নিরাপদ কিনা প্রমাণ হয় কিন্তু এটি একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ্য প্রক্রিয়া যেখানে স্বেচ্ছাসেবী মানব দেহের প্রতিটি অঙ্গের প্রতি ওষুধের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা হয়।
এই তিনটি ধাপ পরীক্ষা করতে কয়েক হাজার সেচ্ছাসেবী মানুষ ও প্রায় ছয় বছর সময়ের প্রয়োজন হয় (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল-১: প্রায় এক বছর সময় এবং ২০-৮০ জন সেচ্ছাসেবী প্রয়োজন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল-২: প্রায় দুই বছর সময় এবং ১০০-৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবী প্রয়োজন এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল-৩: প্রায় তিন বছর সময় এবং ১০০০-৩০০০ জন সেচ্ছাসেবী প্রয়োজন)। এভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সফলতা সাপেক্ষে সকল তথ্য-উপাত্ত সহ চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ওষুধ প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে হয়। তখন ওষুধ প্রশাসনের রিভিউ কমিটি প্রায় আড়াই বছরের চুলছেড়া বিচার-বিশ্লেষণ শেষে চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করে ব্যবস্থাপত্রের মাধ্যমে সাধারণ রোগীদের ব্যবহারের।
তারপর শুরু হয় বাজারে আসার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চতুর্থ ধাপ তবে এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হয় ওষুধের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তবে খুব বেশি অসুবিধা না থাকলে এই প্রক্রিয়ায় ওষুধের সাধারন ব্যবহারের উপর কোন প্রভাব নেই। এছাড়াও ইতিপূর্বে অনুমোদিত ওষুধের জেনেরিক তৈরীর ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া একটু সহজ হলেও ৩-৪ বছর সময় লাগে।
কিন্তু মহামারীর মত পরিস্থিতিতে দ্রুত টিকা বা ওষুধের অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াটি অতিদ্রুত সম্পূর্ণ করা হয় সাধারন জনগনের জীবন রক্ষার্থে, যা দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত অনুমোদন এটি পেতেও ন্যূনতম ১৮ মাস সময় লাগবে।
কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কার্যকারী ওষুধ বা টিকার অপেক্ষা আর কত দিনের?
করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট এই অতিমারি পরিস্থিতিতে দ্রুত ওষুধ বাজারজাত করতে অনেকগুলো ওষুধ বা টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে, যদি পরীক্ষায় এগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়, তাহলে ওষুধগুলো বাজারে আসতে নূন্যতম ২-৩ মাস সময় নিবে আর টিকা গুলোর ক্ষেত্রে সময় লাগবে নূন্যতম ৯-১৫ মাস।
প্রতিষেধক বা টিকার জন্য বাংলাদেশের অপেক্ষা কত দিনের?
সমগ্রবিশ্বের মত বাংলাদেশের মানুষও আকাঙ্খা করছে কোভিড-১৯ রোগের কার্যকর ঔষধ বা টিকার জন্য। বাংলাদেশের ওষুধশিল্প সবচেয়ে দ্রুত বর্ধমান রপ্তানিখাত হলেও নতুন ওষুধ তৈরীর মত সক্ষমতা এখন পর্যন্ত আমাদের হয়নি। তাই করোনা ভাইরাস চিকিৎসার টিকা বা ওষুধের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে উন্নত দেশগুলোর দিকে। আবার যেকোন নতুন টিকা বা ওষুধের পেটেন্ট বা মেধাস্বতের কারণে আমরা ইচ্ছা করলেও বাজারজাত করতে পারব না বা পারলেও অপেক্ষা করতে হবে তাদের অনুকম্পার দিকে। কিছু প্রচলিত ওষুধ (যেমন হাইড্রোঅক্সিক্লোরোকুইন) যদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কার্যকর ও নিরাপদ প্রমানিত হয় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় তাহলে আমরা দ্রুত সেটি ব্যবহার করতে পারবো তবে অপেক্ষা করতে হবে আরও ন্যূনতম ২-৩ মাস।
অন্যদিকে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় কার্যকর টিকা আগামী বছর নাগাদ অনুমোদিত হলেও পেটেন্ট বা মেধাসত্ত্ব ও উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপক চাহিদার কারণে আমাদের অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে পারে, এমনকি এটি নিয়ে পৃথিবী সাক্ষী হতে পারে অরাজক পরিস্থিতির। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বের কিছু সেবাপ্রদানকারী সংস্থা এ ক্ষেত্রে যদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাহলেও সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য অপেক্ষা ন্যূনতম ১২-১৮ মাসের।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্রঃ
https://www.drugs.com/fda-approval-process.html
https://www.fda.gov/media/82381/download