প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ১৫ জুন, ২০২০, সোমবার
ডা. রায়হানুল আরেফীন
জেনারেল হাসপাতাল, নোয়াখালী
আজ হাসপাতালে সবার শেষ যে রোগীটা দেখলাম, তিনি এসেছেন সোনাইমুড়ীর এক গ্রাম থেকে। এক ইএনটি চিকিৎসক সরাসরি আমার কাছেই পাঠিয়েছেন। স্টাফরা সবাই ক্লিনিং, গোছগাছের প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় রোগীর ছেলে তাঁকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।
রাবেয়া খাতুন, বয়স ৪৫ বছর। সমস্যা- মুখে ক্ষত, জ্বালাপোড়া, খেতে অসুবিধা আর গলায় চাকা, ঢোক গিলতে কষ্ট হয়। অন্য কোন কো-মরবিডিটি নাই। পোশাক পরিচ্ছদ বেশ মলিন কিন্তু মুখে সুন্দর করে মাস্ক পরা, ছেলের মুখেও। দেখে খুব ভালো লাগলো।
বললাম, ক্ষত টা দেখাতে। ছেলে পকেট থেকে ছোট্ট একটা স্যানিটাইজারের বোতল বের করে প্রথম নিজের হাতে ভালোমতো লাগিয়ে নিল। এরপর খুব আস্তে করে মায়ের মুখের মাস্কটা সরালো। মাস্ক খোলার সময়ই রোগীর গলার দিকে আমার চোখ গেল; বড় সুপারির সাইজের একটা সাবম্যান্ডিবুলার লিম্ফ নোড। এরপর মুখ যখন হাঁ করলেন, দেখেই বুঝে গেলাম যা ভেবেছি, তা-ই।
দুষ্ট ক্ষত টা বাক্কাল মিউকোসাতে, সালকাস ধরে ফেলেছে; রাইট সাইডের লোয়ার ক্যানাইন থেকে একেবারে রেট্রোমোলার এরিয়া পর্যন্ত। ৬ মাসের হিস্ট্রি। পানের অভ্যাস ছিল, ছেড়ে দিয়েছেন ক্ষত দেখার পর থেকে। কবিরাজি, হোমিও, অনেক এন্টিবায়োটিক আর ভিটামিন খেয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ওই ইএনটি ডাক্তারের কাছে গেলে উনি এখানে পাঠিয়ে দেন।
নাথিং মোর নিডেড ফর এ প্রম্পট ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস। ম্যালিগন্যান্ট আলসার উইথ পসিবল নেক মেটাস্ট্যাসিস। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
রোগীর ছেলেকে বললাম উনাকে বাইরে বসিয়ে আবার আসতে। ছেলেটা এসে বসল। ফ্যামিলি হিস্ট্রি নিলাম। বাবা মারা গেছেন আরো ৫ বছর আগে, স্ট্রোক। ছেলের বয়স ২৪-২৫ মত, এক ছেলে। ২ বোনের একটাকে বিয়ে দিয়েছে, আরেকটা স্কুলে। নিজে গার্মেন্টসে চাকরি করে; সেটা দিয়েই সংসার চালায়। করোনার জন্য তিনমাস ধরে ফ্যাক্টরি বন্ধ। এখন বাড়িতে বসে আছে। এক কাঠ মিস্ত্রির জুগালি(সহকারী) হিসেবে কাজ করে মাঝে মাঝে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো, বাবা মারা যাওয়ায় আর পরীক্ষা দিতে পারেনি। খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল।
আস্তে আস্তে ছেলেকে তার মায়ের রোগ, পরীক্ষা নীরিক্ষা, দীর্ঘ চিকিৎসা পদ্ধতি বুঝিয়ে বললাম। ঢাকা ডেন্টাল কলেজ বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ যেটা সুবিধা হয় যেতে বললাম। কিন্তু এই মহামারী পরিস্থিতিতে এত বড় মানসিক, শারীরিক ও আর্থিক প্রস্তুতি, সাথে চিকিৎসার সিরিয়াল ও দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে কিভাবে ও একা এগুলা করবে বা আদৌ করতে পারবে কিনা তা ভেবে পাচ্ছিলাম না।
ছেলেটার চোখের দিকে তাকাতে গিয়েও অনেক কষ্টে আটকে রাখা পানিটুকু দেখে আর তাকাতে পারছিলাম না। তীব্র কষ্ট, অবিশ্বাস, অপারগতা, অনিশ্চয়তা ও আতংকের মিশেলে এক ভয়ংকর অনুভূতির দৃষ্টি। আমিও অসহায়ত্বের গ্লানি মাথায় নিয়ে রোগীকে ঢাকা ডেন্টালে রেফার করে টিকিটটা ওর হাতে দিয়ে বসে থাকলাম।
পাদটীকাঃ এটা জেলা উপজেলা পর্যায়ের প্রতিটা সরকারি হাসপাতালের প্রতিদিনের চিত্র। আমি স্বপ্ন দেখি খুব সহসা বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় সরকারি ব্যাবস্থাপনায় মুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। লক্ষ লক্ষ মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর পরিবারের মুখে আমরা হাসি ফিরিয়ে দিতে পারব। প্রায় কোন রোগীকেই আমাদের অসহায়ের মত ঢাকা, চট্টগ্রাম রেফার করে দিতে হবেনা।