করোনার দিনগুলি – ১৮ | “আমার বাপ নাই কিন্তু আমি জানলাম না”

প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২১ জুলাই, ২০২০, মঙ্গলবার

ডা. শাকিল সারওয়ার
ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসার, পিরোজপুর সদর হাসপাতাল এবং
ভেন্যু মেডিকেল অফিসার, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড

কাহিনীটির শুরু সেই মার্চ মাস থেকে। ১৯ই মার্চ  আমার ডিটেকটিভ ভাই (নিউইয়র্ক পুলিশে কর্মরত) জানাল সে করোনা পজিটিভ।

বাসায় বয়স্ক বাবা মা (তারা আতঙ্কে ১ মাস বাসার বাইরে যায় নাই)। ২২ তারিখে বাবার সাথে মাও আক্রান্ত হলেন। আমি সরকারী হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে রোগী দেখি আর অন্যের বাবা মায়ের সেবা করি। বউ বাচ্চা ঢাকায় আমার শাশুড়ির বাসায় আর আমি তিন তলা একটা বিশাল বাড়িতে একা থাকি আর ডিউটি করি।

বাবা চিরকাল চাপা স্বভাবের এবং সম্পূর্ণ নিরোগ একজন মানুষ। অন্যদিকে মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ। মা কে জিজ্ঞেস করলাম, “ইউ এস এ আসব?” মা বলল, “আসিস না, তুই ভাল থাক।” একটা বাসায় ৩ জন রোগী, কে কাকে সাহায্য করবে? ভয় মা কে নিয়ে বেশি। বাবা কে জিজ্ঞেস করি, “কেমন আছো?” বাবা বলে, “আমি ভাল আছি।” আমাজন থেকে ৬টা পোর্টেবল অক্সিজেন পাঠালাম। আব্বা লুকিয়ে লুকিয়ে টান দেয়, সামনে দেয় না যদি আমরা চিন্তা করি।

তারা ইউ এস এ এবং আমি বাংলাদেশে, দূরত্ব ১৩৬০০ মাইল। ডাক্তার ছেলে হিসেবে বাবা মা এর এই দুঃসময়ে পাশে নেই, কিছু করতে পারলাম না। 

মাঝে একদিন প্যারামেডিক আসল। ওরা চেক করে বলল, “ঠিক আছে সব, ফুসফুস ক্লিয়ার। তাকে হাসপাতালে নেবার দরকার নাই।” কিন্তু সবচেয়ে জরুরি যে জিনিস অক্সিজেন স্যাচুরেশন, সেটাই দেখল না। আমার এক জাতি ভাই বাংলাদেশি ছিল এই দলে। আমি তার সাথে ফোনে পরিচয় দিয়ে কথা বললাম। কিন্তু আমার বাবার কপাল খারাপ। ৬ই এপ্রিল আরেক দল আসল, দেখল অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাত্র ৩৭%। এল্মহাস্ট হাসপাতালে নিয়ে গেল ৮ই এপ্রিল। ঐদিন বাংলাদেশের সময় রাত ১১.৩০ মিনিটে আল্লাহ তাকে তার কাছে নিয়ে গেলেন।

আমি তখন হাসপাতালে অন্য কারো বাবা মা কে বাঁচাতে ব্যস্ত। নিজের বাবার জন্য কিছু করতে পারলাম না। আমার ভাই ফোন দিল, শুনলো আমি একা পুরো সরকারী হাসপাতালের দায়িত্বে, তাই কিছু বলল না। বলল, সকালে বাসায় ফিরে কল দিতে।

আমার বাপ নাই কিন্তু আমি জানলাম না। আমার ভাই বলল না, কারণ তাতে যদি আমি হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসি তবে রোগীদের ক্ষতি হবে। সকালে বাসায় আসলাম। ভাই ফোন দিয়ে বলল, “আমাকে মাফ করে দিস। তুই ডিউটিতে ছিলি তাই বলি নাই, বাবা আর নেই।” আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি, “কখন?” সে বলল, নিউইয়র্ক সময় দুপুর ১.৩০ মিনিটে। আমি কাঁদি নাই, শুধু বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল, “বাবা!” জামাকাপড় পড়লাম, মামার বাসায় গেলাম। পথে একজন জিজ্ঞেস করল, “বাবা কেমন আছে?” আমি বললাম, “ভাল আছে” (আসলে কথা বলার মত শক্তি ছিল না)। মামা কে বললাম, মামা কাঁদা শুরু করল। আমার সিভিল সার্জন মহোদয় আসলেন, রোস্টার থেকে ডিউটি অফ করলেন। মন্ত্রী মহোদয় ফোন দিলেন। নাইজেরিয়া থেকে বাংলাদেশের হাইকমিশনার (বর্তমানে ইটালিতে গত মাসে হাইকমিশনার হিসেবে জয়েন করল) শামীম আহসান আঙ্কেল ফোন দিয়ে অনেক সান্ত্বনা দিলেন। ঢাকা আসার পথ বন্ধ, লকডাউন। দুই দিন বাসায় ছিলাম একা। আমি বুঝি ‘ডিপ্রেশন’ কাকে বলে। কিন্তু মনোবল হারাই নি। চিন্তা করছি, কিভাবে মা কে বাঁচানো যায়? ভাই ইউ এস এ-তে কাঁদতে পারছে না, যদি মা বুঝে ফেলে।

মা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোর আব্বার কি খবর?” আমি বলতাম, “আসবে মা, দেরী হবে।” মা বলতো, “এবার বাংলাদেশে গেলে আর আসব না তোর আব্বাকে নিয়ে।” বাবার ইউ এস পাসপোর্টের মেয়াদ ২০২২ সালে শেষ হয়ে যেত, এটা রিনিউ নিয়ে তার চিন্তা ছিল, কিন্তু আল্লাহ্ তার সব চিন্তা দূর করে দিল। ১৮ই এপ্রিল ইসলামী রীতিতে দাফন করা হল। এর আগে সিরিয়াল পাওয়া যায় নাই। 

এর পর শুরু হল নতুন ঘটনা, আমার ভাইয়ের রিপোর্ট পজিটিভ, পজিটিভ, নেগেটিভ আবার পজিটিভ। টানা ৪০ দিন ভুগল। মা এর নেগেটিভ, পজিটিভ, পজিটিভ। অবশেষে ৩৮ দিনের পর নেগেটিভ উইথ এন্টিবডি গ্রো। অন্য কেউ হলে পাগল হয়ে যেত! আম্মা জানল ২ মাস পর যে, বাবা আর নেই। আমি আবার ১৫ দিন পর ডিউটি শুরু করলাম, সাথে সিনিয়র হিসেবে পুরো জেলা কারাগার এর করোনাকালীন দায়িত্ব! নামলাম আবার যুদ্ধে। এর পর আবার আমার করোনা পজিটিভ হল। একটা মানুষকে ডিপ্রেশন নিতে হলে আর কিছু লাগে? তার পরেও স্ট্রং আছি।

১৯ই জুন একটা ২৫০ বেডের সরকারি হাসপাতালে ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসার (অন ডিউটি চিকিৎসক) হিসাবে নাইট ডিউটি করছিলাম, যদিও ডিউটি আমার ছিল না ওইদিন, আমার এক কলিগ এর বউ এসেছে তাই তার অনুরোধে নাইট করা। আর বাসায় একা একা ভাল লাগছিল না।

রাত ৯.৩০ মিনিটে এক বয়স্ক মহিলা এসেছে শ্বাসকষ্ট নিয়ে। তাকে সিআরপি দিতে গিয়ে নিজের প্রটেকশন আর ঠিক রাখতে পারি নাই, ডাক্তার হিসেবে মৃতপ্রায় রোগী কে রক্ষা করতে গেলে অনেক কিছুই ঠিক রাখা যায় না এবং তার সাথে অনেক এটেনডেন্স ছিল। এর মধ্যে ২ জন কলকাতার টানে কথা বলছিল এবং তার জ্বর ছিল। ফলাফল ২২ তারিখ রাতে কাঁপিয়ে জ্বর, লুজ স্টুল এবং অনেক দুর্বলতা। ২৩ তারিখ বিকেলে কাশি। ২৪ তারিখ কোভিড-১৯ টেস্ট দিলাম, ২৫ তারিখ বমিভাব। ২৭ তারিখ নেগেটিভ আসলো (আসলে ফলস্ নেগেটিভ) আর একটা স্যাম্পল দিলাম আমার ডাকনামে। শরীর খুব দুর্বল। ২০০৭-এ একবার ডেঙ্গু  হয়েছিল ঢাকা শিশু হাসপাতালে চাকরি করার সময়। সুতরাং ডেঙ্গু, টাইফয়েড এবং সিবিসি করালাম। সব রিপোর্ট ভাল কিন্তু সিবিসিতে তে ডাব্লিউ বি সি আসল ৩৫০০, যা কোভিড-১৯ এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। (নরমাল রেন্জ ৪০০০-১১০০০) তাই ২৭ তারিখ সেকেন্ড স্যাম্পল দিলাম। একটা পাল্স অক্সিমিটার কিনে নিলাম। অক্সিজেন স্যাটুরেশন ৯৪/৯৫ -এরকম থাকত। ২৯ই জুন সন্ধ্যায় একটু শ্বাসকষ্ট ছিল। সালপ্রেক্স ইনহেলার ২ পাফ নিলাম জীবনে প্রথম। ৩০ তারিখ থেকে কোন সাইন সিপ্মটম নাই। ৩ তারিখ মাঝ রাতে জানলাম, আমি পজিটিভ। ততক্ষণে আমি  সুস্থ আল্লাহর রহমতে।

আর একটা জিনিস। আমার বাবা গত ৮ই এপ্রিল নিউইয়র্ক এ করোনায় মারা গেছেন। তারপর থেকে আমি রোজ সুরা ইয়াসিন পড়ি। এটা আমাকে মেন্টালি বুস্টআপ করেছে। ৭ই জুলাই রিপিট টেস্ট করালাম, ফল নেগেটিভ। আলহামদুলিল্লাহ! আমি কোন এন্টিবায়োটিক খাই নাই। 

মা আমার জন্য দিন গুনছে। ২০ তারিখ এ ফ্লাইট ছিল কিন্তু ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় নতুন নিলাম।

আমাদের জন্য দোয়া করবেন যাতে পরিবারের চাইতে মানুষের সেবা আগে করতে পারি।

 

Sadia Kabir

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Time limit is exhausted. Please reload the CAPTCHA.

Next Post

মহিলা চিকিৎসককে হেনস্থা করার অভিযোগে গ্রেফতার আলমডাঙ্গার রহিম

Wed Jul 22 , 2020
প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২২ জুলাই ২০২০, বুধবার গত ১৮ জুলাই রোজ শনিবার, আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. আশরাফুন নাহার নীনা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোর্তজা আরেফিনকে লাঞ্চনা করার অভিযোগে আব্দুর রহিমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ১৬ জুলাই, রোজ বৃহস্পতিবার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার ডা. আশরাফুন নাহার নীনা […]

Platform of Medical & Dental Society

Platform is a non-profit voluntary group of Bangladeshi doctors, medical and dental students, working to preserve doctors right and help them about career and other sectors by bringing out the positives, prospects & opportunities regarding health sector. It is a voluntary effort to build a positive Bangladesh by improving our health sector and motivating the doctors through positive thinking and doing. Platform started its journey on September 26, 2013.

Organization portfolio:
Click here for details
Platform Logo