বুধবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২০
গতকাল সকালে গিয়েছিলাম সলিমাবাদ ইউনিয়নের ঝুনার চরের কয়েকটি বাড়ীতে। ওখানে বড় বড় আড্ডাস্থলের অভিযোগ আসছিলো। আবার অভিযোগ ছিলো নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা বিভিন্ন পরিবার সম্পর্কেও যারা পালিয়ে এসেছে লকডাউন থেকে। প্রতিবেশীদের কথামতো তারা যে ভবনে থাকতো সেখানে একজন করোনা আক্রান্ত ছিলো। ওই পরিবারের লোকগুলো আমাদের স্বাস্থ্য কর্মীদের কথাতো শুনেইনি উল্টো অপমান করেছে তারা হোম কোয়ারেন্টাইনের কথা বলায়। তাদের বাড়ী লকডাউন করতে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে বিভিন্ন ছোট ছোট ব্যারিকেড। অটোরিক্সা চলতে পারবে কিন্তু বড় গাড়ী অর্থাৎ এম্বুলেন্স, টহল গাড়ী এগুলো যাওয়া কঠিন। অর্থাৎ তারা নিজেরা চলাচল করতে পারবে কিন্তু বাইরে থেকে কেউ যেন না ঢুকতে পারে এই গ্রামে। আজ তেজখালী ও দেখলাম একই অবস্থা। এখানে ব্যারিকেড আরো বেশী। বাধাগুলো অতিক্রম করে আমরা গ্রামে ঢুকতে সমর্থ হলাম। আমাদের স্বাস্থ্য কর্মী মাহফুজা এবং পপিকে আগে থেকেই ফোন দেয়া ছিলো। তারা স্পটে দাঁড়ানো কাজেই টার্গেট স্থান চিনতে অসুবিধা হয়নি কোন।
প্রধান সড়ক থেকে বেশ ভিতরে কিছু চা ঘর। তারা মূলত চা বিক্রি করে সাথে বিড়ি সিগারেট এবং অন্যান্য টুকটাক খাবার বিক্রি হয়। এখানে জমজমাট আড্ডা চলে সকাল সন্ধ্যা। কেউ কেউ বলেন রাত এগারোটা পর্যন্ত। সরকার, আইন এগুলো এখানে স্পর্শ করে না। এরা এদের মতো করে নিজেদের পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি গ্রামের এমন দোকানগুলোর আড্ডা থেকে সারা পৃথিবীর রাজা-উজির মারাসহ ক্ষমতায় বসানো, ক্ষমতা থেকে উৎখাত, সরকারের ব্যর্থতা-সফলতা সব করা হয়। আর দিনশেষে তারা ফিরে যায় তাদের ক্ষুদ্র টিনের ঘরে। চৌকিতে শুয়ে শুয়ে দিবাস্বপ্ন দেখে দেখে ঘুমায় আর নতুন আরেকটি আশা জাগানিয়া দিন শুরু করে সকাল থেকে। বিরাট অংশেরই এখন তেমন কোন কাজ নেই তাই এই আড্ডাই একমাত্র বিনোদন। এর সাথে এখন যোগ দিয়েছে শহর থেকে ফেরা মানুষগুলো। আয় উপার্জন বলতে বিরাট অংশেরই ভরসা রেমিট্যান্স।একটি পরিবারে একজন বিদেশি থাকলে সারা পরিবার বসে বসে খায়। কঠোর পরিশ্রমের এই রেমিট্যান্স এ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, বোনের বিয়ে ভাইয়ের আব্দার মেটাতে মোটর সাইকেল কেনা সবই করে ওরা, আর বছর শেষে বিরাট অংশই থাকে শূণ্য হাতে। কাজেই আবার বিদেশ যাও।দুচারটা ব্যতিক্রম অবশ্য আছে।
আমরা সকাল সাড়ে এগারোটা সময়ও আড্ডারত মানুষজন পেলাম। সরকারী গাড়ী দেখেই ভোঁ দৌড় সবার। দোকানিরা ঝাপটা ফেলে যে যেভাবে পারে পালালো। কয়েকটা দোকান এখানে। আমরা সোজা কাজটিই করি। বসার টোলগুলো ঘরে নিয়ে যেতে বলি। ফিক্স হলে খুলে ফেলতে বলি। করোনার দুর্দিন যখন শেষ হবে তখন এগুলো আবার মেরামত করতে খরচ হবে ২০-৫০ টাকা মাত্র। কত সহজ সমাধান। ফলোআপে এ পর্যন্ত কাউকে টোল আবার বসাতে দেখিনি। টার্গেট আড্ডা কন্ট্রোল। চা বিক্রি বন্ধ করে দিলে ও পুরোপুরি বন্ধ হয় কিনা সন্দেহ আছে, তবে বসার স্থান না পেলে মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি হবার সম্ভাবনা কমে যাতে করে করোনার লাগাম কিছুটা হলে ও ধরা যাবে। চায়ের কাপগুলো যদি গরম পানিতে ধুয়ে নেয় তবে তো আরো ভালো হবে।
এ এলাকার সবচেয়ে বড় চায়ের দোকানদার ঐ গ্রামের মেম্বার। কি জানি চায়ের দোকানের আড্ডার সুবাধেই মেম্বার কি না! যে পরিমান মানুষ তার দোকানে আসে তার চিহ্ন বসার বেঞ্চিগুলো। বেশ কয়েকটা বড় বেঞ্চি। তার মানে হলো জমজমাট আড্ডার ব্যবস্থা। এটি একদম গ্রামের রাস্তার উল্টোদিকে। বাইরের কেউ স্বপ্নে ও চিন্তা করবে না যে এখানে এমন জমজমাট আসর বসে। আমরা মেম্বারকে খুজলাম। মেম্বার নেই। তার স্ত্রী জানালো তিনি উপজেলায় গেছেন। উপস্থিত লোকজন বললো তিনি ফিরেছেন একটু আগে তারা দেখেছে।বুঝলাম মেম্বার পলাতক। গ্রাম পর্যায়ে তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া অথচ তারা নিজেরাই মানছেন না সরকারী নির্দেশনাগুলো। আমার স্বাস্থ্য কর্মীর সাথে নাকি তিনি দুর্ব্যবহার করেছিলেন তার আড্ডা ভাঙতে বলায়। এখন নিজেই পলাতক। তার আড্ডাস্থল ভাঙ্গা হলো। সাথে সকল আড্ডাস্থল ভাঙার নির্দেশ দেয়া হলো।
এটি আসলে খুব সুন্দর আড্ডা দেয়ার জায়গা। দোকানের সামনে খোলা প্রান্তর। সবুজে ভরা এই মাঠ আসলেই সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।করোনার দূর্গতি শেষ হলে একদিন নিশ্চয়ই চা খেতে যাবো মেম্বারের দোকানে। সামনের বেঞ্চিতে বসে গরম পানিতে ধোয়া কাপে সবুজ ধান ক্ষেত দেখতে দেখতে চা খাবো।
চায়ের সাথে করোনার একটা অদ্ভূত বন্ধুত্ব আছে।চায়ের কাপে একজন ঠোট লাগাবে অতঃপর পরিচ্ছন্নতা না বুঝা দোকানি আরেকজনকে এই কাপে চা দিবে। দোকানি না বুঝেই চায়ের কাপের মাধ্যমে বন্ধন তৈরী করে দেয় ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, পরিবারে, সমাজে। আর দোকানের সামনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসা লোকগুলো করোনাকে ভালোবেসেই নিয়ে যায় নিজের ঘরে। অজ্ঞতা কত ভয়ানক এই লোকগুলো বুঝতেই পারে না। অতি সামান্য সতর্কতা যেখানে জীবন বাচাতে পারে সেখানে ওরা অবলীলায় কাছে টানছে শত্রুকে।
আজ আমরা করোনার বংশধরের সাথে লড়ছি।চায়ের সাথে আজীবন বন্ধুত্ব থাকা আমরাই চায়ের দোকান বন্ধ করছি। আড্ডাগুলো যদি বন্ধ হয় তবে এটি নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে সহজে। কি জানি করোনার বাচ্চাকাচ্চারা আবার আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করে কিনা। ওরা যেভাবে ডিএনএ বদলায় তেমনি হয়তো ওরা ডাক্তার চেনার উপায় ও বের করতে পারে!!!
এই যুদ্ধ ভয়ংকর। এখানে সকল জনতা প্রথম স্তরের সৈনিক। কোন মানুষ এর আওতার বাইরে নয়। পরের স্তর উপজেলা হাসপাতালগুলোর সকল কর্মীরা। ডাক্তার থেকে শুরু করে ক্লিনার আয়া সবাই। কেউ এখানে ক্ষুদ্র নয়। একটি ডিফেন্স লাইন কমান্ড না মানলে সব কিছু ভেঙ্গে পরবে। আমাদের অসচেতন মানুষ, অদক্ষ হাসপাতাল স্টাফ সবাই এটিকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে। তার উপর আছে আমাদের সচেতন ফেসবুকার জনগোষ্ঠী যারা প্রতি নিয়ত স্বাস্থ্য কর্মীদের গোষ্ঠী কিলাচ্ছে আর নিজে আরাম করে টংদোকানে আড্ডা দিচ্ছে।
কোন যুদ্ধ থেকে যোদ্ধারা পালায় না, তাদের পালানোর সুযোগ নেই। আজ নয়তো কাল তাকে যুদ্ধে যোগ দিতে হবেই। এই যোদ্ধাগোষ্ঠী উচ্চ শিক্ষিত কাজেই তাদের পালানের সুযোগ নেই বললেই চলে। এই অসম যুদ্ধ আমরা জয় করতে পারি শুধু আপনারা আমাদের কমান্ড মানলে। না মানলে আমরাসহ আপনারা মাটিতে মিশে যাবেন।
মানুষগুলোর সাইকোলজি অদ্ভূত। তার গ্রাম ব্যারিকেড দিচ্ছে যেন কেউ নারায়নগঞ্জ, ঢাকা থেকে গ্রামে না ঢুকতে পারে অথচ নিজেরা করোনা ছড়ানোর বিশাল আয়োজন নিয়ে বসে আছে। সব খারাপ যেন সরকার আর ডাক্তার, নিজেরা বেহেশতী প্রাণী সবাই। আমাদের হিসেব বলছে এখন গ্রামে গ্রামে জীবাণু আছে। তারা যদি আলাদাভাবে থাকতে পারে কিছুদিন তবে ১৪ দিন পরে কোন জীবানুর অস্তিত্ব থাকবে না। যে জীবানুগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে থাকবে এগুলো মারা যাবে আরো নয় দিনে।অর্থাৎ ২৩ দিন সবাই নিরাপদ দূরত্ব মানলে করোনা হারিয়ে যাবে।
তারা এটি শুনে কিন্তু মানে না অথবা মানতে পারে না। যারা করোনাপুরী থেকে আসছেন তারা মিথ্যা বলার দরকার নেই। আমরা আমাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্য সহকারী গ্রুপ দিয়ে এই উপজেলাকে ভালো রেখেছিলাম। তারা প্রবাসফেরত লোকদের কোয়ারেন্টাইন মোটামুটি নিশ্চিত করেছিলো।আপনারা বাইরে থেকে এসে এটি নষ্ট না করে নিজ ঘরে ১৪ দিন থাকুন। মসজিদে সাময়িক বিরতি দেন, নামাজ ঘরে পড়েন। তাহলে আমরা ইনশাল্লাহ জয়ী হবো এবং আবারো একসাথে আড্ডা, জামাতে নামাজ পড়বো।
ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা
বাঞ্ছারামপুর