সোমবার, ২০ এপ্রিল, ২০২০
শবেবরাতের রাতের মিশন ছিলো বাইরে বের হবার। টার্গেট ছিলো লোকজনের অহেতুক আড্ডা যদি কিছুটা ও দমন করা যায়। আমরাতো জানিই শবেবরাতের রাতে ছেলেপেলেরা কি করে। সারারাত ঘুরাফেরা,পটকা ফুটানো খাবার খাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে মারামারি ও হয়। আমি সাধারনত পুলিশ ছাড়াই বের হই তবে সেদিন পুলিশ নিলাম সাথে। একজন কলিগকে সাথে নেই কারন তারাও দেখুক শিখুক। সেদিন ডা. খন্দকার নাঈমকে সাথে নিলাম।
গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে হাজির হয়ে দেখি নাঈম রেডি। নাঈমকে মাথায় টুপি পড়তে বললাম এবং আমি ও টুপিপড়া ছিলাম। নাঈম টুপি পড়ার কারণ জানতে চাইলে বললাম
“যখনই কোন মসজিদে গিয়ে ঈমাম সাহেবকে সরকারী নির্দেশনামা কি জানতে চাইবো তখন তিনি বিরূপ মন্তব্য করতে পারেন। আমাদেরকে নাস্তিক,নামাজ পড়ে না এইসব বলতে পারেন অথবা এইসব কথা সামনে না বললে ও মুসল্লিদের সাথে পিছনে বলবেন দেখো না শবেবরাতের রাতে নামাজ না পইড়া সরকারী গাড়ী নিয়া ঘুরতে বাইর হইছে আর নামাজিদের ডিস্টার্ব করতেছে”।
এইসব কথা বন্ধ করার মোক্ষম উপায় হলো টুপি পড়ে বের হওয়া। এই জায়গাগুলোতে টুপির একটি আলাদা আবেদন আছে। টুপি পড়া মানুষকে হুট করে ওরা বিরূপ মন্তব্য করবে না আর আমরা ও তো কিছু
কথা জানি নাকি! একটি বড় মসজিদের গেইটে দাড়িয়ে ইমাম, মুয়াজ্জিন সাহেবকে ডাকলাম। সুন্দরমতো সালাম দিয়ে সরকারি নিয়ম তিনি জানেন কিনা জানতে চাইলাম। তিনি ছোট আকারে জামাতের কথা বললেন আর আমি জানালাম সরকারী নির্দেশনা জামাত হবে পাঁচ জনের, জুম্মার জামাত দশ জনের। তিনি জানেন জানালেন। তাহলে আপনার মনগড়া ব্যাখ্যা দিলেন কেন? আমি জানতে চাইলাম। আমতা আমতা শুরু করলেন। আমি বললাম সত্যকে ঢেকে রাখা ও মিথ্যাই। মিথ্যাকে যে রঙই দেন না কেন তা মিথ্যাই। আপনি নিয়মটি জেনে ও মানুষকে সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না, মিথ্যা বলছেন। মিথ্যা সবসময়ই পাপ। তিনি চুপ রইলেন। পুলিশসহ দুইজন ডাক্তার দেখে হয়তো সাহস করছেন না। ভিতরে ভিতরে তাঁরা কি করেন আইডিয়া করতে পারি সহজেই। আমি ও ছাড়ার পাত্র নই। আশেপাশে জড়ো হওয়া মুসল্লিদের ডাকলাম।
তাদের উদ্দেশ্যে বললাম
“এই পবিত্র রাতে আমাদের ও মসজিদেই থাকার কথা ছিলো। কিন্ত আমরা জানি কি ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে।আপনাদের যখন ইমাম মুয়াজ্জিনের কাছে থেকে সঠিক তথ্য পেয়ে হাদিস মোতাবেক ঘরে নামাজ পড়ার কথা তখন আপনারা সেটি পান নাই। আল্লাহর রাসুল বলেছেন বালা-মুসিবতে ঘরে থাকতে আর আপনারা বাইরে বের হচ্ছেন। রাসুলের হাদিস আপনারা ও মানছেন না, এই হুজুররা ও বলছেন না। তাই আমরা বের হলাম আপনাদেরকে সঠিক তথ্য জানাতে।আমরা নামাজ ঘরে ফিরে পড়বো। আমরা আপনাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করছি না, শুধু কিছুদিন বিরতি দিতে বলেছি। পাঁচজনের জামাত এখন মসজিদে হবে শুধু জামাত চালু রাখার জন্য। বালা মুসিবত দূর হলে আমরা আবারো একসাথে নামাজ জামাতে পড়বো। এই যে আমরা মসজিদে নামাজ পড়ছি না তার জন্য আমাদের ও কষ্ট হচ্ছে। কারণ জামাতে নামাজ পড়া, মসজিদে নামাজ পড়া ভালো, সওয়াব বেশী হয়। কিন্তু, জীবনই যদি না থাকে তবে আল্লাহকে ডাকবো কিভাবে? আমরা যদি কেউ ২০ বছর বেশী বাঁচি তবে আরো বেশীদিন আল্লাহকে ডাকতে পারবো। মুসলিম হিসেবে আপনাদেরকে মসজিদে আসতে মানা করতে আমাদের ও কষ্ট লাগে। কিন্তু কি করবো সামনে ভয়ংকর বিপদ। আপনারাই যদি না থাকেন তখন আমি ডাক্তারের কি মূল্য আছে? আমরা ডাক্তার মানুষের জন্য,তাই মানুষ বাচাতে চাই।আগে চেম্বারে যেতেন আপনারা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে, আর এই জরুরী অবস্থায় আমরা আপনাদের খোজ নিতে আসছি, আপনারা যাতে ভালো থাকতে পারেন সেই পরামর্শ দিতে আসছি। আপনারা যদি এই কাজকে ধর্মবিরোধী কাজ মনে করেন তবে তার সব পাপ আমি নিলাম। আপনারা দয়া করে ঘরেই নামাজ পড়বেন। মুসলিমগন মৃত্যুকে ভয় করেনা জানি তবু আপনি যদি অনেকের মৃত্যুর কারন হোন তখনতো আল্লাহর কাছে হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। আর এই কথাগুলো বলেছেন এদেশের বড় বড় আলেম ওলামাগন। আমি কি কোন খারাপ কথা বলেছি?”
জনতা ইমামকে বলতে থাকলো “উনি তো ঠিকই বলছেন।আপনারা এমন করেন কেন?” মুসল্লীদের কেউ একজন বললেন “এই গেইটটা বন্ধ করে দাও।গুনে গুনে পাচজনে নামাজ পড়বো আজ।” আপাতত এই মিশন সাকসেসফুল।
পরবর্তী গন্তব্য ছিলো রূপসদী। উত্তর বাজারের মসজিদটি দেখার প্রয়োজন। এখানে জমায়েত বেশী হয়। ইতিমধ্যে এশার সময় চলে এসেছে। আমরা হাজির হলাম সময়মতো। গেট লাগানো। আট-দশজন হবে জামাতে নামাজ শুরু করেছে। তবে গ্যাপ ছিলো ভালো। গাদাগাদি বিহীন। ওখানে আর কোন প্রশ্ন করিনি কোন। এর মধ্যেই বের হয়ে এলো ভলান্টিয়ার বাহিনীসহ ফুয়াদ এবং গৌতম। ফুয়াদ একজন ব্যাংকার। এই রূপসদী এলাকায় ভালো কাজ করছে সে এবং তার গ্রুপ।গৌতম স্বাস্থ্য সহকারী। তাকে দায়িত্ব দিয়েছি এই ইউনিয়নের। সে খু্ব একটিভ। নিজে থেকেই কাজ করছে। সকাল বেলায় ভ্যাকসিন দিয়ে তারপর কাজ শুরু করে। রাত নয়টা- দশটা কোন ঘটনা নয়। ওদেরকে বলা আছে এইভাবেই। যুদ্ধের সময় কোন অফিস টাইম নির্ধারন করা থাকে না। যখন প্রয়োজন তখনই কাজ করতে হবে। অফিসিয়াল কাজ শেষ করে এইকাজগুলো ও করতে হবে।
আরো বেশ কয়েকটা মসজিদে আগে ও গিয়েছি। ইমাম মুয়াজ্জিনগন আমাদের কথাগুলো বলে না। আমাদের সামনে হা হু করে ঠিকই কিন্তু কাজের কথাগুলো বলে না। সাধারন মানুষকে তাঁরা বুঝায় বাজার বন্ধ না করে মসজিদে এসে পরামর্শ দিচ্ছে কেন? আগে বাজার বন্ধ হোক। বাজারের ভীড় খারাপ এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কিন্তু বাজার ছাড়া জীবন চালানো কঠিন। আর মসজিদে শ্বাসের সাথে সহজে জীবানু ফ্লোরে পড়বে এবং শ্বাসের সাথে জীবানু সহজে নাকে প্রবেশ করবে।ঘরে নামাজ পড়লে, নিজস্ব জায়নামাজ ব্যবহার করলে এই সমস্যা থাকছে না। কাঠমোল্লাদের কে বুঝাবে এই কথাগুলো!
আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাকে ডেকেছিলাম মার্চের ২০-২১ তারিখ। তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ৫-৬ জনের জামাত পড়ার ব্যবস্থা করতে। তিনি ও হা হু করেছেন কিন্তু কাউকে কিছু বলেননি মনে হয়। যদি ও তিনি দাবি করেছেন যে তিনি বয়ান করেছেন,
“আপনার থেকে যদি রোগ ছড়িয়ে মানুষ মারা যায় তবে আপনি হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন,আল্লাহর কাছে বিচারের মুখোমুখি হবেন”।
কে শুনে কার কথা! মোল্লারা ও পন্ডিত, মুসল্লিরা আরো পন্ডিত। ধর্মের জন্য জীবন দিয়ে দিবে শুধু নিজের শরীরের রক্ত একফোঁটাও না। কেননা আমি যখন স্ট্রাটেজি বদলে ইমাম মুয়াজ্জিনকে বলতে শুরু করলাম যে ঈমানদার লোকজনকে করোনা রোগীর সেবার জন্য ভলান্টিয়ার হিসেবে চাই। যারা বিশ্বাস করে ইমানদারদের করোনা রোগ হয় না তাদেরকেই চাই সেবার জন্য, তখন আর কাউকে পাওয়া যায় না। সবাই কাপাকাপি শুরু করে এবং ক্ষমা চায়। আসলে ক্ষমা করার আমি কে এখানে! উপরওয়ালা যদি তাদের ক্ষমা করেন। আমি শুধু তাদেরকে রোগ মুক্ত রাখতে পারলেই খুশি। তারা সুস্থ থাকলেই আমাদের পরম পাওয়া এটি।
আরেকটি মসজিদে গিয়ে দেখি লোকে লোকারন্য। যথারীতি ইমামকে তালিম দিলাম। তিনি ও ব্যাখা দিলেন যে যত কম সংখ্যক লোকে জামাত পড়া যায় তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশ। আমি বলেছি ইসলামিক ফাউন্ডেশন কিংবা ধর্মমন্ত্রনালয়ের আদেশ বিকৃত না করে সঠিক কথাগুলো বলতে। তারা কি বলেছেন জনগনকে জানতে চাইলাম। তারা বলেছেন,
“ধর্ম মন্ত্রনালয় নির্দেশে দিয়েছে ৫ জনের জামাত পড়তে, দশজনের জামাত পড়তে হবে জুম্মার নামাজে”।
কথাটা তারা পরিষ্কারভাবেই বলেছেন। কিন্তু, এখানে একটি শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। তারা বলছেন যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অথবা ধর্ম মন্ত্রণালয় বলেছে এই কথা, মানে হলো তারা বলছেন না বা তাদের মনের কথা না। সরকারি আদেশ তারা পড়ে শুনিয়েছেন মাত্র। এই আদেশ শুনে অশিক্ষিত লোকজন মুখ টিপে হাসে। আবার অনেক মাওলানা মানুষকে এটি ও বলে যে মসজিদে যেতে মানা করা বিদাত। অথচ তারা জানে যে সৌদি আরবের ম্যাক্সিমাম মসজিদ বন্ধ। তারা এর ব্যাখ্যা দেয় এভাবে যে সৌদিয়ানদের ঈমান দূর্বল। তাদের ঈমান শক্ত। শুধু করোনা রোগীদের সেবার কথা বললেই আর খুজে পাওয়া যায় না। অবশ্য বয়ষ্ক ইমামদেরকে করোনা রোগীর সেবার কথা বলি না। হুট করে হার্ট এটাক করলে ঝামেলা বেড়ে যাবে। মানুষের মধ্যে ও ভুল মেসেজ যাবে। তারা যদি ভালো বিদ্যান হতো তাহলে হাদিস মোতাবেক মানুষকে ঘরে থাকতে বলতো। ঘরে নামাজ পড়তে বলতো। বালা-মুসিবত দূর হলে আবার সবাই মিলে জামাতে নামাজ পড়ার আশা দিতো। মানুষজন তাদের কথা শুনতো। এখনো মানুষ তাদের কথা শুনে কিন্তু তারা সত্য কথাগুলো বলেনা। তারা যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসকে মানে বেশী। অশিক্ষিত মানুষ বেশী হওয়ায় তাদেরকে অন্ধভাবে মোটিভেট করা বেশী সহজ। তারা এর মাধ্যমেই ব্যবসা চালিয়ে যায়। অথচ আমাদের দেশের দ্বিতীয় মৃত ব্যক্তিটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। আমাদের থানায় যার করোনা ধরা পড়লো তিনি ও মাওলানা সাহেব। তার ছেলে নারায়নগঞ্জ থেকে এসেছিলো কিছুদিন আগে।
আমি নিজে মুসলিম এবং নামাজ পড়ছি নিয়মিত। নামাজের সাথে,মসজিদের সাথে আমার কোন বিরোধ থাকার সুযোগ নেই। আমি নিজে মসজিদে যেতে মানা করছি রোগ থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য, নামাজ থেকে বিরত রাখার জন্য নয়।এটি সাময়িক বিরতি মাত্র। করোনার প্রকোপ চলে গেলে আবারো গলাগলি করে নামাজ পড়বো। জুম্মার মসজিদে আবার সবাই এক হবো। সেই মধুর দিনটির অপেক্ষায় রইলাম আমরা সবাই। আল্লাহ্ যদি বাঁচিয়ে রাখে নিশ্চয়ই আবারো মসজিদে দেখা হবে।
ডা. মোহাম্মদ আল-মামুন
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, বাঞ্ছারামপুর