শুরুতেই ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি আমার সরাসরি কথাগুলো পড়ে কারও মনে আঘাত পেলে। আবেগের স্থান কে ধরে রেখেই দ্বায়িত্বের জায়গাটা- সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাটা দৃঢ়ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছি।
পেশাগত কারণে আমি অনেকগুলো ডাক্তার পেজের সদস্য, যেখানে ডাক্তাররা তাদের প্রতিদিনকার কর্মব্যস্ত জীবনের নানা চ্যালেন্জ আর কষ্ট- সাফল্যের কথা শেয়ার করেন।
গত কয়েকদিন ধরে একই রকম নিউজ ঘন ঘন দেখছি- ডাক্তার ডিউটিরত, বাসার তার নিকটাত্মীয়( মা/বাবা/সন্তান) গুরুতর অসুস্হ অথচ ডাক্তার দেখতে যেতে পারছেন না, রোগী কষ্ট করছে, মারা যাচ্ছে। ফেসবুকে পোষ্ট পড়ছে, সবাই সমবেদনা জানাচ্ছেন, লাইক-শেয়ার দিচ্ছেন, রাগ-ক্রোধ ও প্রকাশ পাচ্ছে, ডাক্তার কত মহান মানব সেবায় ব্রত এবং এরপরও সমাজে কেন ডাক্তারদের মূল্যায়ন সম্মান নেই তা হয়ে যাচ্ছে আলোচনার প্রতিপাদ্য। একটি বৈরী পরিবেশ তৈরী হচ্ছে একটি ঘটনা কে কেন্দ্র করে। সবশেষ ফলাফল, ডাক্তার-রোগী সম্পর্কেই প্রভাব টা পড়ছে, যা চিকিৎসার মূল ভিত্তি।
দুটি ঘটনার অবতারণা করছি। দুটি ই ধরে নিন কাল্পনিক, যদিও দুটোই বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। দুজন ডাক্তার। ডা. তনিমা এবং ডা. টীম। একজন বাংলাদেশের এক জেলা শহর হাসপাতালের সরকারী চাকুরীতে ক্যান্সার সেবা দিচ্ছেন আর দ্বিতীয়জন কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়ার রিজিওনাল কোন শহরের এক ক্যান্সার অনকোলজি সার্ভিসে।
প্রথমে ডা. টীমের গল্পটি শুনুন। যারা জানেন না তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, অস্ট্রেলিয়ার রিজিওনাল কোন সেন্টারে একজন বা দুজন ক্যান্সার ডাক্তার ই মূলত সবকিছু চালান। কারণ ডাক্তার কম। তিনি ই ইনডোর, তিনিই ক্লিনিক, তিনিই আউটডোর। বছর শেষে তার রিভিও প্রমোশন ডিপেন্ড করে নিরবিচ্ছিন্ন ক্যান্সার সার্ভিসের প্রদানে পারদর্শিতার উপর। এমন একজন ডাক্তার ডা. টীম। টীমের মা নিজেও ক্যান্সার রোগী, কেমো পাচ্ছেন, ২০০ কিলোমিটার দূরের আরেক শহরে বাস করেন। প্রতিদিন ই সকালে কাজের শুরুতে মা কে হাই হ্যালো করা টীমের দৈনন্দিন রুটিন। আজ একটু রুটিনে ব্যতিক্রম হয়ে গেল। সকালে মা জানালো রাত থেকে জ্বর জ্বর শরীর আর সেই সাথে কাশি একটু। টীম জ্বর মাপতে বলায় মা জানালো ১০১। হ্যাঁ সত্যি জ্বর ! মা কেমো পাচ্ছে! প্রথম ইমার্জেন্সী যেটা মাথায় আসলো- ফেব্রাইল নিউট্রোপেনিয়া- একটি ক্যান্সার ইমার্জেন্সী! মা কে যত দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, এবং প্রয়োজনে আইসিইউ তে!! রোগীর রোগ প্রতিরোধকারী শ্বেতকণিকা এতই কমে গেছে যে সামান্য জীবাণু সংক্রমণ ই প্রাণঘাতী হয়ে দাড়াবে। ২০০ কিলোমিটার দূরে মার প্রথমেই যাকে দরকার সে টীম। ০০০ তে ফোন করলে এম্বুলেন্স যাবে কিন্তু টীমের মার পাশে থাকা দরকার।
ওদিকে ভর্তি ১৫ টা রোগী আর আউটডোরে আরও ১৫ জন! টীম এমন জায়গায় আছে যে চট করে আরেকজন রিপ্লেসমেন্ট পাওয়ার সম্ভাবনা শূণ্যেরও নীচে! তার উপর নতুন জব…নতুন বস… সবকিছু মিলে টীম দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল। ০০০ তে ফোন করে কিছুক্ষণ কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। একটা পর্যায়ে সে আবিষ্কার করলো সে একটা ভালো দোটানায় পড়ে গেছে- রোগীর সাথে তিন মিনিট কথা বলার মধ্যেই সে তিনবার অন্যমনস্ক হয়ে গেছে- রোগীর জটিল ট্রীটমেন্ট প্রটোকলের মধ্যে কিভাবে যেন মা ঢুকে পড়ছে বারবার। রোগী নিজের পরিবারের কথা বলার সাথে সাথে নিজেও হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের স্মৃতির দিনগুলোতে। নাহ! এভাবে হচ্ছে না। এভাবে ট্রীটমেন্ট হবে না, ভুল হয়ে যাবে। আর ভুল হয়ে রোগীর ক্ষতি হলে সর্বনাশ! তখন আইনী ঝামেলা শুরু হবে। টীম সিদ্ধান্ত নিল বসকে জানানোর।
বস শুনেই বলল, এম্বুলেম্স তো মা কে হাসপাতালে নিয়েছেই, চিকিতসা শুরু হয়েছে, টীমের যাওয়ার দরকার কী। টীম একবার ভাবলো, হু কথাটা ঠিক।। কিন্তু পরক্ষণেই ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, “মা র কাছে যাও টীম।” নাহ, আবার ফোন উঠালো টীম। বস নিজেও বিব্রত। টীম কে ছেড়ে দিলে ডিপার্টেমেন্ট কে চালাবে এখন !? টীম ঠান্ডা গলায় বুঝালো তাকে রেখে দিলেও লাভ নেই, কারণ কাজে সে একেবারেই মন বসাতে পারছে না। বস জানালো এভাবে ডিপার্টমেন্ট খালি রেখে চলে যাওয়া…. এক্সিকিউটিভ কে ব্যাপার টা জানানো উচিত। টীম তাই জানালো। এক্সিকিউটিভ শুনলেন। বুঝলেন ডাক্তারের ফ্যামিলি ক্রাইসিস এবং ডাক্তার এই মুহূর্তে চিকিতসা প্রদানে অপারগ। তিনি দ্রুত ডাক্তারকে ছেড়ে দিলেন এবং ফোন নিয়ে বসলেন- এখন তাকে বেশ কিছু জায়গায় ফোন চালাতে হবে, সিচুয়েশন ম্যানেজ করতে হবে।
টীম ছুটলো মা কে দেখতে। দুঘন্টা লাগবে পৌঁছাতেই। টীম দুঘণ্টা পর যখন মা কে দেখতে পেল তখন মার অবস্থা খুবই খারাপ। ডাক্তারী জ্ঞান এটুকু বলছে- এযাত্রা হয়তো পার হবে না। সাত ঘন্টা যুদ্ধের পর টীমের হাতেই মা তার নিস্তেজ মাথা এলিয়ে দিলেন। দুশ্চিন্তার একটি ফোনকল দিয়ে শুরু হওয়া দিনটি সন্ধ্যার মধ্যেই একদম বিষাদময় নিশ্চিন্ত- শান্ত হয়ে গেল। অথচ কাল সকালেই অফিস। টীম সাথে সাথেই মার মৃত্যু সংবাদ তার হাসপাতালের এডমিন কে জানিয়ে বলে দিল সাত দিন পর সে কবে কাজে ফিরবে তা জানাবে, এর মাঝে সে পরিবারের সাথে থাকতে চায়। এডমিনের মেয়েটি সমবেদনা জানিয়ে ফোন রেখে দিল।
সাত দিনের কথা বলেও টীমের পুরোপুরি শোক কাটাতে এক মাস লেগে গেল। একমাস সে একদিন ও হাসপাতালের যায়নি। এর মধ্যে শুধু অফিস থেকে ফোন দিয়ে তাকে জানানো হয়েছে, সে যেন বৈষয়িক বেতন ভাতা নিয়ে চিন্তা না করে- ওগুলো বিভিন্নভাবে কাভার হয়ে যাবে। সে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যেন কাজে ফিরে এবং সাপোর্ট লাগলে যেন জানাতে দ্বিধা না করে।
একমাস পর কাজে ফিরে টীম প্রথমেই তার হাসপাতালের এবং রোগীদের একটি খোলা চিঠি দিয়েছে- বিপদের দিন তার পাশে থাকার জন্য, তার অনুপস্হিতিতে সাময়িক অসুবিধা মেনে নেওয়ার জন্য এবং সর্বোপরি দ্বিতীয় পরিবার হয়ে বিপদে তাকে ছায়া দেওয়ার জন্য। হাসপাতাল- বস সবাই টীম কে ফিরে পেয়ে দারুণ খুশি। সবাই এসে হাত মিলিয়ে গেল ঝলমলে হাসি উপহার দিয়ে। বস বলে গেল, মন খারাপ হলেই যেন তাকে জানানো হয়। টীমের মনে হল সে মা কে হারিয়েছে ঠিক ই কিন্তু দ্বিতীয় পরিবার- হাসপাতাল কোন অংশেই আত্মীয়ের চেয়ে কম নয়। টেবিলে বসে কফির মগে চুমুক দিয়ে প্রথম ফাইলটি টেনে নিল টীম। এইতো পরের রোগীটাও ব্রেস্ট ক্যান্সার, তার মার মত! টীম পূর্ণ উদ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছে এই মরণব্যঘাতী রোগের সাথে নিজের সর্বোচ্চ মেধা নিয়ে লড়ার। ভিতর থেকে যেন কেমন এক অনুপ্রেরণা পাচ্ছে সে লড়াই করার। রোগীগুলোকে আরও বেশি যত্নের সাথে দেখতে হবে তার!
এবার বাংলাদেশের জেলা শহরে কাজ করা দ্বিতীয় ডাক্তার ডা. তনিমার( ছদ্মনাম) কথা বলি। ডা. তনিমা ও ক্যান্সার স্পেশালিস্ট হবার পথে, ট্রেনিং করছেন। মা ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগী, কেমো পাচ্ছেন। ডাক্তার হিসাবে মায়ের ট্রীটমেন্ট তনিমা নিজেই দেখাশোনা করেন। আজ সকালে ডা. টীমের মা এর মত ডা. তনিমার মা এর ও ১০১ জ্বর সাথে কাশি। টীমের মত তনিমা ও বেশ বুঝতে পারছে মা কে হাসপাতালে নিতে হবে দ্রুত। কিন্তু এদিকে রোগীর কী হবে। অনেক রোগী! স্যার কে এই সকাল ১০ টায় সব ফেলে চলে যাওয়ার কথা বললে স্যার নির্ঘাত হার্টফেল করবেন, ধমক খাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ! তার উপর স্যারের সন্তুষ্টির উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তনিমা হতাশ চোখে কয়েক টা রোগীর ফাইলে চোখ বুলালো। কীসব হাবিজাবি লিখা। একটা অক্ষর ও মাথায় ঢুকছে না, ওষুধের ডোজ- সাইকেলগুলো সবই এলোমেলো লাগছে। দাঁতে দাঁত চেপে তনিমা কাজে মনোনিবেশ করলো। জোর করে কাজ-পড়াশোনা গলাধ:করণ করা তনিমা ভালোই শিখে গেছে মেডিকেলের সুবাদে।
নাহ তাও হচ্ছে না। মোবাইল দিয়ে বাসার দুজন কে ফোন দিয়েও লাভ হলনা কোন- তারা ডাক্তার না। অবস্হার গুরুত্ব বুঝবেন না তনিমার মত। তনিমা এর মধ্যে একবার স্যারের রুমে উকি দিল, স্যার কাকে যেন ফোনে ধমকাচ্ছেন, কোথায় না কী সব মিসম্যানেজমেম্ট হয়েছে। এর মধ্যে তনিমার আর নিজের কথাগুলো বলার সাহস হলো না। চুপচাপ টেবিলে এসে আবার মোবাইল নিয়ে বসল- যদি কোন ব্যবস্থা করা যায়! কিন্তু নাহ! কিছুই হচ্ছে না। আজ মনে হচ্ছে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হবে। ফিরেই মা কে হাসপাতালে নিতে হবে- দ্রুত! আচ্ছা আজকের দিনটা এতো অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক কেন লাগছে !
সন্ধ্যায় বাসায় যেয়ে তনিমা মা কে আবিষ্কার করলো একদম ই মুমূর্ষ অবস্থায়। মা নাকি এই শরীরে দুপুরের রান্নাটাও করেছেন! বিকাল থেকে বিছানায়! চড়ুই পাখির মত ছোট্ট অর্ধচেতন মা এর শরীর টা নিয়ে হাসাপাতালে পৌঁছানোর তিন ঘন্টার মাথায় সব শেষ! ক্যান্সার টাই জিতে গেল ! ডাক্তাররা চেষ্টার কমতি করেনি, কিন্তু ইনফেকশন ছড়িয়ে গেছে সারা শরীরে। রক্তের রিপোর্ট বলছে মাত্র ৫০ টি শ্বেতকনিকা নিয়ে যুদ্ধ করে মা হেরে গেছেন কোটি জীবাণুর কাছে। অসহ্য ! আর কয়েক ঘন্টা আগেই যদি এন্টিবায়োটিক টা দেওয়া যেত। তনিমার গাইডলাইন মনে পড়ে গেল, “ফেব্রাইল নিউট্রোপেনিয়া! এন্টিবায়োটিক টাইম ইজ থার্টি মিনিটস!” ইস ! মা এর সকাল থেকে জ্বর! আর মা ঔষধ পেল সন্ধ্যায় !!
তনিমা তিন দিন আর অফিসে যায়নি। এরপর যেতে হয়েছে- নাহলে বেতন আটকে যাবে। অনেক নাকি নিয়ম লীভ নেওয়ার! অফিসে প্রথম দিন টেবিলে বসে তনিমা কিছুক্ষণ নীরবে কাঁদলো। এরপর চোখ মুছে টেনে নিল একটি রোগীর ফাইল। ফাইলে আবার সেই দুর্বোধ্য সব প্রটোকল লিখা! অর্থহীন! সবই অর্থহীন! এখন তনিমার কাজ করতে একটু ও ভালো লাগে না। প্রায়ই মাথা ধরে থাকে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গিয়েছে অনেক। অল্পতেই বিরক্ত হয় তনিমা, রোগীগুলো এত কথা কেন বলে?! ক্যান্সার স্পেশালিস্ট হয়ে গেছে তনিমা অনেক বছর আগেই, কিন্তু মা এর মৃত্যু তাকে প্রতিদিন দংশণ করে অজস্রবার। শুধু একটাই আফসোস-“ যদি একটু আগে মা কে হাসপাতাল নিতে পারতাম…. “ এরপর ভাবনা টা আর এগোয় না!
দুটো জীবন থেকে নেওয়া গল্পের অবতারণা করে এখন মূলকথায় আসি। গতকাল-পরশু একজন ডাক্তার পোস্ট করেছেন তার ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে তিনি নিজে ক্যান্সার ডাক্তার হওয়ার পরও ঔষধ কিনে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারেন নি। মা মারা গেছেন। আমি তার একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে এরকম হাজারো বেদনার কাব্যের একটি সরল সমাধান করার প্রয়াস নিচ্ছি কিছু সাধারণ যুক্তির মাধ্যমে আর তুলনামূলক চিত্রের মাধ্যমে।
প্রথমেই বলি, ঘটনা টি নি:সন্দেহে হৃদয়বিদারক। পড়া মাত্র মন খারাপ হয়ে যায়, সকাল টা নষ্ট হয়ে যায়। আমার একজন কলিগের মা মারা গেছেন কিন্তু কলিগ কাজের চাপে মা কে সুচিকিতসা করাতে পারেন নি- তার মুখ টা ভাবলেই মনটা বিষাদে ভরে যায়, কারণ মা জায়গাটা সবার ই কোমল স্নেহের জায়গা। কিন্তু এই খবর গুলোতে আমার কেন যেন মন খারাপের পর ই রাগ হতে থাকে। প্রচন্ড রাগ। সবকিছুর উপর রাগ। পুরো সিস্টেমের উপর রাগ।
কিন্তু চলুন ভাবি, দুটো চিত্রের মধ্যে গ্যাপটা কোথায়? কেন এমনটা হবে? আমার মতে প্রধানত গ্যাপ দুটো জায়গায়- ১। ব্যাক্তি পর্যায়ে ২। সিস্টেম পর্যায়ে।
প্রথমেই ব্যক্তি পর্যায়ে আসি। কোমলতা সরিয়ে রেখে কঠোরভাবে বলি একটু। দেখুন, তনিমা নিজে ক্যান্সার স্পেশালিস্ট হয়ে কেমোথেরাপী পাওয়া মা এর “ফেব্রাইল নিউট্রোপেনিয়া( একটি ক্যান্সার ইমার্জেন্সী)” বুঝার পরও পৃথিবীর হাজার ডিউটি উপেক্ষা করে মা কে চিকিৎসার ব্যবস্হা না করে বসে বসে ডিউটি করতে থাকেন তবে তিনি কি সত্যিই খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছুর গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হননি?
মাথায় মা এর দুশ্চিন্তা নিয়ে তনিমা কি অন্য রোগীর চিকিতসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানে মানসিকভাবে সক্ষম ছিলেন? উত্তর যদি না হয়, তাহলে মানসিকভাবে পারদর্শীতা না থাকা অবস্থায় একজন ডাক্তারের অন্য রোগীর জীবন-মৃত্যু নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে থাকা বা চিকিতসা করতে থাকা কি উচিত? লক্ষ্য করুন, ডা. তনিমা নিজের পরিবার কে বিপদে সাহায্য করতে তো পারেন ই নি, উল্টো রোগীর জীবন কে ঝুকিতে ফেলছেন মাথায় চাপ নিয়ে চিকিতসা দিয়ে। বৈরী সিস্টেম এবং নিজের সিদ্ধান্তহীনতায় সম্ভাবনাময়ী একজন ডা. তনিমা কে সময়ের স্রোত করে তুলেছে খিটখিটে মেজাজের দীর্ঘশ্বাস ফেলা একজন ক্যান্সার স্পেশালিস্টে, যেখানে যুক্তির জোরেও ভুলটুকু শুধু ডা. তনিমার নয়। মা হারানো একজন ডাক্তারকে দায়িত্বের কাঠগড়ায় দাড়া করানোর প্রয়াসে এই লেখা লিখছি না। লিখছি সমাধান খুজার আশায়। কারণ এই চাপের সময় সিদ্ধান্তে আসা সহজ নয়। দরকার এসিস্ট্যান্স। সাপোর্ট সিস্টেম। যেটা আমরা ডা. তনিমা কে দিতে পারিনি। সেই সিস্টেম গ্যাপে একটু পরে আসছি।
তনিমার করণীয় কিছু বিষয়ে আসি। রোগীর সুচিকিতসার জন্য ডাক্তারের নিজের শারিরীক ও মানসিক সুস্থতা সবার আগে নিশ্চিত করার দায়িত্ব ডাক্তারের। “ফ্যামিলি কামস ফার্স্ট”- এই সাধারণ নিয়ম না মেনে পরিবার উপেক্ষা করে ডা. তনিমারা যখন ডিউটি করে যান, তার পিছনে হাজার টা কারণ থাকলেও আমার কাছে ঘুরেফিরে একটা কারণ ই মূখ্য মনে হয়- সেটা হল “প্রায়োরিটি জ্ঞান”।
ডাক্তার আর্মির চাকরী করেন, বিসিএস এ দূরে আছেন, তিনি ই সব চালাচ্ছেন, তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ , ছুটি হয় না, ছুটি পাওয়া যায় না , কাজের পরিবেশ এরকম ই, তিনি চলে গেলে এত রোগী কে দেখবে?, উপরমহল খেপবে, শোকজ হবে, চাকরি যাবে, ব্লা ব্লা যত যুক্তি ই দেখান না কেন – ঘুরেফিরে প্রশ্ন কিন্তু ওই এক জায়গাতেই , “কোনটা আপনার প্রায়োরিটি? আপনার মা নাকি বাকী সবকিছু??”
আর দায়িত্ববোধের কথা বললে শুরুতেই আপনার নিজের বোঝা উচিত পরিবারের অসুস্হতা মাথায় নিয়ে আপনি একজন বিপদজনক ডাক্তার। আপনার নিজের ই উচিত নিজেকে আনফিট ডিক্লেয়ার করে পরিবারের পাশে থাকা। এরপর যা হয় দেখা যাবে। কেউ খেপলে খেপবে, আপনার মা , আপনার পরিবারের চেয়ে তা নিশ্চয়ই বড় নয়।
উপরের যুক্তিগুলো কেউ খন্ডন করতে পারবেন না। হয়তো এটা বলবেন, বাস্তবতা ভিন্ন। এত সহজেই স্টেশন/ কর্মস্থল লীভ করে চলে যাওয়া যায় না। চলুন না বাস্তবতা কে সম্মুখ মোকাবিলা করি। আপনার পরিবার বিপন্ন, আপনি কি আপনার লাইন ম্যানেজার/ ইমেডিয়েট বস/ কমানডিং অফিসার/ কনসালটেন্ট/ অধ্যাপক/ যার আন্ডারেই কাজ করেন না কেন তাকে জানিয়েছেন নাকি ধমক খাওয়ার ভয়ে চুপ করে থেকে পুরো পরিস্থিতি কে জটিল করে তুলছেন। খোদ অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে রিসার্চ পাবলিকেশনে এসেছে- ট্রেনিং পিরিয়ডে প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি ডাক্তার তাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো চেপে যান- অভিযোগ করেন না, যার প্রধান কারণ ক্যারিয়ার ভাবনাকে প্রাধান্য দেওয়া। অর্ধেকের বেশি ডাক্তার বাৎসরিক ছুটি নেন কিন্তু পড়াশোনা- কোর্স করে কাটান। আমাদের দেশে অবস্থা আরও ভয়াবহ, চাপ আরও বেশি। কিন্তু এই চাপের থেকে একমাত্র উদ্ধারকর্তা আপনি নিজে !!
আমাদের স্কুলের প্রথাগত আনুগত্যমূলক শিক্ষা আর মেডিকেলের গুরুমূখী বিদ্যা ধারার শিক্ষার কারণে জুনিয়র ডাক্তার সিনিয়র ডাক্তারকে একটা ফোন করার আগে তিনবার চিন্তা করেন।কিন্তু প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ আপনার সমস্যা এবং কাজ দুটোকেই রক্ষা করতে পারে।
আপনি দ্রুততম সময়ে আপনার সমস্যা রিপোর্ট করুন, কারণ আপনার বসের অনেক কাজের মধ্যে একটি প্রধান কাজ হল আপনার সমস্যা শোনা এবং তা সমাধান করা। তাকে আপনার সমস্যা বুঝতে এবং সমাধান করতে আপনার ই সাহায্য করা উচিত। লিখিত রিপোর্ট করুন মৌখিক কাজ না হলে। সমাধান না পেলে পরবর্তী লাইন ম্যানেজার কে জানান- এবং সেটাও আপনার বস কে জানান যে আপনি তার পরবর্তী লেভেলে সাহায্য চেয়েছেন- ব্যাপারটা কোনভাবেই ব্যাক্তিগত দ্বন্দ নয়, একটি সমাধানের প্রয়াসমাত্র। কোনভাবেই সমাধান না হলে, আপনি আপনার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অটল থাকুন। একটা কথা সত্য আপনি পৃথিবীর যেকোন আইনে আপনার পরিবারের ইমার্জেন্সী তে কাজ বসের কাছে হ্যান্ডওভার করে বস কে জানিয়ে চলে গেছেন- ব্যাপারটা কোর্ট পর্যন্ত গড়ালেও আপনি ই সঠিক বিবেচিত হবেন। আপনার বস হয়তো সাময়িক অসুবিধায় পড়বেন, বিরক্ত হবেন মনে মনে, কিন্তু সাত দিন পর ই তিনি আপনার দৃঢ় সিদ্ধান্তের জন্য আপনাকে পছন্দ ই করবেন। কারণ পৃথিবীর সব বস ই মিনমিন করে সমস্যা চেপে রাখা অধস্তন জুনিয়রের চেয়ে কর্মঠ এবং কনফিডেন্ট জুনিয়র বেশি পছন্দ করেন।
এবার সিস্টেম গ্যাপে আসি। কিছু ব্যাপার দেশে এখনও নেই বা খুব প্রিমিটিভ ভাবে আছে, কিন্তু ভাবা দরকার খুব গুরুত্বের সাথে। যেমন- ডাক্তারদের সাপোর্টিং সংগঠন, ইনডেমনিটি ইন্সুরেন্স, ডাক্তারদের ফিনান্স ইন্সটিটিউশন, ডাক্তরদের হেলথ প্যাকেজ সিস্টেম, ডাক্তারদের ক্যারিয়ার- ইনকাম প্রটেকশন ইত্যাদি। ডাক্তারদের সংগঠনগুলো আরও শক্তিশালী করা দরকার( শুধু নির্বাচন আর কমিটি নয়), যারা ডাক্তারদের অধিকার আদায়ে কাজ করবে, ডাক্তারদের আইনী পরামর্শ দিবে, বিপদে সাপোর্ট করবে, ক্যারিয়ার নির্দেশনা দিবে। বাইরে প্রচুর পাবলিক এবং প্রাইভেট সংগঠন কাজ করে, এমনকি রাজনৈতিক সংগঠন পর্যন্ত। তেমনি আমাদের দেশে বিএমএ( বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন) আছে। বিএমএ পারে তার সেবার পরিধি বিস্তৃত করতে। তার নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল( যখন ডাক্তার আইনি জটিলতায় পড়বে), আইটি প্যানেল( ডাক্তারদের অনলাইন লার্নিং এবং প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের জন্য), মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট( ডাক্তারের পারদর্শীতা/ সার্ভিস প্রচারের জন্য)- ইনডেমনিটি ইনসুরেন্স( ডাক্তারের ভুল হলে তার সুরক্ষার জন্য), ইনকাম প্রটেকশন( ডাক্তার অসুস্থ হলেও তার ইনকাম থাকবে), ফ্যামিলি প্রটেকশন( ডাক্তারের পরিবারের হেলথ সার্ভিসের জন্য), মেন্টাল হেলথ( দেশে একেবারেই উপেক্ষিত, কিন্তু বাস্তব সত্য যে ডাক্তারদের দৈনন্দিন চাপ অন্যান্য পেশাদীবীদের চেয়ে অনেক বেশী) – এসব সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট থাকা উচিত, নামমাত্র নয়, একদম কর্পোরেট হাউজের মত, যেখানে ডাক্তার নিয়মিত ফি দিবে এবং প্রয়োজনে সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারবে। ডাক্তারদেরও কর্তব্য বাড়বে- সব ডাক্তার যদি মাসিক ১০০ টাকা ও চাঁদা দেন তাহলে কিন্তু বিএমএ/ প্রাইভেট সংগঠন অনেক বেশি জবাবদিহীতার মধ্যে চলে আসে এবং সার্ভিস দিতে বাধ্য হয়। একটা ব্যাপার আমার মনে হয়, শুধু ডাক্তার দিয়ে ডাক্তারদের সব চাহিদা পূরণ করে ভালো থাকা সম্ভব নয়- আমাদের ভালো রাখতে প্রচুর পেশাজীবী লোক লাগবে যাদের কাজ হবে আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। আমরা যেমন রোগীকে সার্ভিস দেই তেমন আমাদের ও সার্ভিস কিনতে হবে, সংগঠন/ ইন্সটিটিউশণ তৈরী করে নিতে হবে নিজেদের স্বার্থে- যা জেলা ভিত্তিক/ থানা ভিত্তিক/ পাবলিক-প্রাইভেট নানা আকারে হতে পারে- কিন্তু থাকতে হবে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়। নাহলে আমরা যে প্রায় ই আবিষ্কার করি যে কোন একটা ঘটনা ঘটার পর আসলেই প্রতিকারের কোন জায়গা নেই- সেই শূণ্যতা কোনদিন ও কাটবে না। আশা করি এসব ব্যাপার নেতৃত্বে থাকা ডাক্তাররা সত্যি সময় নিয়ে ভাববেন।
আরও একটি ব্যাপার আমি বাইরে এসে লক্ষ্য করেছি-নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে। আমরা সবসময়ই নেতৃত্ব দেই এমন একজন স্যার বা অধ্যাপক কে যিনি মহীরূহসম, শশব্যস্ত সময় পার করেন, একই সাথে আরও পাঁচটি সংগঠনের প্রধান হয়ে আছেন। যেমন আমি আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক স্যারকে নিজেই হতাশাভরা কন্ঠে বলতে শুনেছি, “আমি ৩২ টি সংগঠনের সভাপতি। আমি বলেছি আমি বছরে এক ঘন্টা সময় ও দিতে পারবো না, এরপরও তারা আমাকেই চায় এবং সভাপতি হিসেবেই চায়!” আমাদের সংগঠনের কাজগুলো গতিশীল করতে/ আরও সার্ভিসমূখী করতে এই ধারাটা পাল্টাতে হবে। নাহলে কমিটির পর কমিটি হবে আর সংগঠন থাকবে শুধু ড্রয়ার আর আলমারী বন্দী। সার্ভিস অধরাই থেকে যাবে, এবং আমরা সমষ্টিগতভাবে ভালো থাকবো না। আশা করি সবাই সমষ্টিগতভাবে ভালো থাকার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন আরও বেশি।
বিদেশে খুব সুন্দর সুন্দর সিস্টেম আছে, কয়েকটি মাত্র বললাম। হয়তো আমাদের নিতীনির্ধারকগণ ও জানেন এসব, কারণ তারা যথেস্ট পরিমাণ বিদেশ দেখেছেন, কেন দেশে এসব হচ্ছে না সেই আলোচনা টা থাক, আশাবাদী আমি, আশায় বুক বাঁধি। আমার সবসময়ই একটি কথা মনে হয়, আমাদের দেশের যে ম্যানপাওয়ার আছে তা দিয়ে বিদেশের থেকে দশগুণ সুন্দর সিস্টেম তৈরী করে খুব এফেক্টিভভাবে চালানো যায়। দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রগুলো সবচেয়ে ভালো লাইফস্টাইল কেন পাবে না ? বিদেশে তো পাচ্ছে। আমরা কেন না ? আশা রেখে শেষ করছি। বাইরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের তীরের ছোট্ট শহরে অসময়ের সন্ধ্যার বৃষ্টি নামছে, আমার কথাগুলোও শেষ হয়ে আসছে ….
পরিশেষে, যে ডাক্তার আজ মা হারালেন তাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। “নিজের মা কে হাসপাতালে নিতে পারলাম না…” এই আফসোস টা তিনি সারাজীবন বুক চাপড়ে করবেন। একদিন দেশ বরেন্য ডাক্তার হয়ে হাজার ক্যান্সার রোগীকে বাঁচাবেন আর দিন শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন নিজের মা এর জন্য। কোন মানে হয়? একটা ভুল সিদ্ধান্ত/ সিদ্ধান্তে দেরী/ সিদ্ধান্তহীনতা/ কিছু সিস্টেমের অভাব কতকিছু ওলটপালট করে দেয়। শুধু চাই আর কোন ডাক্তার এভাবে পরিবারের প্রিয়জন না হারাক, সারাজীবন আফসোস না করুক।ডা. তনিমাদের স্বার্থপর হতে বলছি না, ডিউটি উপেক্ষা করতে বলছি না, শুধু ডা. টীমের মত ঠান্ডা মাথায় কোনটা জরুরী তা একটু বুঝতে শিখুন। রোগী- হাসপাতাল-প্রাকটিস নিয়ে আপনি অনেক দায়িত্ববান ডাক্তার হতে পারেন কিন্তু দিনশেষে আপনি পরিবারের কাছে একজন বাবা/ একজন মা/ একজন ছেলে/ একজন স্বামী বা একজন স্ত্রী হয়েই ফেরত যান, ডাক্তার হয়ে না।
আমার বাংলাদেশের সব ডাক্তার এবং তার পরিবার সুরক্ষিত থাকুক। ডাক্তার ভালো থাকুক, যেন তার রোগীরা ভালো থাকে।
ডা. তারিক আলম অনি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।
রেজিস্ট্রার, এক্সিডেন্ট এন্ড ইমার্জেন্সী ডিপার্টমেন্ট।
সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড হসপিটাল এন্ড হেলথ সার্ভিস।
কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত ।