এখন আমি পুরোপুরি একজন চিকিৎসক। নিয়মিত ছাত্র পড়াই। আর অবসরে রোগী দেখি। পেশাগত দক্ষতায় আমি না একজন জি পি না একজন বিশেষজ্ঞ। ঠিক মাঝামাঝি আমার অবস্থান। তবে আমার প্রাইভেট প্রাকটিসের আকার যে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের জন্যই ঈর্ষার কারন হতে পারে। তবে প্রসঙ্গ কিন্তু সেটা নয়।
নবম শ্রেনীতে পড়াকালীন আমি সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করি। বরিশাল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিপ্লবী বাংলাদেশের আমি ছিলাম পাবনা প্রতিনিধি। তখনও কিন্তু এদেশে ব্যাঙের ছাতার মত পত্র পত্রিকা গজিয়ে উঠতে শুরু করেনি।
তারপর আমি সাপ্তাহিক হক-কথার সংগে যুক্ত হই। সত্তরের শেষ এবং আশির প্রথম দশক পর্যন্ত আমি যথাক্রমে দৈনিক আযাদ ও দৈনিক দেশ পত্রিকার রাজশাহী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের সংগে সংগে আমার সাংবাদিকতা পেশারও ইতি ঘটে। তবে লেখা লেখির কাজটা ছাড়তে পারিনি। বদ অভ্যাসটা যেন রক্ত মাংসের সংগে মিশে গেছে।
সত্তরের দশক শেষ হয়নি। এ সময়ই প্রকাশিত হয় দৈনিক দেশ পত্রিকা। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। কোন বিতর্কে যাবার প্রয়োজন নেই। তবে এ কথার সত্যতা মেনে নিতেই হবে যে মত প্রকাশের অধিকার ও সুযোগ অবাধ করতে তিনি অনেক পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন। তার সময় বর্তমানের প্রেস ক্লাব এবং প্রেস কাউন্সিল স্থায়ী একটা কাঠামো পায়। প্রকাশিত হয় উত্তারাঞ্ছলের এক মাত্র প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা দৈনিক বার্তা। পরে অবশ্য সাংবাদিক নাম ধারী কিছু দুর্বৃত্ত কাগজের বারোটা বাজিয়ে দেয় -সে কাহিনী রাজশাহীর সচেতন প্রতিটি মানুষ জানে। অথচ তাদেরকে আজকাল প্রায়ই টি ভির পর্দায় দেখা যায়।বড় বড় কথাও বলে।প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায়। এজন্যই বলে চোরের মায়ের বড় গলা।
কথা প্রসংগে এ তথ্যগুলো তুলে ধরলাম। কারন সে সময়ের তরুন একজন সাংবাদিক হিসেবে অর্জনগুলো আমরা চোখে দেখেছি। তা এড়িয়ে যাওয়া বা অস্বীকার করা এক ধরনের পাপ। আমরা জেনে শুনে সে পাপ করতে পারিনা।
কিন্তু সাংবাদিকদের মধ্যে এই দোষ আজ সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে আছে। সত্যকে মিথ্যার সংগে মিশিয়ে প্রচার করতে তাদের কোন জুড়ি নেই।কখনও বা তারা মিথ্যাকে সত্যের উপর স্থান দিয়ে বসে। এজন্য স্থানীয় ভাষায় তাদেরকে প্রায়ই সাংঘাতিক বলা হয়ে থাকে। অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই -তা নয়। তবে এই মুহূর্তে আমার সামনে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং আব্দূস সালাম ব্যতীত অন্য কেউ সামনে নেই।
এবার আমি নিজের কথাটা বলি। আমি তখন সরকারী এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পড়াশুনার কোন চাপ নেই। সেজন্য গ্রামে চলে এসেছি।
আমি তখন দৈনিক দেশ পত্রিকার বেরা থানা প্রতিনিধি। । নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হয় খবর পাঠানোর জন্য। মাধ্যম ছিল পোস্ট কার্ড নয়তো টেলিগ্রাফ। বেতন হিসেবে দু পয়সাও পেতাম না।এখন কারো হয়তো বা দু দশ টাকা জোটে। তবে সামগ্রিক ভাবে মফঃস্বল সাংবাদিকদের করুন দশা আজও আছে যদি না তারা মানুষকে প্রতারনার কৌশল ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে।
দৈনিক দেশ তখন বি এন পির দলীয় মূখপাত্র। আর দলটি শাসন ক্ষমতায়।সে জন্য দৈনিক দেশে প্রকাশিত সংবাদের গুরূত্ব ছিল অপরিসীম। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিয়মিত পত্রিকা দেখতেন এবং নিজে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী বাবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিতেন বলে জনশ্রুতি ছিল। সেজন্য সবাই দৈনিক দেশ পড়তো আর সরকারি কর্মকর্তা হলে তো বটেই।
মনে রাখতে হবে পত্রিকায় প্রকাশের জন্য সংবাদ হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় না। সাংবাদিকদের অনেক সোর্স থাকে। থানা পুলিশ তো আছেই। কিন্তু অনেকের ব্যক্তিগত সোর্স থাকে। আমারও ছিল।
একদিন খবর পেলাম বেরা হাসপাতালে অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটেছে।
কী সে ঘটনা?
এক প্রসুতি এসেছে প্রসব বেদনা নিয়ে। কিন্তু তার কোন অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে না। এমনকি কোন ঔষুধ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। উল্টো একটা ইট বাঁধা রশি তার জরায়ুর সংগে আটকে রাখা হয়েছে। আর মেয়েটা চিৎকার করছে। তার কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে মহিলা ওয়ার্ড।
চিকিৎসকরা এত অমানুষ? তারা কি মাটি ফুটে দুনিয়ায় এসেছে? তাদের কি মা বোন নেই? বড় কোন সমস্যা থাকলে তাকে পাবনার সদর হাসপাতালে পাঠাচ্ছে না কেন?
তারুণ্য আমার সেদিন টগবগিয়ে উঠেছিল। এ অন্যায় মেনে নেয়া যায় না। দ্রূত হাসপাতালে গেলাম। ভুল দেখছি না তো ? চোখ রগরগিয়ে আবার তাকালাম। না, ঠিকই দেখছি। মহিলা ওয়ার্ডের সাত নম্বর বেডে যন্ত্রনায় চিৎকার করছে সালমা নামের মেয়েটা। তার জরায়ূর সংগে রশি বেঁধে ইট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমি অবাক বিস্ময়ে তা দেখছি আর ভাবছি চিকিৎসার নামে এ কেমন নির্মমতা।
হাসপাতালের কোন চিকিৎসক বা অন্য কারো সংগে সালমার অবস্থা নিয়ে কথা বলার কোন প্রয়োজন সেদিন আমার অনুভবে আসেনি। সে রুচিও হয়নি। তবে চিকিৎসা হিসেব জরায়ূর সংগে ইট ঝুলিয়ে রাখার পক্ষে কোন যুক্তি আছে কিনা-সেটা জানার চেস্টা করা আমার উচিত ছিল। কিন্তু আমি তা করিনি। সেটা ছিল আমার জীবনের অতি বড় একটা বার্থতা।সে প্রসংগে পরে বলছি। কিন্তু এখন সালমার সংগে থাকি।
তবে তার প্রতি এই সমবেদনা আমাকে যেন অন্ধ করে দিয়েছিল।
খরচ অনেক বেশী হোল। সংবাদটা টেলিফোনে পাঠালাম। পরদিনের পত্রিকায় চিকিৎসকদের একেবারে তুলধুনা করে লেখা খবরটা এলো। শিরোনামটা আমার দেয়া-কাঁচির বদলে ইট।
নড়েচড়ে উঠলো প্রশাসন। কাঁপলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মন্ত্রনালয়। দেশে তখন রাষ্ট্রপতির শাসন। মন্ত্রিদের কোন মূল্য নেই। নিওগ-বদলির কাজেও আতঙ্ক। দুর্নীতির গন্ধ যেন শরীরে না থাকে। রাষ্ট্রপতি স্বয়ং একজন মুক্তিযোদ্ধা। নিজােকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে তিনি সদা সচেষ্ট।
দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেেছে। অতএব তা আর প্রমানের প্রয়োজন নেই। যা রটে তা বটে। এটা ছিলো তখনকার দৃষ্টিভজ্ঞী। চিকিৎসকদের সকলকে একযোগে বদলী করা হয়েছিল। তাদের কাউকে পত্নিতলায় -কাউকেে পাথরতলায়। অন্য একজনকে বদলি করা হয় বান্দরবনের এক থানায়। আর আদেশে ছিলো তাৎক্ষনিক অবমুক্তি এবং সাত কর্ম দিবসের মধ্যে নুতন কর্মস্থলে যোগদানের কথা।
চিকিৎসকদের একজন তাড়াহুড়ো করে পুরাতন কর্মস্থল ত্যাগ এবং নুতন কর্মস্থলে যোগদান করতে গিয়ে ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন। প্রানে বেঁচে গেলেও তিনি আর চাকুরি করতে পারেননি।
ভাগ্যক্রমে আমিও একদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। উঠলাম পঞ্চম বর্ষে। তখন অধ্যাপক আলতাফ হোসেন ছিলেন প্রসুতি এবং স্ত্রীরোগ বিষয়ের প্রধান। অসম্ভব রাগী মানুষ কিন্তু পড়াতেন খুব ভালো। তার কাছ থেকে জানলাম প্রসুতির অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধ করতে কখনও কখনও বাচ্চার মাথায় একটা অস্ত্র লাগিয়ে সেটার সংগে রশি বাঁধতে হয়। ঝুলিয়ে দিতে হয় এক পাউন্ড ওজনের কোন বস্তু। সেটা ইট হলেও কোন ক্ষতি নেই।এতে প্রসুতির জীবন রক্ষা হয়।
বেরা হাসপাতালের চিকিৎসকবৃন্দ তো সেটাই করেছিলেন। কিন্তু আমরা ভুল বুঝােছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যন্ত কোন তদন্তের প্রয়োজন অনুভব করেনি। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের নিকট কোন কৈফিয়ৎ চাওয়া হয়নি। একটা মিথ্যা আর বায়বীয় অভিযোগে তদন্ত ব্যতীত কাউকে দোষী করে দুর্গম এলাকায় বদলির কাজটা খুবই অনৈতিক হয়েছিল।
অনেকদিন আগের ঘটনা। কিন্তু আজও তা মনে হলে ভীষন যন্ত্রনা অনুভব করি। একটা গ্লানি আমাকে কুঁরে কুঁরে খায়।
একদিন সাংবাদিকতা করেছিলাম। কিন্তু সেটা ছিল আমার জীবনের খুবই কালো আর অভিশপ্ত একটা অধ্যায়।
সালমা একবার রোগী হয়ে আমার কাছে এসেছিল। আমি তার অসুখেের বিস্তারিত শুনেছিলাম। বেরা হাসপাতালে তার যথাযথ চিকিৎসাও হয়েছিল। সেজন্য সে প্রানে বেঁচে যায়। অবশ্য পাবনার সদর হাসপাতালে তার Caesarean Section করতে হয়েছিল।
লিখেছেন:
ডা. শামীম হুসাইন
সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন)
শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ