–নামটা বলেন..
–কোয়ান্টাম ফরিদ
–কি ফরিদ?
–কোয়ান্টাম ফরিদ…
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কথা শুনেছি, কোয়ান্টাম রসায়নের কথাও শোনা হয়েছে, কিন্তু কোন একদিন চোখের সামনে কোয়ান্টাম ফরিদ নামে জলজ্যান্ত কাউকে দেখতে হবে ও তার কথা শুনতে হবে-সেটা ছিলো আমার ধারণারও বাইরে…
তিনি বোধ হয় আমার ইতস্তত ভাবটা ধরতে পারলেন, চশমার উপরের ফাঁকা দিয়ে তীর্যকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে জানালেন যে আধ্যাত্নিকতার একটা জটিল কোর্স নাকি তিনি সম্পন্ন করেছেন এবং যারা এই কোর্স সম্পন্ন করে তারা অনেকেই নামের আগে কোয়ান্টাম উপাধিটা যোগ করে নেয়।উনি গড়গড় করে আরো কথা বলা শুরু করতে যাচ্ছিলেন, আমাকে থামাতে হলো। প্রেসক্রিপশনে রোগীর নামের জায়গায় লিখলাম ‘কোয়ান্টাম ফরিদ’…
–এবার সমস্যাটা বলেন..
–সমিস্যা তেমন কিছু না।জ্বর ছিলো, এখন প্রেসার কম…
–আপনি তো বেশ ভালোই আছেন , পটরপটর কথাও বলছেন, প্রেসার কম বলে তো মনে হচ্ছে না…
–আরে ভাই, রোগী তো আমি না…
–আরে যন্ত্রনা! রোগী কে?
–রোগী আমার স্ত্রী, সে বাইরে আছে…
–কি বিপদ! তারে বাইরে বসায় রাখছেন কেনো! তাকে নিয়ে আসেন…
আমি মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম।প্রেসক্রিপশনটা ছিড়ে বাস্কেটে ফেললাম। এই বঙ্গ ভান্ডারের চিপায় চিপায় কত ধরণের মানুষ যে আছে আল্লাহই জানে, নামের আগে আবার যোগ করেছে ‘কোয়ান্টাম’ ! ছাগলা কাহিকা…
রোগীকে নিয়ে আসা হলো। বছর ত্রিশেক হবে। রোগীর আসলেই হালুয়া টাইট দশা, ঠিকমত হাঁটতেও পারছেন না, আজ সকালেও নাকি তীব্র জ্বর ছিলো। এখন প্রেসার আসলেই কম…
এই বছর জ্বরের পর প্রেসার কমে গেলেই একটু টেনশন লাগে, যে কয়টা এই ধরণের রোগী পেয়েছি–সবগুলোই শেষমেশ ডেঙ্গু হিসেবে ধরা দিয়েছে।টর্নিকোয়েট টেস্ট বলে বেড সাইড একটা পরীক্ষা করলাম, সেটাও দেখি পজিটিভ। প্রেসক্রিপশনে ডায়াগনোসিস এর জায়গায় Dengue shock syndrome লিখে একটা কোয়েশ্চেন মার্ক দিয়ে রাখলাম।চিকিৎসার জায়গায় লিখলামঃ Hospital Admission, ডেঙ্গু সংক্রান্ত দুই-তিনটা ইমিডিয়েট পরীক্ষার কথাও লিখলাম…
কোয়ান্টাম সাহেবকে কথাগুলো বুঝিয়ে বলে প্রেসক্রিপশনটা তার দিকে এগিয়ে দিতেই তিনি সেটা হাতে নিয়ে ডিটেকটিভের মত প্রেসক্রিপশনটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলেন। দেখা শেষে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলা শুরু করলেন, কথোপকথন নিম্নরূপঃ…
–এইটা কেমন চিকিৎসা! ওষুধ কই?
–রোগী বেশ সিরিয়াস, হাসপাতালে আগে ভর্তি করেন, তারাই ওষুধের ব্যবস্থা করবে…
–হাসপাতালে ভর্তি আবার কিসের লাগি? প্রেসার কইমা গেছে-একটু স্যালাইন-ট্যালাইন দেন, ডিম-টিম খাইয়া দেহুক, দুয়েকটা অ্যান্টিবায়োটিক দেন, তাইলেই তো হয়…
ডাক্তার হওয়ার কিছু সমস্যা আছে।তীব্র রাগ হলেও মুখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে বসে থাকতে হয়। আমি রাগকে কন্ট্রোল করলাম, শান্ত ভঙ্গিতে বললাম..
–কোয়ান্টাম সাহেব, আপনার সাথে চিকিৎসা সংক্রান্ত কথাবার্তা আমার এখানেই শেষ
–ইয়ে, ডাক্তার সাহেব পাশ করছেন কোন মেডিকেল থাইকা? বুঝেন তো, এখন আবার আনাচে কানাচে আউল-ফাউল মেডিকেলে ভর্তি…
আমি কোন মেডিকেল থেকে পাশ করেছি-সেটা প্রেসক্রিপশনে লেখা আছে, কোয়ান্টাম সাহেবের নজরে পড়ার কথা, এরপরও খোঁচানোর কোন কারণ দেখি না।”পেচাইল্লা” লোকের ফাতরা টাইপ কথাবার্তায় অংশগ্রহণ করে নিজের মনকে দূষিত করার কোন অর্থ হয় না। মনকে ডাইভার্ট করার চেষ্টা করলাম, আমার হাতে যে কলমটা রয়েছে সেটার খোলসটা এক ধরণের স্বচ্ছ প্লাস্টিকে তৈরি, আলোর প্রতিফলন-প্রতিসরণে সেখানে রংধনু খেলা করছে–সেটায় মনোযোগ দিলাম…
উনি আবার কথা বলে উঠলেনঃ ডাক্তার সাহেব দেখি কথা বন্ধ কইরা দিলেন। ভিজিটের টাকা কি দিতে হইব? ওষুধ তো কিছু লিখেন নাই…
আমি রংধনুর দিকে তাকিয়ে থেকেই বললাম যে ভিজিটের টাকা দিতে হবে না…
কোয়ান্টাম সাহেব তার কোঁকানো স্ত্রীকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। যাবার আগে আমার চেম্বারের বাইরে ফার্মেসীওয়ালাকে বলে গেলেন যে আমি একটা ‘বদ’ ডাক্তার, কথা বললে কথার উত্তর নাই, এসব কারণেই উনি নাকি সবসময় প্রফেসর ডাক্তার দেখান, খামোখা সময় নষ্ট। সবসময় প্রফেসর দেখানো কোয়ান্টাম সাহেব এবার অবশ্য যাবার আগে ফার্মেসীওয়ালার সাথে পরামর্শ করে তার স্ত্রীর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক কিনে নিয়ে গেলেন…
তার ২ দিন পরের ঘটনা। ব্লু-টুথ স্পিকারে মোহনীয় অটোম্যান সাম্রাজ্যের মিউজিক শুনছি, বেশ ধীর লয়ের মিউজিক, এমন সময় মোবাইলে ফার্মেসীওয়ালার ফোনঃ
–স্যার, আপনে কোথায়?
–এইতো বাসায়, কেনো?
–ওই লোক তো আপনেরে হারিকেন দিয়া খুঁজতেছে…
–কোন লোক?
–ঐ যে আপনেরে বদ ডাক্তার কইছিলো। হের বউ তো আইসিইউ তে ভর্তি, ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। আপনার সাথে ‘পরামিশ’ করতে চায়…
–আমার সাথে ‘পরামিশ’ করার কিছু নাই, যেখানে ভর্তি সেখানকার ডাক্তারের সাথে ‘পরামিশ’ করতে বলেন…..
আমি ফোন কেটে দিলাম…
চিকিৎসক হবার পথে একজন মানুষকে বছরের পর বছর কত বিনিদ্র রজনী পার করতে হয়, সেটা আমি জানি। সেই ডেডিকেশনকে অবজ্ঞা করে যারা নিজের বিপদকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসে–তাদের প্রতি করুণা করার অর্থ হয় না। আমি আবার অটোম্যান সাম্রাজ্যের মিউজিকে হারিয়ে গেলাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাজী নজরুল ইসলাম অটোম্যান সাম্রাজ্যের এই মিউজিক দিয়ে বেশ প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন, রচিত হয়েছিলো বিখ্যাত সেই গজলঃ
“ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ..
এলো রে দুনিয়ায়…
আয় রে সাগর আকাশ বাতাস…
দেখবি যদি আয়…”
ডা. জামান অ্যালেক্স
জনপ্রিয় চিকিৎসক ও কলামিস্ট।