হরর সিরিজঃ ০১
ডিসক্লেইমারঃ এই গল্পের ঘটনা ৮০% সত্যি।মূল চরিত্র,তিনি নিজেই আমাকে এই গল্প বলেছেন।সঙ্গত কারণেই কোন স্থান কাল উল্লেখ করা হলো না,কিন্তু মূল চরিত্রের নাম রাখা হয়েছে অবিকৃত।
ক্যান্ডি ফ্লস
———–
অনেক রাত,তিনটা বেজে পনেরো,টেবিল ঘড়ির দিকে আলগোছে একবার তাকিয়ে আবার পড়ায় মনযোগ দেয় তুলি।ঘুম আসছে তার,কিন্তু যার দু’দিন বাদে ফাইনাল প্রফ,তার ঘুমের মতো ইন্দ্রিয়গত ব্যাপারগুলোকে পাত্তা দিলে চলে না।মাথা ঝুকিয়ে আবারো মেডিসিনের বইটায় ডুবে গেল সে।
আরো খানিকক্ষণ পর,আবার মাথা তুলে ঘড়ি দেখলো,রাত তিনটা ত্রিশ।মাত্র পনেরো মিনিট,অথচ মনে হচ্ছে না জানি কতো ঘন্টা পার করেছে শেষবার ঘড়ি দেখার পর।হাই আসছে,শরীর ভেঙে আসছে অবসাদে।বই বন্ধ করে পুরো রুমে চোখ ঘুরিয়ে নিল তুলি।সে থাকে হলরুমে,প্রায় চল্লিশ জন মেয়ে এখানে একসাথে থাকে।সারি সারি স্টিলের খাট পাতা,এখানেই,ছোট্ট করে চল্লিশজন মেয়ের চল্লিশটা সংসার।সে,আর একটা মেয়ে বাদে আর কেউ জেগে নেই।সে ও টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে।তার খাটটা একেবারে বারান্দার পাশে।ভালোই লাগে তুলির,পাশেই বিশাল জানালা দিয়ে মাঝেমধ্যে সে আকাশে উকি দেয়।আর বারান্দার দরজা খোলা থাকলে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়,টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে শুধু রহস্যময় অন্ধকার জমা হয়ে থাকে।
আর পাড়ছে না,এবার ওঠা দরকার,নিজেকেই নিজে বলে যেন।একমাত্র জেগে থাকা মেয়েটাকে একটু ডেকে গল্প করবে নাকি?না থাক,কি দরকার।পড়ছে পড়ুক।এর চেয়ে বরং নিজেকে একটু সময় দেয়া যাক।বারান্দায় যেয়ে কিছুক্ষণ আকাশ দেখবে বলে ভাবলো তুলি,তারা ভরা আকাশ কেন জানি তাকে খুব টানে।মনে হয় আর কেউ থাক বা না থাক,এই অনন্ত নক্ষত্রবীথি তার সঙ্গী হয়ে থাকবে আজীবন।
খাট থেকে এক পা ফেলতে যাবে,হঠাৎ আবার চোখ চলে যায় বারান্দার দূরতম অন্ধকার কোণে।প্রচণ্ড আতঙ্কে জমে যায় তুলি,এখন সেখানে শুধু অন্ধকার না,সেখানে কি যেন একটা আবছা আলোর উপস্থিতি।ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে অবয়বটা,আরো কাছে আসায় এবার প্রায় পুরোটা বোঝা যাচ্ছে।অবয়বটা অনেকটা মানুষের মতো,কিন্তু পুরো মানুষ না।যেন হাওয়ায় ভেসে আসছে একটা ক্যান্ডি ফ্লসের পুতুল,ধোয়া ধোয়া আবছা আলোটুকুই যার অস্তিত্ব।চিৎকার করতে চাচ্ছে তুলি প্রাণপণে,কিন্তু গলায় কোন জোর পাচ্ছে না।অদৃশ্য কোন হাত যেন তার বুকে উঠে গলা চেপে আওয়াজ করার শক্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে।স্থাণু হয়ে বসে থেকে সেই অদ্ভুত আলোছায়ার পুতুলটাকে আরো এগিয়ে আসতে দেখে তুলি।আরো,আরো কাছে এগিয়ে আসে।সেই অবয়বে এখন একটা মুখের অস্তিত্ব,চোখ মুখগুলো যার যার জায়গায় বসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে,কিন্তু পারছে কই?একটু পর পরই ধোয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে,আবার এসে আকৃতি নেবার চেষ্টা করছে একটা মানুষের মুখের মতো।আর কিছু বোঝা না গেলেও চোখগুলো ঠিক বোঝা যাচ্ছে,এক্কেবারে লাল টকটকে,কেমন বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে।
অবয়বটা এবার ঘরে ঢুকে পড়ে।তুলির বিছানার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ায়।ধোয়া ধোয়া সেই অবয়বের সামনে সম্মোহিতার মতো অসহায় হয়ে বসে রইলো সে।ধোয়ার মধ্যে দিয়ে অপর পাশের দেয়ালে ঝোলানো রেডিয়ামের চাঁদ তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে।অবয়বটা হঠাৎ আবার নড়ে ওঠে।আকৃতিহীন দেহ থেকে একটা হাত বেড়িয়ে আসতে শুরু করে।সেই ধোঁয়াটে হাত ধীরে ধীরে সামনে বাড়তে থাকে,তারপর একসময় তুলির গলার দিকে এগিয়ে যায়।
তুলির হঠাৎ সব স্বপ্ন মনে হতে থাকে।স্বপ্নই তো,তাই না?নইলে এই রাতে,চল্লিশজন মেয়ের ঘরে সবাইকে বাদ দিয়ে কেনই বা তার কাছে এমন অশুভ কিছুর অস্তিত্ব প্রকাশ পাবে?ওই তো,ওই যে মেয়েটা তখন পড়ছিলো টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে,এখনো তো সে পড়েই যাচ্ছে।এতো বাস্তবতার মাঝে এমন অবাস্তবের অস্তিত্ব কোথায়?তাহলে রেডিয়ামের জ্বলজ্বলে সবুজ রঙ?স্বপ্নে কি রঙ দেখা যায় নাকি?স্বপ্ন নাকি সাদাকালো হয়?ফ্রয়েড যেন কি বলেছিলেন?
ধড়মড় করে জেগে ওঠে তুলি।চোখ মেলেই সবার আগে সামনের দিকে তাকায়,নাহ,সেখানে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই এখন আর।সকালের মিষ্টি রোদ তাদের হলঘরটাকে একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।বাইরে পাখির কিচিরমিচির চলছে সমানতালে-যেন কে কার চেয়ে কতো বেশি কলরব করতে পারে।এই ঝকঝকে রোদের আলোয়,চারপাশের শোরগোলের মাঝে রাতের স্বপ্নটাকে একেবারে হাস্যকর মনে হতে থাকে।উফ বাবা,কি ভয়টাই না পেয়েছিলো রাতে সে!আর এখন,ইচ্ছে করছে সেই অবয়বটার একটা নাম দিয়ে ফেলতে।কি নাম দেবে-ক্যান্ডি ফ্লস?দূর,কি সব চিন্তাভাবনা যে তার!এখন এইসব ভাবার সময়?আশেপাশের বেডের দিকে তাকালো,অনেকেই উঠে গেছে,কেউ উঠবো উঠবো করছে,শুধু তার মতো জেগে থাকা সেই মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে এখনো।এবার সে নিশ্চিত,স্বপ্নই দেখেছিলো সে।ভাগ্যিস চিৎকার দেয়নি।দিলে আজ সকালে সবাই কি হাসাহাসিটাই না করতো তাকে নিয়ে।নিজের মনেই ফিক করে হেসে দিলো তুলি।এবার ওঠা উচিৎ,পড়া শুরু করতে হবে;নিজেকেই নিজে তাড়া দিলো তুলি।পরীক্ষার আর মাত্র দুইদিন বাকি।
ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাত মাজতে মাজতে বেসিনের সামনে যেয়ে দাঁড়ায় তুলি।হঠাৎই,মুখ ধুতে যেয়ে গলার দিকে চোখ যায় তার।একটা লালচে দাগের মতো ফুটে উঠেছে তার গলায়।খুব হাল্কা,কিন্তু বোঝা যাচ্ছে,কিছু একটা তার গলা যেন চেপে ধরেছিলো খুব শক্ত করে,আর তাতেই দাগটা পড়ে গেছে।বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে তুলি,খুব দ্বিধা নিয়ে আয়নায় তাকিয়ে হাত দেয় গলায়।নাহ,কোন ব্যাথা বা অন্য কোন অনুভূতি নেই সেখানে,শুধু লাল দাগটা একটা হাতের ছাপের মতো আকৃতি নিয়ে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে।জোরে জোরে ডলে তুলে ফেলার চেষ্টা করে তুলি।উঠলো তো না ই,বরং আরো লাল হয়ে যাচ্ছে কেমন যেন।
এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাক দেয় তাকে,সেই মেয়েটা,সারা রাত পড়ে এখন এতো বেলায় ঘুম ভেঙেছে তার।ব্রাশ হাতে দাঁড়িয়ে আছে,মুখ ধোবে,তুলির জন্য পারছে না।এই আচমকা ডাকে ঝট করে পেছনে ফেরে তুলি,মেয়েটা তুলিকে দেখেই কেমন যেন হতচকিয়ে যায়।
জিজ্ঞেস করে,
“কিরে তুলি,তোর গলায় কি হয়েছে,এমন লাল হয়ে আছে কেন?আর সারা রাত ঘুমাসনি নাকি?তোর চোখ দেখি এক্কেবারে টকটকা লাল।”
তুলি অনেক দূরে কোথায় যেন এক অশরীরী অট্টহাসি শুনতে পায়।কেউ যেন তার কানে কানে এসে বলে যায়,
“আমি এসেছিলাম,আমি আবার আসবো,আবার….”
লেখকঃ
ডা. বেলায়েত হোসেন
শাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ
০২ ব্যাচ