‘একটা বেনসনের দাম কত’?
“নয় টাকা”
‘ঢাকায় একঘন্টা ইলেক্ট্রিকের রিকশায় ঘুরলে কত খরচ হবে’?
“একশ বিশ-একশ চল্লিশ”
‘আপনার বেতন কত’?
“বেতন কিসের ছোট ভাই? চার বছরের ট্রেইনিং, দৈনিক ১২-১৬ঘন্টা কাজ করেছি বিনা পয়সায় আর তুমি জানতে চাও বেতনের কথা”?
সাংবাদিকদের উপর চিকিৎসকদের হঠাৎ চড়াও হবার কারণ লিখতে গিয়ে প্রথমে জানিয়ে রাখি বাংলাদেশের সিংহভাগ চিকিৎসক কত অসহায় । এতটাই নিরীহ যারা বিনা অভিযোগে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে এতকাল ধরে, তারা হঠাৎ সাংবাদিকদের উপর মারমুখী হল কেন? কারাই বা হলো ? গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পাঠ্যক্রম হিসেবে স্বীকৃত এমবিবিএসের পাঁচ বছর অতিক্রম করে এসে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকেরা দুর্মূল্যের বাজারে মুষ্ঠি ভিক্ষার মত দশ হাজার টাকা ভাতা পায়(বেসরকারী মেডিকেলে আরো কম) । তারপরেও যারা সবটুকু আন্তরিকতা নিয়ে দিনরাত রোগীদের সেবা দেয় তারা কেন বিস্ফোরণ্মুখ হল? দু’টাকা পাঁচ টাকার একটু ছোটলোকি হিসেব কষে নেই তার আগে । ঢাকার যে কোন ক্লিনিকে ৮ঘন্টার দুষ্প্রাপ্য ডিউটিতে সম্মানী ৫০০-৮০০টাকা যেখানে অন্যান্য কাজ ছাড়াও সকাল বিকেল নূন্যতম ২০জন রোগীকে দিতে হয়, যাঁদের প্রত্যেককে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রতি ফলোয়াপের জন্য চার্জ কাটে ২০০-৪০০টাকা । হিসেব করে দেখেন ক্লিনিক ব্যবসায়ীর মুনাফা, ডিউটি ডাক্তারের সাথে আপনি এবং এটেন্ডেন্টদের আচরণ,বড় স্যার দেরি করে আসায় কত বার তাগাদা দেন,বড় স্যারই বা এসে রোগীর সামনে কতটা কটাক্ষ করে কটা টাকার বিনিময়ে । সেই একই ডাক্তার হাসিমুখে সেবা দেয় সরকারী হাসপাতালে । বিসিএস দিয়ে সরকারী চাকরীর প্রথম বেসিক বেতন ১১,৯৮০ সাকল্যে ১৭,৩১০ । নিজ জেলায় পোস্টিং, বেতন-ভাতা উত্তোলন,ফাউন্ডেশন/EOC,সরকারের এটা-ওটা ট্রেনিং, শিক্ষাছুটি, ডেপুটেশনের জন্য লক্ষ টাকার ঘুষ, উপজেলার তৃতীয় শ্রেণীর একাউন্ট অফিসার বা ডিজি হেলথের কেরাণীর চামড়ার স্যান্ডেলে আত্মসম্মান কপাল ঠুকে আসতে হয় ।
চিকিৎসকের উপর গণ অসন্তোষের মূল কারণ চিকিৎসক তাঁর পারিশ্রমিক সরাসরি রোগীর হাত থেকে নেন-চিকিৎসককে কসাই বলার কারণ ও এটাই(পরের কোন লেখায় ইনভেস্টিগেশন/অপ্রয়োজনীয় ঔষধের কথা লিখবো)। আর্থিক কারণে চিকিৎসকের উপর সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ তার সাথে ৮০% চিকিৎসক কোন অবস্থাতেই জড়িত নন কারণ শিক্ষানবিশ চিকিৎসক/অনারারী মেডিকেল অফিসারদের হাতে টাকা নেবার বা রোগীর সাথে দূর্ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল পরীক্ষা দেয়াও সম্ভব নয় উর্ধ্বতন চিকিৎসকদের অনুমতি ছাড়া ।
শুধু অর্জিত জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ, উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে এবং অবশ্যই ২৫-২৬ বছরের একজন দায়িত্বশীল মানুষ তার পরিবারসহ খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে নবীন চিকিৎসকেরা এ সংগ্রাম করে ।আমাদের সমাজে তাদের এ অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া হয় না(চিকিৎসকেরা তা আশা ও করে না শুধু অসম্মান না করলেই হয়) । আর্থিক দৈন্য, পেশাগত গোষ্ঠীর নিম্নতম ধাপের যন্ত্রণা, অনিশ্চিত ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত হতাশার বিপরীতে তাকে SIMPLE MBBS বলে হেয় করা হয় । মাঠপর্যায়ে সিনিয়র চিকিৎসকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন, স্বাস্থ্য সেবার সব ব্যর্থতার দায় বর্তায় তাদের উপর । ব্যাক্তিগতভাবে দোষী না হয়েও সিস্টেমের অন্তর্নিহিত সমস্যা যখন ভুল/দূর্ঘটনার জন্ম দেয় চিকিৎসক তখন একা দায়ী হন । স্থানীয় পাতি নেতাদের হুমকী ধামকী, নিরাপত্তাহীনতা, প্রশাসন যন্ত্রের বড়কর্তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, ইতর কর্পোরেট মিডিয়াগুলোর বাণিজ্যিক লাভে নেতিবাচক প্রচারণা পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তোলে । চিকিৎসকদের ঘাম টাকার মূল্যে কেনা যায় না, কিন্তু শ্রদ্ধা, আত্মসম্মানের উপর আঘাত কোন পেশাজীবীই সহ্য করবে না ।
চিকিৎসকদের সুবিধা-অসুবিধা বিপদে আপদে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না, তারা শুধু অপমানিত হন, মানসিকভাবে দিনের পর দিন বিপর্যস্ত থাকেন । তার আত্মসম্মান বোধ তাকে একা করে দেয়, অভিভাবক সংস্থা/নিয়ন্ত্রকদের নির্লজ্জ উদাসীনতা তাকে ভেতরে ভেতরে সর্বদা অপরাধী রাখে । কেউ নীরবে চাকরী ছাড়েন, প্রথম সুযোগে বিদেশে পাড়ি জমান কেউ কেউ,গ্লানি-মানসিক টানাপোড়েনে কুলিয়ে উঠতে না পেরে অভিমানে আত্মহত্যা করেন, কারো নাম উঠে অপমৃত্যু বা খুনের তাকিলায় । তবুও প্রশাসন শুভাকাঙ্ক্ষী হয় না, চিকিৎসকদের মাননীয় নেতা জনপ্রিয় স্টান্টবাজি করেন, এ সমাজের অংশ হয়েও মিডিয়া আমাদের কথা বলে না, সহানুভূতি দূরে থাক নেতিবাচক প্রচারণা চালায় ।
ছাই চাপা আগুনের মত ক্ষোভ বুকের ভেতর জমতে থাকে, ডাঃ সাজিয়া আপা ক্লিনিকে ডিউটি করতে গিয়ে নিহত হন,সে অমানুষের ফাঁসির আদেশ ও দেয় বিজ্ঞ আদালত কিন্তু আমাদের মিডিয়া নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের হয়ে সাফাই গায় । অথচ তার মাত্র কয়েক মাস পর ভারতে এক প্যারা মেডিকেল শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হলে আমাদের মিডিয়া ঘন্টায় ঘন্টায় মায়া কান্না কাঁদে । কারণ একটাই ওই সংবাদটি বিশ্ব মিডিয়ার কল্যাণে লোকে খাবে । একই ভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে হেলথ ক্যাম্পে ডাঃ মুরাদ নিহত হলে আবারো সে সংবাদ এড়িয়ে যায় আমাদের মিডিয়া, এবারো নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নেয় তারা ।মানবাধিকার দিবসে সাদা এপ্রন পুলিশের বুটে লাঠিতে লালে লাল হয়, তবুও পুরোপুরি বানোয়াট খবর ছাপে এবং তাদের মিথ্যে খবরই বার বার রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয় । মেডিকেল কলেজগুলোর ইন্টার্নি চিকিৎসকদের উপর নানা সময় অন্যায় হামলা হলে প্রতিবারই তারা জনদুর্ভোগের ধোয়া তুলে প্রকৃত ঘটনা থেকে সাধারণ মানুষের মনযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দেয় । যে দিন থেকে বাংলাদেশে ফাইভ স্টার হাসপাতাল হয়েছে,যেদিন থেকে ভারত, মালয়শিয়া, চীন,ব্যংকক বাংলাদেশ থেকে রোগী ধরতে ব্যব্যসা পেতেছে সেদিন থেকে দালালী করছে এই মিডিয়া । দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে ধ্বংসে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে, তৈরি করছে সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট । তার সর্বশেষ নমুনা বারডেম হাসপাতাল । দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন রোগীর মৃত্যু হলে রোগীর প্রভাবশালী আত্মীয় স্বজন যখন হাসপাতালের সহাকারী অধ্যাপক,মহিলা চিকিৎসক সহ চারজন চিকিৎসককে মারধোর করেছে চার ঘন্টা ধরে,তার প্রতিবাদের সারাদেশের চিকিৎসক বিক্ষোভ করলে, মিডিয়াগুলো মিথ্যে খবর ফাঁদে-যে এই বিক্ষোভ ভুল চিকিৎসা বা দায়িত্ব অবহেলার দায় এড়াতে করা হয়েছে । মিডিয়াগুলোর নগ্ন মিথ্যা সাধারণ চিকিৎসকদের দৃষ্টি এড়ায় না,অন্যান্য চিকিৎসক আন্দোলনের মত বারডেমের ঘটনা আমাদের আইনসংগত কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দিলেও মিডিয়ার প্রতি আমাদের অবিশ্বাস মন থেকে দূর করতে পারে না । এই মিডিয়াই কিছু দিন পর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে অধ্যাপকের ভুল ধরতে যায়,ফলাফল অপ্রীতিকর ঘটনাবলী । তবুও মিথ্যার চাষ, দালালী থামেনা মিডিয়ার-রাজশাহী মেডিকেল কলেজে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়াতে জীবত সুস্থ্য রোগীকে মৃত বলে মিডিয়ায় প্রচার করে । মিডিয়ার প্রতি এত দিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ।
না স্বজাতিকে JUSTIFY করতে লিখছি না, আমি কেবল দীর্ঘশ্বাসগুলোকে শব্দে পরিণত করছি । নবীন চিকিৎসকেরা মানুষ, দেবতা নন, তাদের ত্রুটি বিচ্যুতি আছে । তবে সাংবাদিকদের মত পত্রিকার কাটতি বাড়াতে, চ্যানেলের দর্শক বাড়াতে অথবা কর্পোরেট-বিদেশী হাসপাতালের দালালী করতে গিয়ে ইচ্ছেকৃত শয়তানী ছড়ায় না, দেশের দরিদ্র মানুষদের ভারত/ব্যাঙ্কক হাসপাতালের গ্রাহক বানাতে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে যায় না, জনগণের শত্রু হিসেবে বিজ্ঞাপন দেয় না ।
চিকিৎসকের সাথে সাংবাদিক, সুশীল সুবিধাবাদীদের সাথে চিকিৎসকদের রেষারেষি কোন অবস্থাতেই কাম্য না । আপনার বৃদ্ধ পিতার ক্ষয়ে যাওয়া মাংসে স্নেহের পরশ বুলাই আমরাই, আপনার আকাঙ্ক্ষিত নবজাতককেও প্রথম স্পর্শ করি অনেক যত্ন নিয়ে । শ্রদ্ধা, আত্মসম্মানের জায়গাটা অহংবোধ আর দালালীর জন্য নষ্ট করবেন না ।
দাবী নয় সমাধানের পথ-১)চিকিৎসা-স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক রিপোর্টিং করবেন নূন্যতম একজন
গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক
২)চিকিৎসকদের ভুল ধরার আইনগত এখতিয়ার রাখেন একজন
নূন্যতম নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
৩)বাংলাদেশের যে কোন হাসপাতালের সংবাদ সংগ্রহের জন্য
হাসপাতালে প্রবেশের পূর্বে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে ।
বাংলাদেশের চিকিৎসক , বাংলাদেশের মানুষ সকল মিথ্যার বিরুদ্ধে এক হও ।
বাংলাদেশের চিকিৎসক এক হও ।
সেই সাথে সরকারী ডাক্তারদের তাদের কর্ম এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করতে হবে যেকোন বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ।