প্ল্যাটফর্ম সাহিত্য সপ্তাহ -১৩
গল্পটা ভূতেদেরঃ
রাত বারোটা বেজে পাচ।বেল বাজিয়ে সিরিয়াল দেয়ার ছেলেটাকে ডাকলাম।
‘এই নওশাদ দেখোতো,আর কয়জন আছে বাইরে?আমার আজ আর ভাল্লাগছে না একদম।’
নওশাদ বাইরে উকি মেরে জানালো,
“স্যার,আর মাত্র তিনজন রুগী আছেন বাইরে।”
‘তিনজন?মানে কি?তুমি না বললে এরপরের জনই শেষ রুগী?এখন তিনজন হলো কেমন করে?’
খুব রাগ হয় আমার।ছেলেটা রোজ এই কাজ করে,রুগীর কাছে থেকে দুই একশ টাকা নিয়ে সবার শেষে সিরিয়ালের বাইরে কয়েকজনকে ঢুকিয়ে দেয়।
‘তুমি আজকেও একই কাজ করেছো,তাই না?সিরিয়ালের বাইরে আজকেও রুগী রেখেছো?কাল থেকে তুমি আর আসবে না,আমি অন্য কাউকে নেবো।’
নওশাদের কোন ভাবান্তর হলো বলে মনে হয় না।নির্বিকার গলায় বললো,
“একটু কষ্ট করে দেখে দেন স্যার।অনেক দূর থেকে আসে স্যার,না করতে খারাপ লাগে।”
রাগে গজগজ করতে করতে রোগী ভেতরে পাঠাতে বললাম।প্রথম দুইজন রোগী দেখতে দেখতে কখন যে আধাঘণ্টা পার হয়েছে,টেরই পাইনি।শেষ রুগীটা ঢোকার আগে তাই দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে আতকে উঠলাম,
“সাড়ে বারোটা পার।আজকে বাসায় গেলে খবর আছে নিশ্চিত।”
স্বগতোক্তি করতে করতেই ভেতরে সবশেষ রুগীর প্রবেশ।
রুগী তার বাবা মা’র কোলে চেপে এসেছেন এবং তারস্বরে চেচিয়ে যাচ্ছেন।বাবা মা তার এই চিৎকারে যথেষ্ট বিব্রত।আমি পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য নিজেই দাঁড়িয়ে গেলাম,হাত দিয়ে চেয়ার দেখিয়ে বললাম,
‘প্লিজ বসুন।’
বাবা;ভদ্রলোক এই দেশের পরিপ্রেক্ষিতেও যথেষ্ট লম্বা এবং ফর্সা,মাথায় চুলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে সামনের দিকে ইতিমধ্যেই।মাঝারি সাইকের একটা ভূড়ি,সাথে চোখে গোল্ড রিমের চশমা-চেহারা যথেষ্ট অভিজাত।ভদ্রমহিলাও তেমন,রুচিসম্মত পোশাক আর পরিপাটি সাজ-তাকেও একইরকম আভিজাত্য এনে দিয়েছে।
ভদ্রলোক মুখ কাচুমাচু করে বলতে শুরু করলেন,
“স্যার,এতো রাতে আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য আমি দুঃখিত।আপনার সিরিয়ালের ছেলেটা অবশ্য বারবার বলছিলো যে আপনি আজ আর রোগী দেখবেন না।কিন্তু এতো দূর থেকে এসে ফিরে যেতে মন সায় দিলো না।তাছাড়া বাচ্চাটাও অসুস্থ খুব।দেখছেন না,সেই কখন থেকে কেদেই যাচ্ছে একটানা।কি হয়ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।”
আমি ভদ্রলোক কে থামিয়ে বললাম,
‘না না,ঠিক আছে।তেমন সমস্যা হবে না আমার।কি হয়েছে আপনাদের ছেলের?কখন থেকে এতো কাদছে?’
“স্যার আজ সন্ধ্যা থেকেই,এবং বিরতিহীন ভাবে।এর আগেও ওর পেটে ব্যাথা হলে এমন কান্না করতো,একজন ডাক্তার সাহেব কিছু ঔষধ দিয়েছিলেন,খাওয়ালে কিছুক্ষণ পর থেকে যেত।কিন্তু স্যার আজ কিছুতেই ওর কান্না থামছে না,ঔষধ খাইয়েছি,কাজ হচ্ছে না।মনে হচ্ছে পেটে ব্যাথা আবার বেড়েছে।কি যে করি স্যার।ভয় হচ্ছে।”
মা “না না বাবু কাদে না,কি হয়েছে আমার ময়না পাখিটার” এই সেই বলে নানা বুঝিয়ে কান্না থামাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন,কিন্তু বাচ্চা থামছে কই?
বাচ্চাটাকে দেখলাম।ভালোভাবে,সময় নিয়ে পরীক্ষা করলাম।তেমন এবনরমাল কিছুই চোখে পড়লো না।আগের দেয়া চিকিৎসা দেখলাম।তিনিও ভালোই ঔষধ দিয়েছিলেন,কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার,উনি যা পরীক্ষা দিয়েছিলেন,তার কিছুই তারা করাননি।
জানতে চাইলাম,
‘কি ব্যাপার,কোন পরীক্ষা করাননি যে?পরীক্ষা না করালে তো কিছু বোঝা যাবে না।’
আমার প্রশ্নে বাবা মা দুইজনই বিব্রতভাবে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না।নতুন কিছু ঔষধ আর পরীক্ষা লিখে দিলাম।আর সাথে একটা ঔষধ চেম্বারে বসেই মুখে খাইয়ে দিলাম,বললাম,
‘এই ঔষধটা খাইয়ে দিলাম,দেখবেন খুব তাড়াতাড়ি ব্যাথা কমে যাবে।আর কিছু পরীক্ষা লিখে দিয়েছি,এগুলো কিন্তু করাতেই হবে।না হলে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না আপনার বাচ্চার কি হয়েছে।’
বাচ্চার কান্না বেড়েই চলেছে।আমার এবার কপাল কুঁচকে গেলো।এতক্ষণ কেন কাদবে?একটুও কি ব্যাথা কমেনি?নাকি পেটে ব্যাথাই নেই,সমস্যা অন্য কোথাও?
মা ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছেন কান্না থামাবার।কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
এবার আমি নিজেই খানিকটা বিব্রত।
‘এভাবেই কাদে নাকি ও?কিছুতেই দেখি কান্না বন্ধ হচ্ছে না।আপনারা নিশ্চিত,ওর পেটেই ব্যাথা?’
মা এবার কথা বললেন।
“এমন করে তো কখনো কাদে না।আসলে স্যার,ওর কান্না এভাবে থামবে না।”
‘তো কিভাবে থামবে?’
এবার বাবা মুখ তুলে তাকালেন।
“স্যার,ও আসলে ইচ্ছে করে কান্না থামাচ্ছে না।দুপুরে একটা জিনিস খাবার আবদার করেছিলো,দিইনি,তাই এখন জিদ করে কাঁদছে।”
‘কি খেতে চাইছে?আমাকে বলেন,আমি দেখি আমার সিরিয়াল দেয়ার ছেলেটাকে দিয়ে আনিয়ে দেয়া যায় কি না।এই এলাকায় অনেক রাত পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকে।’
“স্যার,ও যেটা খেতে চাচ্ছে সেটা আপনি কিছুতেই এনে দিতে পারবেন না।আমাকেই এনে দিতে হবে।”
‘কি এমন জিনিস যে আমি আনাতে পারবো না?’
রীতিমতো রাগ লাগছে,এভাবে মুখের উপর কেউ বলে,”আপনি পারবেন না?”
বাবাটা হেসে ফেললো।
“স্যার রাগ করবেন না।কিন্তু সত্যি আপনি এনে দিতে পারবেন না।আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?আমি আপনাকে দেখাতে পারি,কিন্তু স্যার,আপনি ভয় পাবেন না তো?”
ভয়?আমি পাবো ভয়?ব্যাটা বলে কি?
কোনরকমে রাগ চেপে বললাম,
‘না পাবো না।নিয়ে আসেন দেখি কি আনবেন।আপনাদের গাড়ি আছে?না হলে চাইলে আমার গাড়িটা নিতে পারেন।’
হা হা করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক।কিছু না বলে আমার চেম্বারের খোলা জানালার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।সেই হাত লম্বা হতে হতে কোথায় যে হারিয়ে গেলো।কিছুক্ষণ পর হাত টেনে নিলেন,তখন সেই হাতের মুঠোভরতি জোনাকিপোকা।
“স্যার ভয় পেলেন?ছেলেটা এমন ডেঁপো,যা আবদার করবে তা ই দিতে হবে,নইলে এমন কান্নাকাটি শুরু করে।কিন্তু কি করবো স্যার বলেন,জোনাকিপোকা বেশি খেলে যে যদি দাতে ক্যাভিটি হয়,সেটা একে কে বোঝাবে।আজকালকার ছেলেপুলে,বোঝেনই তো।”
বাবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।মা ছেলেকে জোনাকিপোকা খাওয়াতে ব্যস্ত।ছেলেটা আসলেও ডেঁপো,এখন জোনাকিপোকা পর্যন্ত খাবে না সে।কান্না থেমেছে,কিন্তু ঠোটে ঠোট চেপে ধরে আছে।
বাবাটা আবার জানতে চাইলো,
“স্যার,আপনি ভয় পাননি তো?”
আমি তার চোখের দিকে সরাসরি তাকালাম।তারপর আস্তে করে নিজের মাথাটা গলার উপর থেকে আলগোছে খুলে নিয়ে দুহাতে লোফালুফি করতে করতে বাবুটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
‘বাবা,দেখোতো এটা কি?তুমি নিবা?এইটা আমি তোমাকে দিতে পারি,যদি তুমি সবগুলো জোনাকিপোকা লক্ষ্মী ছেলের মতো খেয়ে নাও।দেখি বাবা,হা করতো,হা..’
বাবা মা আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।সবার আগে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে মা মুখ খুললেন,
“তার মানে আপনিও???”
নওশাদ বাইরে বসে বারবার ঘড়ি দেখছে।আর মনে মনে নিজেকে গাল দিচ্ছিলো,কেন যে সে সামান্য দুইশ টাকার লোভ সামলাতে পারলো না,আর এই রাত বিরাতে তার স্যারই বা কি করছেন এই এক রোগী নিয়ে।
এমন সময় হঠাৎ করে তার স্যারের চেম্বার থেকে ভেসে আসে তিনজনের হাসির আওয়াজ,দুইজন পুরুষ আর একজন মহিলার,একেবারে গা হিম করা আওয়াজ।এমন অশরীরী ভাবে সে কখনো তার স্যারকে হাসতে শোনেনি…..
লেখকঃ
ডাঃ মোঃ বেলায়েত হোসেন
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ
এরকম গল্প আরও চাই ,ভাল লাগছে।
What a great story..:-P
গল্প চাই আরো।। নইলে কান্না থামাবো না জিদ করেছি।