১৯ জুন ২০২০, শুক্রবার
ডা. মো. রাজিবুল বারি
সহকারী অধ্যাপক, রেডিওলোজী,
পি.এইচ.ডি. গবেষক, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়।
ধরা যাক একটি উন্নত রাষ্ট্রের সকল অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং দালানকোঠা আমাদের দেওয়া হল। কিন্তু যদি দক্ষ চিকিৎসক না থাকে, তাহলে সব অচল। চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যসেবার মূল চালিকাশক্তি। সবকিছু থাকলেও চিকিৎসক না থাকলে থমকে যাবে চিকিৎসাসেবা।
করোনা মহামারিতে অপর্যাপ্ত ও নিম্নমানের প্রোটেকশন নিয়ে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে আমরা হারাচ্ছি সবচেয়ে দক্ষ চিকিৎসকদের। প্রতি ২ ঘণ্টায় একজন চিকিৎসক আক্রান্ত হচ্ছেন। অর্ধশত চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন। চারটি হাসপাতালের আই.সি.ইউ. প্রধান ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশে করোনায় আক্রান্তের হার ঊর্ধমুখী। এই মুহূর্তে ভগ্ন স্বাস্থ্যসেবার সমালোচনা করেও কোন লাভ নাই।
১৮ কোটির জন্য স্বল্প সংখ্যক চিকিৎসক রয়েছে আমাদের। মোট লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসক ১ লাখ। এদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন, অনেকে প্র্যাকটিস করেন না, অনেকেই বেসিক সাবজেক্ট অর্থাৎ একাডেমিক চিকিৎসা শিক্ষায় জড়িত। ক্লিনিক্যাল সাইডের লোকবল কম। সরকারী চিকিৎসকের সংখ্যা আরও কম। এই অবস্থায় সরকারকে অবশ্যই চিকিৎসকদের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, প্রশাসন উল্টো কাজটাই করছেন। যেমন: মাস্ক নিয়ে যারা প্রতিবাদ করেছে, তাদের বদলি করে দেয়া হয়েছে। কয়েকজনকে শোকজ দেয়া হয়েছে। ‘শেখ রাসেল হাসপাতাল’ অসুস্থ ডাক্তারদের বরাদ্দ দেবার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পুরো হাসপাতাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে কূটনৈতিকদের জন্য। এখনো বিষয়টি পরিষ্কার নয়। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে লিখিত আকারে উল্লেখ করা হচ্ছে, কোন মাস্ক দেয়া হবেনা। একই মাস্ক বারবার পরার কারণে আক্রান্তের হার বেড়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে প্রায় বায়ুরোধী PPE পরে ডিউটি করার ফলে শরীর ঘেমে দূর্বল হয়ে পড়ছে। টানা ৮ থেকে ২০ ঘণ্টা ঐ পোশাক পরে থাকা দুর্বিষহ।
যাদের ডায়াবেটিস, এ্যাজমা, হৃদরোগ, প্রেগন্যান্সি রয়েছে তাদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বেহাল রেস্টরুম অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। খাবারের ব্যবস্থা নাই। ব্যক্তিগত খাবার গরমে নষ্টও হয়ে যায়। টয়লেটের অবস্থা করুণ। অনেকসময় বিদ্যুৎ সমস্যাও থাকে। এসি পরের কথা, ফ্যানও নষ্ট থাকে। প্রান্তিক অঞ্চলে রাতের বেলা অনেক সমস্যা হয়। মশার কয়েল, মশারি, পানির বোতল এসবও পাওয়া যায়না। এসব ছোটখাটো বিষয় মনে হলেও চিকিৎসকের মনের উপর প্রভাব ফেলে। এরমধ্যে অনেকেই বেতন পাচ্ছেনা। পারিবারিক নিরাপত্তা ও দুশ্চিন্তা তো আছেই। এগুলো মেটানো কঠিন কাজ নয়। বড় কোন বাজেট লাগেনা। শুধু লাগে মূল্যায়ন।
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ডাক্তারদের মানবিক হতে। আগুনে ঝাঁপ দিলে মরতে হবে জেনেও আগুনে ঝাঁপ দেয়া তো মানবিকতা নয়, বোকামি। প্রোটেকশন থাকলেই কেবলমাত্র আগুনে ঝাঁপ দেয়া যায়। প্রমাণ হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন অলরেডি অর্ধশত চিকিৎসক মারা গেছে, যাদের বেশিরভাগ আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল শুধু সেই মানবিকতার জন্যই। আপনাকে অনুরোধ করছি ডাক্তারদের প্রতি মানবিক হোন। আপনি আরও বলেছিলেন, শর্ত দিয়ে কাউকে চাকরিতে রাখবেন না, প্রয়োজনে বিদেশ থেকে ডাক্তার আনবেন।
ডাক্তারদের উপর আপনার ক্ষোভের হয়ত কারণ আছে। কিন্তু অল্প কয়েকজন ডাক্তারের বদনামের দায় আমরা সবাই কেন নেব? আর আমরা তো শর্ত দেইনি। আপনাকে কে বা কারা এসব বলেছে? আপনি কি কোন ডাক্তারের থেকে এই কথা শুনেছেন? ডাক্তারদের কোন সংগঠন কি এভাবে শর্ত দিয়েছে? আমরা শুধু নিরাপদ কাজের পরিবেশ চাই। আর কিচ্ছু নয়।
আমাদের শ্রদ্ধেয় সিনিয়র চিকিৎসকরা মারা গেছে, কেউ কোন বিবৃতি দেয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের নামটা পর্যন্ত বলে নাই। এক পাতার শোকবার্তা তো অন্তত দেয়া যায় পত্রিকাগুলোতে। অথচ সচিবের বউ মারা গেলে আলাদা হেডলাইন হয়। ডাক্তার বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আর যদি জীবনের কোন মূল্যই না থাকে, তাহলে হাসপাতাল বন্ধ করে দেন। আমরা ভিন্ন পেশায় চলে যাই। মানবিকতা একপক্ষীয় হলে চলেনা। এই মুহূর্তে যারা ডিউটি করছে, সবাই শুধু সেবার মানসিকতা নিয়েই ডিউটি করছে। এবং অবশ্যই তারা মানবিক। সরকার ডাক্তারদের প্রতি একটু মানবিক হলে চিকিৎসাব্যবস্থার ধ্বস ঠেকানো সম্ভব। অতএব আসুন আমাদের চিকিৎসকদের বাঁচাই। চিকিৎসক বাঁচলে দেশের মানুষ বাঁচবে।