চিকিৎসকদের শ্রম বাজারঃ বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
সূচনাঃ
বাংলাদেশে চিকিৎসকদের শ্রম বাজার এখনও অবিকশিত। এর অনেকগুলো কারণ আছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো চিকিৎসকদের প্র্যাকটিস নির্ভর আয়। একসময় এমবিবিএস পাশ করেই চুটিয়ে প্র্যাকটিস করা যেত। আয়ও ভালো ছিল তাই পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য কেউ এতটা মরিয়া ছিলেন না। আজ থেকে ২০ বছর আগেও আমাদের সিনিওররা শেষ বয়সে এসে ডিপ্লোমা বা এ জাতীয় ডিগ্রী করতেন এবং এ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন। সময়ের সাথে সাথে অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। প্র্যাকটিস করার জন্য এখন শুধু এমবিবিএস দিয়ে আর হচ্ছেনা। তাই Maslow’s Hierarchy of Needs এর নিচের ২ ধাপ সু-সংহত করার জন্য সবাই পোস্ট গ্রাজুয়েশনের দিকে ঝুকলেন।
আজকে আমরা প্র্যাকটিসের পরিবর্তে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতে চিকিৎসকদের শ্রম বাজারটা দেখে আসবো।
অনুমান সমূহঃ
এই লেখাটি ২ টি অনুমানের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে, যথা-
১। এমবিবিএস পাশ করে আপনি বেসরকারি চাকুরি করবেন
২। পেশায় নিয়জিত থাকবেন এবং চাকুরির নিয়ম কানুন মেনে চলবেন।
শ্রম বাজারঃ
শ্রম বাজারে প্রবেশ নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নাই। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন এবং আপনার যোগ্যতার মিশেল হলেই কেবল আপনি চাকুরিতে প্রবেশ করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন মানে বেসরকারী খাতে এই মুহূর্তে কতজন চিকিৎসকের প্রয়োজন তার সঠিক হিসাব আমার কাছে নাই। তবে ‘বেসরকারি ক্লিনিকসমূহ ও ল্যাবরেটরি অর্ডিন্যান্স ১৯৮২’ অনুযায়ী প্রতি ১০ বেডের ক্লিনিকে নূন্যতম একজন চিকিৎসক ২৪ ঘন্টা থাকার কথা। এই হিসাবে সহজেই অনুমান করা যায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সংখ্যক চিকিৎসক দিয়েই বেসরকারি খাতটি কোনো ভাবে চলছে।
সুযোগ-সুবিধাঃ
এই আলোচনার সুবিধার্থে চিকিৎসকদের শ্রম বাজারকে (বেসরকারী খাতে) নিচের ৫ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
১। প্রাইভেট ক্লিনিক/হাসপাতালঃ
ক) খ্যাপ প্রথাঃ আপাত দৃষ্টিতে বেতন ভাল। মাস শেষে ভালো টাকা হাতে চলে আসে। কিন্তু চাকুরির ক্ষেত্রে বেতন হচ্ছে টিপ অব আইচ বার্গ। নিচে আছে পিএফ, গ্রাচুয়িটি, ইনক্রিমেন্ট, উৎসব ভাতা, প্রমোশন, ইন্সুরেন্স, চাকুরির নিশ্চয়তা, ছুটি এবং কর্ম পরিবেশ। খ্যাপ প্রথায় আপনি কোনো সুযোগ সুবিধাই পাচ্ছেন না এক মজুরী ছাড়া। কাজ করলেন তো মজুরী পেলেন, কাজ নেই তো মজুরী নেই। কিন্তু চাকুরি নীতিমালা মেনে কোনোভাবেই কাজ করা সম্ভব না। কেননা দিনে ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৭ দিন কাজ করা অসম্ভব।
খ) ডিউটি প্রথাঃ কথা একই। আপনি মজুরী পাচ্ছেন। কাজ করলেন তো মজুরী আছে, কাজ নেই টাকাও নেই । খ্যাপ থেকে একটু ভালো। নির্দিষ্ট কর্ম ঘন্টায় কাজ করা যায়। দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করলে মাসে আপনি সর্বোচ্চ ৩২০ ঘণ্টা কাজ করতে পারবেন।
৮ ঘণ্টা ডিউটি হসাবে ডিউটি দাঁড়ায় ৪০ টি। বর্তমান বাজারে আপনার মাসিক আয় দাড়ালো ৮০০*৪০= টা ৩২০০০ (বত্রিশ হাজার টাকা!)।
২। এনজিও হাসপাতালঃ বেতন স্কেল আছে। অন্যান্য সেক্টর যথা ব্যাংক/ফার্মাসিউটিকাল থেকে অনেক কম। চাকুরী সাধারণত সল্প সময়ের জন্য এবং চুক্তি ভিত্তিক হয়ে থাকে। চাকুরী সবটাই বিদেশী অনুদান নির্ভর। মাসিক আয় ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
৩। মেডিকেল কলেজঃ বেতন স্কেল আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আনুসাঙ্গিক সুবিধা যথা পিএফ, গ্রাচুয়িটি, ইনক্রিমেন্ট, উৎসব ভাতা ইত্যাদি থাকে না। অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় বেতন অনেক অনেক কম। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ হাজারের মধ্যে হয়ে থাকে। পার্ট টাইম চাকুরি করলে ৩০ – ৩৫ হাজার আয় করতে পারবেন।/
৪। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালঃ মেডিকেল কলেজের মত।
৫। কল-কারখানা/শিল্প প্রতিষ্ঠান
ক) স্থায়ী নিয়োগঃ কোম্পানি ভেদে তুলনামুলক ভাল সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়।
খ) চুক্তি ভিত্তিক/খণ্ড কালিনঃ অনেকটা ক্লিনিক ডিউটির মত। তবে ছুটি ছাটা কিছু পাওয়া যায়। মাসিক বেতন ১০ – ১৫ হাজারের বেশি হয়না।
গ) থার্ড পার্টিঃ সাধারনত বিদেশী প্রতিষ্ঠান সমুহ এভাবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আপনি নিয়োগ পাবেন থার্ড পার্টি/কনট্রাক্টরের মাধ্যমে। বেতন-ভাতা বা কোম্পানির কোনো সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হবেন না। মাস শেষে দেখবেন সেখানকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সময়মত ভাল সেলারি ড্র করছে আর আপনি বেতনের জন্য কনট্রাক্টরকে ২/৩ বার ফোন দিচ্ছেন। অনেটা খ্যাপ প্রথার মত।
উপসংহারঃ
এই আয়ে একজন গ্রাজুয়েট চিকিৎসক কিভাবে দিনাতিপাত করবেন সেটা তার ব্যাপার। কিন্তু এধারা অব্যাহত থাকলে, চিকিৎসকদের শ্রম বাজারকে বিকশিত করা না গেলে মেধাবী শিক্ষার্থী তো দুরের কথা সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকেও মেডিকেল শিক্ষার মত শ্রমসাধ্য শিক্ষায় আনা যাবেনা। আর যদিও বা আনা যায় অর্থনিতীর নিয়মেই তারা পেশা থেকে ছিটকে পড়বেন। তাই স্বাস্থ্য খাতে অর্জন সমূহ ধরে রাখতে এবং খাতটিকে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিকিৎসকদের শ্রম বাজার বিকশিত করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
লেখাঃ
ডাঃ কবীর উদ্দিন আহমদ
জেআরআরএমসি, সিলেট (১৯৯৮-৯৯)