প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, বুধবার
লেখা- ডা. জাহিদুর রহমান
এ দেশের “পদক” পাওয়ার পন্থাগুলো এতই তৈলাক্ত, চিন্তা করতে অরুচি হয়। তবে এ বছর চিকিৎসায় একুশে পদক না দেয়াটা একটু বেশি কদাকার হয়ে গেল।
ডাক্তাররা না হয় নষ্ট, ভ্রষ্ট, ফাঁকিবাজ, করোনার ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আকাশ থেকে ফেরেশতারা নেমে এসে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করেছে, করোনা টেস্ট করেছে, চিকিৎসা দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালকে তো দিতে পারতেন। আপনারা, মানে ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট পার্সনরা যেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন সেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালকেও তো দিতে পারতেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার একাই কয়েক লাখ করোনা টেস্ট করেছে, তাদেরকেও কি যোগ্য মনে হল না? বিএসএমএমইউ ফিভার ক্লিনিক চালুর মাধ্যমে দেশের প্রথম করোনা রোগীদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অন্যান্য জটিল রোগসহ করোনায় আক্রান্ত রোগীদের অভিনব সেবা দিয়েছে যা আর কোন হাসপাতাল দিতে পারেনি। কত মানুষ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে বেঁচে গিয়েছে জানেন?
একুশে পদক পাওয়ার এক নম্বর দাবিদার তো ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সেই চিকিৎসক যিনি মাসের পর মাস ভুয়া এন ৯৫ পরে করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
একুশে পদক তো আইইডিসিআর এর সেই নাম না জানা ভাইরোলজিস্টের পাওয়া উচিত ছিল, যিনি একা হাজার হাজার রোগীর করোনা টেস্ট করতে গিয়ে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে গিয়ে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছেন।
একুশে পদক তো সেই নার্স বা মেডিকেল টেকনলোজিস্টের পাওয়া উচিত ছিল যে গত এক বছরে এক পয়সা প্রণোদনা না পেয়েও দিনের পর দিনের করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে গিয়েছেন, পরিবারসহ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, সুস্থ হয়ে আবার নিজের কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়েছেন।
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে না দিলেও ফ্রন্ট লাইন ফাইটার হিসেবে দেশের সব স্বাস্থ্য কর্মীদের তো অন্তত দিতে পারতেন। নাকি?
রাষ্ট্র বা সরকারের উচ্চপদস্থ কোন ব্যক্তি শেষ কবে দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ধন্যবাদ দিয়েছেন, আমাদের স্মরণে নাই। অন্য দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার পরও ভাষণ শুরু হয় স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ দিয়ে। আর আমাদের দেশে ডাক্তাদের অনুষ্ঠানে এসে অন্য পেশার মানুষদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়, অন্য দেশ থেকে স্বাস্থ্যকর্মী আনার পরিকল্পনা করা হয়। গত এক বছরে লাখ লাখ করোনা রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পিছনে কোন কোন দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদান ছিল, খুব জানতে ইচ্ছা করে। বর্তমানে ইতিহাসের সফলতম টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনায় বিদেশের কয়জন স্বাস্থ্যকর্মী যুক্ত আছেন, খুব জানতে ইচ্ছা করে।
দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, ধন্যবাদ দিতে শিখেন। যোগ্যদের স্বীকৃতি দিন, উৎসাহ দিন। দেখবেন তারা আরো বেশি নিজেদের উজাড় করে দিবে। দিনের পর দিন অবহেলিত হলে, চোখের সামনে অযোগ্যদের আস্ফালন চলতে থাকলে কাজ করার ইচ্ছাটা আর অবশিষ্ট থাকে না। কয়েক বছর পর নিজেদের ছানা পোনা, নাতিপুতিদের চিকিৎসা করানোর জন্য নাম সর্বস্ব মেডিকেল থেকে পাস করা সার্টিফিকেট সর্বস্ব ডাক্তার ছাড়া আর কাউকে পাবেন না। আমরা বোকা হলেও, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বোকা হবে না। যে দেশে সম্মান আছে, সেখানেই চলে যাবে। সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুধু হয়ে গিয়েছে। উটপাখির মত বালুতে মুখ গুঁজে আছেন বলে টের পাচ্ছেন না।