প্ল্যাটফর্ম নিউজ, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার
প্রফেসর ডা. মো: সোহাইলুল ইসলাম
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
দীর্ঘদিন আগের কথা নয়। শরীর কেন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন আমরা জানতাম না। তখন ইন্টারনেট ছিল না। বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যালস বা ল্যাবরেটরি ছিল না। চিকিৎসকগণ ধারণার উপর ভিত্তি করে রোগের চিকিৎসা দিতেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে কিছু বিজ্ঞানী অনুজীব সম্পর্কে জানতে শুরু করে। লুই পাস্তুর তাঁদের অন্যতম। তাঁর নাম বেশি ধ্বনিত হয় তার কারণ, তিনি দুধকে জীবানুমুক্ত করার একটি বিশেষ পদ্ধতি আবিস্কার করেন, যার নাম “Pasteurization“। লুই পাস্তুর ছিলেন একজন ফরাসি কেমিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট যিনি সর্বপ্রথম মানবদেহে রোগের কারণ সম্পর্কে গবেষণা করেন।

লুই পাস্তুর
অনেক দিন পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল, রোগ শোক হচ্ছে demon বা শয়তানের ক্রিয়াকলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। পাস্তুরই প্রথম ঘোষনা দেন, শয়তান নয়, অদৃশ্য জীবাণুর কারণেই মানব শরীরে সংক্রামক রোগের উৎপত্তি। ১৮৮১ সালের একটি বিশেষ মূহুর্ত। যেদিন বিশ্ববাসীকে পাস্তুর বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ দেখালেন, জীবাণুর সংক্রমনেই রোগের উৎপত্তি। একজন প্রাণীরোগ চিকিৎসক দারুণভাবে তার প্রতিবাদ জানান এবং অদৃশ্য জীবাণু দ্বারা যে Anthrax নামক অসুখ হতে পারে তা মানতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
সেদিনগুলোতে আজকের মত অনলাইনে প্রাণী দেহে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমানে অবশ্য প্রাণীদেহে ভ্যাকসিন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ভিডিওতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে চোখের পানি পর্যন্ত ফেলতে হয়। ভিডিও কনফারেন্সের ব্যবস্থা না থাকায় পাস্তুর ঐ ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞকে সরাসরি ফিল্ডে আসার আমন্ত্রন জানান। একটি বৈজ্ঞানিক দ্বৈরথের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। ফ্রান্সের একটি ভেড়ার ফার্মে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সম্পূর্ণ সুস্থ মোট পঞ্চাশটি ভেড়া যোগাড় করা হয়। পঁচিশটি ভেড়ার শরীরে এনথ্রাক্স ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। অবশিষ্ট ভেড়াগুলোকে ঐ ভ্যাকসিন বা কোন ঔষুধ দেওয়া হয়নি। অতঃপর, পঞ্চাশটি ভেড়ার সবগুলোকেই এনথ্রাক্স রোগের আক্রমণাত্মক জীবানু (Virulent Strain) ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়।
এটি ছিল একটি বিশাল কর্মকান্ড। সারাবিশ্ব থেকে প্রচুর সাংবাদিক এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করার নিমিত্তে ফ্রান্সে জড়ো হয় এবং প্রকাশিত খবরটি ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। যে পঁচিশটি ভেড়ার শরীরে এক্সপেরিমেন্টাল ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়, তারা ছিল সম্পূর্ণ সুস্থ। অবশিষ্ট ভেড়াগুলো পরিষ্কার অর্থে এনথ্রাক্স রোগে মারা যেতে থাকে। বিশ্বজুড়ে সংবাদপত্রের ফ্রন্ট পেইজে এই বৈজ্ঞানিক তথ্যটি ছড়িয়ে পড়ে। দার্শনিকের মত অশ্রুমন্ডিত লুই পাস্তুরকে সেদিন সংবাদপত্রের শিরোনামে একজন “সাইন্স রক স্টার” হিসেবে অভিহিত করা হয়। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম প্রয়োগকৃত ভ্যাকসিনগুলোর অনেক গুলোই তাঁর আবিষ্কার। বিশেষকরে তাঁর আবিস্কৃত Fowl Pox Vaccine ইউরোপের চিকেন ইন্ডাস্ট্রিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তাঁর মাইক্রোবায়োলজি রিসার্চ ফ্রান্সের সিল্ক শিল্পের পুনর্জন্ম দেয় এবং Pasteurization নিয়ে তার অবদান ফ্রান্সের বিয়ার ও ওয়াইন শিল্পকে টিকিয়ে রাখে। “ফাদার অব মাইক্রোবায়োলজি” হিসেবে তাঁর নাম বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
সত্যি বলতে, উনিশ শতকে প্রতি ৪ জন শিশুর মধ্যে ১ জনকে তাদের প্রথম জন্মদিনের আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হত সংক্রামক রোগের কারণে। লুই পাস্তুরের Germ Theory এর প্রবর্তন এবং Pasteurization পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হবার পর, শিশুরা বিশুদ্ধ দুধ পান করার কারনে আমেরিকা ও ইউরোপে ইনফ্যান্ট মর্টালিটির হার ৫০% কমে যায়।ফ্রান্সের সেই ভেড়ার ফার্মের কৌতুহল উদ্দীপক ঘটনার দিন থেকে শুরু করে একশ বছরের বেশি সময় ধরে আমেরিকায় Pasteurization পদ্ধতি আইনে পরিণত হয়।
ইতিমধ্যে লুই পাস্তুর Rabies ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করে মানব জাতিকে মারাত্মক জলাতংক রোগের ছোবল থেকে রক্ষা করেন। যার দেখানো পথ ধরে বিভিন্ন দশকে উদ্ভাবিত হয় টাইফয়েড, পোলিও, হামের মত আরও অনেক ভ্যাকসিন।
জোসেফ মেইস্টার; যার উপর প্রথম জলাতঙ্ক রোগের টিকা প্রয়োগ করা হয়
জার্মান রেভোলুশনের ফলশ্রুতিতে উদ্ভাবিত Small Pox Vaccine একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে রাজত্ব করেছে এবং এই রোগকে নির্মুল করেছে। পাস্তুরই প্রথম “Doctrine of Spontaneous Generation” কে ভুল প্রমাণিত করেন। তিনি গবেষণার মাধ্যমে প্রমান করেন, contamination বা ছোঁয়া ব্যতীত জীবাণু কখনো স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্ম নিতে পারে না। লুই পাস্তুর রসায়নে কতগুলো উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করেন। তিনি ক্রিস্টালের আণবিক গঠন আবিষ্কার করেন।ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে Tartaric Acid নিয়ে তাঁর গবেষনা বর্তমান জৈব রসায়নের বহুল ব্যবহৃত Optical Isomer এর ভিত্তি গড়ে তোলে।
পাস্তুরের শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন চার্লিস ফ্রীডেল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা Friedel–Crafts Reaction বলে যে Acetylation-Alkylation এর সূত্র জানেন তা উনাদের অবদান।লুই পাস্তুর ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গ ইউনিভার্সিটি ও লিলি ইউনিভার্সিটিতে অনেক বছর কাজ করার পর ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাস্তুর ইন্সটিটিউটে আমৃত্যু পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এবং ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫ সালে ৭২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হলে, তাঁকে ঐ ইনস্টিটিউটের মাটির নীচে একটি ভল্টে ভরে কবরে শায়িত করা হয়। ১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া এই অণুজীব বিজ্ঞানী তাঁর বিখ্যাত Germ Theory এবং Vaccination Principle প্রবর্তন করে মানবকল্যানে যে অবদান রেখে গেছেন, তা যদি না হতো , ১৯১৮ ও ২০১৯ এর double pandemic এ পৃথিবীর মানুষ দ্বিতীয়বার মৃতের দুর্গন্ধ উঠার আগেই হয়তো অন্য গ্রহে পালিয়ে যেতো অথবা সাগরে অভিবাসন খোঁজার চেষ্টা করতো।