এডিস মশা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এক ত্রাসের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু এর পরপরই যে মশাবাহিত মহামারী আমাদের দেশের দিকে সাইক্লোনের গতিতে এগিয়ে আসছে তার নাম “জিকা”। যার বাহকও এই এডিস মশা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এই রোগ। সম্প্রতি ব্রাজিলে জিকার প্রাদুর্ভাবকে “জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা” হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় ২০১৪ সালে। ঐ বছর সারা বাংলাদেশের ২০০ জনের রক্তের স্যাম্পল নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়। তবে আক্রান্ত রোগীর দেশের বাইরে যাওয়ার কোন ইতিহাস না থাকায় আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে এদেশে ২০১৪ সালেরও আগে থেকে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রয়েছে।
এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হল জ্বর, চোখে ব্যথা ও লালচে রঙ, মাথা ব্যথা ও গিটে গিটে ব্যথা এবং শরীরে র্যাশ। এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো হালকা শোনালেও পরবর্তী গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে দীর্ঘমেয়াদে জিকা ভাইরাস স্নায়ু বিকল থেকে শুরু করে গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি মারাত্মক টেরাটোজেনিক। জিকা আক্রান্ত মায়েদের গর্ভের সন্তান মাইক্রোকেফালি নিয়ে জন্ম নেওয়ার ঝুঁকি থাকে। যার কারণে শিশুদের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। ২০১৫-১৬ সালে ব্রাজিলে প্রায় চার হাজারের মতো শিশু এই সমস্যা নিয়ে জন্মায় যার মূলে ছিল এই জিকা ভাইরাস।
বাংলাদেশে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রুপ নিতে পারে যে কোন মূহুর্তেই। এর পিছনে যে কারণগুলো মূল ভুমিকা পালন করছে তা হল:
১।এডিস মশার দু’টি প্রজাতি এডীস ইজিপ্টি ও এলবোপিক্টাস আমাদের গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বিদ্যমান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্বের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলছেন, “বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি শহরে এডিস মশার যে ঘনত্ব রয়েছে তা অনেক বেশি। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সাথে কোনভাবে যদি এই ভাইরাসটা বাংলাদেশে চলে আসে তাহলে কিন্তু এটা আমাদের দেশে ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে।”
২। বাংলাদেশের ৬৬% মানুষ গ্রামে বাস করে যাদের অধিকাংশই পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা হতে বঞ্চিত।
৩। ঘনবসতি, মূলত শহরের বস্তি এলাকাগুলো।
৪। জিকা ভাইরাসের শণাক্তকরণ প্রক্রিয়া। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফলতার পিছনে অনেক বড় ভুমিকা ছিল এর সুলভ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু ভয়াবহ হলেও সত্য বাংলাদেশের “রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট” ছাড়া আর কোন ল্যাব বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই ভাইরাস শণাক্ত করার ব্যবস্থা নেই।
৫। বাংলাদেশের অভিবাসী জনশক্তির একটা বড় অংশ জিকা আক্রান্ত দেশগুলোতে কাজ করছেন। ২০১৫ সালে ব্রাজিলে জিকা ভাইরাসের মহামারীর সময়ে ঢাকা বিমানবন্দরে জিকা শণাক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন,
“বিমানবন্দরের মতো জায়গায় এটির স্ক্রিনিং খুব জরুরি। যাতে করে জিকা আক্রান্ত কোন ব্যক্তি যেন প্রবেশ করতে না পারে। এজন্য আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে জিকা পরীক্ষার সক্ষমতা থাকতে হবে। অন্তত এডিসের মৌসুমে জিকাকেও মাথায় রাখতে হবে।যে সকল দেশে জিকার প্রকোপ রয়েছে সেসব দেশ থেকে এডিসের মৌসুমে যদি বাংলাদেশে কেউ আসেন তাহলে নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ তাকে অন্য মশা কামড়ালে সেই মশাও জিকা বহন করবে ও অন্যদের আক্রান্ত করবে।”
যদিও কাছাকাছি সময়ে নেপাল বা ভারত থেকে ভ্রমণ করে যারা এসেছেন তাদের এমন কোন স্ক্রিনিং এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি বলে জানিয়েছেন।যদিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রধান ড. সানিয়া তাহমিনা জানান বিমানবন্দরে এসব পরীক্ষা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন,
“জিকার ব্যাপারে আসলে উচ্চ মহল থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। যে দেশে এডিস আছে সেদেশে এর ঝুঁকি আছে আমরা জানি। আমরা জানি যদি আমরা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে এর দ্বারা বহন করা কোন অসুখই হবে না।”
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, “আমরা চারটি হাসপাতাল থেকে নিয়মিত রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করছি। সেগুলোর তিন রকম পরীক্ষা হয়। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা। এছাড়া মাইক্রোসেফালিতে আক্রান্ত শিশুদের উপর সারভেইল্যান্সের প্রস্তুতি চলছে যাতে আমরা জানতে পারি তারা জিকায় আক্রান্ত হয়েছে কিনা।”
Dr. Mostafizur Rahaman
Khulna Medical College
Session: 2012-13